মহিষের সঙ্গে বাঁধা জীবন, বছরের ৯ মাস কাটে পথে পথে
পদ্মার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল থেকে নাটোরের চলনবিল পর্যন্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে তিন-চারশ' মহিষ। আর এই মহিষগুলোর সঙ্গেই যেন বাঁধা পড়েছে মোজাম্মেল, মহসীন ও আবুল কাশেমদের জীবন।
বছরের প্রায় নয় মাস এই মানুষগুলো দড়িছাড়া মহিষের সঙ্গে পথ চলেন, নদী-নালা পার করেন আর বর্ষার জলপ্লাবনে অস্থায়ী আবাসে বসবাস করেন। অগ্রহায়ণে তারা ফিরে আসেন নিজ গ্রামে। এই দীর্ঘ ভ্রমণের মাঝেও থেমে থাকে না তাদের পারিবারিক জীবন, ফসলের যত্ন আর চরাঞ্চলের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার কাজ।
এভাবেই শুরু হয় কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার বাহাদুর ইউনিয়নের রায়টা গ্রামের নতুনপাড়ার এই মহিষচরদের গল্প। তাদের জীবনচক্র এবং আয়ের মূল চালিকাশক্তি এই 'মহিষ'।
তাদের গোষ্ঠীতে প্রায় ৩০-৩৫ জন স্বজনের তিন-চারশ' মহিষ আছে। এই মহিষগুলো বছরে অন্তত দুই কোটি টাকার নতুন বাচ্চা উৎপাদন করে। তবে বিশাল এই সংখ্যার মহিষের বাথানের সুস্পষ্ট হিসাব কেউ বলতে পারছেন না।
২৮ নভেম্বর দুপুরে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত রায়টা পাথরঘাটে খড়ের পালায় হেলান দিয়ে বিশ্রাম করছিলেন আবুল কাশেম। পাশে গল্পে মগ্ন কয়েকজন সঙ্গী। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাপ-দাদার আমল থেকেই এই পেশা। তারা কইরি গেছে, আমরাও করছি।'
মহিষ চরাতে তারা পাড়ি জমান নওগাঁর আত্রাই, নাটোরের সিংড়া, চলনবিলসহ আশপাশের এলাকায়। এ সময়ে অস্থায়ী আবাস গড়ে একসঙ্গে থাকেন প্রায় ৩০-৩৫ জন। বর্ষাকালে চারিদিক পানিতে তলিয়ে গেলে দুই মাস আর শীতকালে দুই মাস তারা নিজ এলাকা ভেড়ামারায় থাকেন।
কয়েক কোটি টাকার মহিষ নিয়ে নদীপথে চলতে কোনো ঝুঁকি তৈরি হয় কি না জানতে চাইলে আবুল কাশেম বলেন, 'এ পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনা কিংবা ডাকাত দলের হাতে পড়িনি। এসব নিয়ে ভয়ও করি না।'
পথে পথেই নতুন বাচ্চা জন্ম দেয় মহিষের দল। প্রয়োজনে বিক্রিও করতে হয়। নগদ টাকার প্রয়োজন হলে একটি মহিষ বিক্রি করে দেন এবং সেই টাকায় পালে নতুন বাছুর যুক্ত হয়। এভাবেই চলতে থাকে তাদের জীবনচক্র।
মহসীন জানান, নতুন এলাকায় গেলে স্থানীয় চেয়ারম্যান বা মেম্বারদের জানানো হয়। পরে তাদের সহযোগিতা মেলে থাকার জন্য। খালি হাতে কেউ ফেরান না।
সরকারি কোনো দপ্তর কোনো সহযোগিতা করে কিনা জানতে চাইলে মোজাম্মেল বলেন, 'কখনো কোনো সহযোগিতা পাইনি। প্রয়োজন পড়লে আমরাই ডাক্তার ডেকে চিকিৎসা করি।'
ভেড়ামারা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানান, সাধারণভাবে তাদের জন্য বিশেষ কিছু করা হয় না। তবে গণটিকা দেওয়ার সময় বাথানেও টিকা দেওয়া হয়। বাকিটা প্রাণিসম্পদ অফিস বলতে পারবে।
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর ও ভেড়ামারার পদ্মার চরে এমন আরও অনেক বাথান রয়েছে। এসব বাথানের উন্নয়নে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কোনো সেবা আছে কি না জানতে চাইলে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আল মামুন হোসেন মণ্ডল বিস্তারিত কিছু জানাতে পারেননি। তিনি বলেন, 'মাঠকর্মীরা সব দেখেন। কতগুলো বাথান আছে তা হিসাব করে বলতে হবে।'
দৌলতপুরের নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল হাই সিদ্দিকী বলেন, 'বর্ষাকালে বন্যা হলে গরু-মহিষের বাথান উঁচু এলাকায় চলে যায়। বর্ষা শেষে চরে সবুজ ঘাস জন্মালে তারা ফিরে আসে। চিলমারীর চরে রাস্তাঘাট উন্নত করা হলে এসব বাথান সামগ্রিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।'
তিনি আরও বলেন, 'একবার একটি কোম্পানি বাথানে দুধ উৎপাদনের জন্য এসেছিল। কিন্তু সড়ক যোগাযোগ ভালো না হওয়ায় তারা ফিরে গেছে। বাথানের দিকে নজর দিলে এটাই হতে পারে চরাঞ্চলের অর্থনীতির চাবিকাঠি।'