জামায়াতের বাধায় ভাঙল শতবর্ষী গাজী-কালু-চম্পাবতীর মেলা

By নিজস্ব সংবাদদাতা, কুষ্টিয়া
22 May 2025, 12:55 PM
UPDATED 22 May 2025, 22:19 PM

জনশ্রুতি আছে যে, সামন্ত রাজা রামচন্দ্র ওরফে মুকুট রাজার মেয়ে চম্পাবতীর প্রেমে পড়ে দরবেশ হয়েছিলেন বৈরাট নগরের বাদশা শাহ সেকেন্দারের ছেলে শাহ গাজী। গাজীর সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন শাহ সেকেন্দারের পালিত পুত্র কালু। সুন্দরবন অঞ্চলে এখনো গাজী পীরকে লোকজ দেবতা হিসেবে মানা হয়।

কালক্রমে কালু ও চম্পাবতীও পরিণত হয়েছেন কিংবদন্তি চরিত্রে। অসাম্প্রদায়িকতা ও লোকজ ঐতিহ্যের উদাহরণ হয়ে থাকা সেই গাজী, কালু ও চম্পাবতীর নামে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাঁপাইগাছি গ্রামে চালু থাকা একটি মেলা বন্ধ হয়ে গেছে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের বাধায়।

এলাকার জামায়াত নেতারাও মেলা আয়োজনে তাদের বাধার বিষয়টি অস্বীকার করেননি। স্থানীয় প্রশাসন ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলেও বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

স্থানীয়রা বলছেন, প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম সোমবার মেলাটি শুরু হয়। চলে এক সপ্তাহ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত। সে হিসেবে এবার মেলাটি শুরু হওয়ার কথা ছিল ১৯ মে। কিন্তু এবার এই মেলা আয়োজনের ক্ষেত্রে তীব্র আপত্তি ছিল জামায়াতে ইসলামীর। মূলত তাদের দাবি ও কিছু মুসল্লির বাধার মুখে ঐতিহ্যবাহী মেলাটির অনুমোদন মেলেনি। ফলে মেলায় আগত ব্যবসায়ীরা দোকানপাট গুটিয়ে নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরে গেছেন।

এ বিষয়ে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক তৌফিকুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় এ বছর মেলার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে মারামারিও হয়েছে। অনুমতি দিলে আরও খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারত।

পুলিশ বলছে, মেলা উপলক্ষে গত ১৭ মে থেকে ব্যবসায়ীরা মেলার মাঠে দোকান বসাতে শুরু করেন। কিন্তু মেলায় 'অশ্লীলতা ও জুয়ার আসর' বসানোর অভিযোগ তুলে জামায়াতের নেতাকর্মীরা মেলা বন্ধের দাবি তোলেন। তবে বিএনপি নেতাকর্মীরা এই মেলা আয়োজনের পক্ষে ছিলেন।

পুলিশের ভাষ্য, ২০ মে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় স্থানীয় মুসল্লি ও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা মেলা বন্ধে চাঁপাইগাছি বাজারে উপস্থিত হয়ে ব্যবসায়ীদের চলে যেতে বলেন। এ সময় স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মী ও মেলার পক্ষের লোকজন উপস্থিত হলে উভয়পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে দুই পক্ষের অন্তত ৮-১০ জন আহত হন।

বিষয়টি নিয়ে কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোলায়মান শেখ বলেন, 'মেলার অনুমতি ছিল না। তারপরও মেলার পক্ষে-বিপক্ষে দুটি গ্রুপ অবস্থান নেন। পরে তাদের মধ্যে সংঘর্ষে কয়েকজন আহত হন। এ ঘটনা জামায়াতে ইসলামী একটি অভিযোগ দিয়েছে।'

এ ব্যাপারে জগন্নাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. ফারুক প্রমাণিক বলেন, 'দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ। তা ছাড়া বিএনপি-জামায়াতের গ্রুপিংয়ের কারণে এবার মেলা হলো না।

'বাপ-দাদারা এই মেলা করে গেছেন। শুনেছি প্রায় দুইশ বছর ধরে মেলাটা হচ্ছে। প্রতিবছরই আমরা অনুমতি পাই। এবারও সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে অনুমতি পাইনি।'

স্থানীয় কলেজের শিক্ষক ও মেলা আয়োজকদের একজন সুলতান বলেন, 'মেলা শুরু না হতেই জামায়াতের নেতাকর্মীরা অশ্লীলতার অভিযোগ তুললেন। এটা হাস্যকর। যে মেলা শত বছর ধরে চলে আসছে, আজ তা অশ্লীল হয়ে গেল?'

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে, কুমারখালী উপজেলা জামায়াতের আমির আফজাল হোসাইন বলেন, 'বিগত বছরগুলোতেও মেলায় অশ্লীলতার প্রতিবাদ করা হয়েছে। তারা [আয়োজকরা] প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে এখানে অশালীন কিছু হবে না। কিন্তু মেলা শুরুর পর দেখা গেছে আবারও সেই অশালীন কার্যক্রম চলছে। পুতুল নাচ, জুয়া খেলা চালু আছে; যা ওই এলাকার যুবসমাজের চরিত্র ধ্বংস করছে।'

এ ব্যাপারে কুষ্টিয়া জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি সুজা উদ্দিন জোয়ার্দ্দারের বক্তব্য, 'যেহেতু মেলাটা ইসলাম অনুমোদিত না, সেজন্য তারা [জামায়াতের নেতাকর্মীরা] সামাজিকভাবে বাধা দিয়েছে। আসলে সেখানে শুধু জামায়াত নয়, দলমত নির্বিশেষে এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মেলার বিরুদ্ধে ছিলেন। এতটুকু তথ্যই আমার জানা আছে।'