তানজানিয়া জ্বলছে কেন?
ওরা নেচে-গেয়ে সরকারের স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদ করছিলেন, আর সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা নিরাপত্তা বাহিনী তাদের দিকে ছুড়ে দিচ্ছিল কাঁদানে গ্যাস ও গুলি। নিরস্ত্র সাধারণ মানুষদের প্রতিবাদী কণ্ঠ রোধ করতে সরকার বেছে নিয়েছে নিপীড়নের পথ। তাদের পেছনে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে সরকার-সমর্থিত সশস্ত্র ব্যক্তিদের। তাই গুম-হত্যা-নির্যাতন এখন তানজানিয়ার নিত্যদিনের দৃশ্য। সরকারের ভাষ্য—বহিরাগতরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে।
বলা হচ্ছে পূর্ব আফ্রিকার দেশ তানজানিয়া সম্পর্কে। সেখানকার জনগণ এখন নিজ দেশের সরকারের কাছে 'বহিরাগত'। সেখানে সরকার-বিরোধিতাকে দেখা হচ্ছে রাষ্ট্র-বিরোধিতা হিসেবে।
সাধারণত সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ-অবাধ নির্বাচন একটি গণতান্ত্রিক দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনে। কিন্তু, সেরেঙ্গাতি ও কিলিমানজারো-খ্যাত তানজানিয়ায় এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। সেখানে রাষ্ট্রপতির নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের শুধু একাধিপত্যই নয়, একনায়কোচিত আচরণ দেখা গেল। বিরোধীদের অভিযোগ নির্বাচনে জয় পেতে বিরোধী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতাসহ নানান অভিযোগ এনে তাদেরকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
বিরোধীদের শুধু কারাগারে পাঠিয়েই ক্ষান্ত হয়নি তানজানিয়ার সরকার, প্রতিবাদী সাধারণ মানুষদের গুম করে ফেলা হচ্ছে। বিরোধীদের অভিযোগ, গুপ্ত হত্যার ভয়ে সেখানে কেউ প্রকাশ্যে সরকারবিরোধী কথা বলতে পারছে না।
১৯৯২ সালে তানজানিয়ায় বহুদলীয় গণতন্ত্র শুরুর পর থেকে রাজনৈতিক দল 'ছামা ছা মাপিনদুজি' বা সিসিএম দল প্রতিটি নির্বাচনেই জয়ী হয়ে আসছে। তাতেও দলটির ক্ষমতার সাধ যেন মেটেনি। এখন চললে নির্বিচার হত্যা। গত এক মাসেরও কম সময়ে সেখানে এক হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানাচ্ছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। সরকার বলছে এই সংখ্যা বাড়িয়ে বলা হচ্ছে। আবার, কত মানুষ আহত হয়েছেন বা নিখোঁজ আছেন তা কেউই বলতে পারছে না।
গত ২৯ অক্টোবর তানজানিয়ায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের পর দেশটির নির্বাচন কমিশনের বরাত দিয়ে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানায়, রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করা সামিয়া সুলুহু হাসান নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে ভোট পেয়েছেন ৯৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ফল ঘোষণার পরপরই তিনি শপথ নিয়ে ফেলেন।
কতটা জনপ্রিয় সামিয়া?
যে মানুষ প্রায় ৯৮ শতাংশ ভোট পান সেই মানুষের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে ও ফ্রান্স টুয়েন্টিফোরসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোকে তানজানিয়ার মানুষ বলছে ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য, দেশটির নির্বাচন কমিশন পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে। এই জাতীয় সংস্থাটি জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেনি।
দেশটির পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী নিজ দেশের জনগণের ওপর নির্যাতন চালাতে দ্বিধা করছে না। সরকারবিরোধী প্রতিবাদকে তারা রাষ্ট্র-বিরোধিতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছে। তাই তানজানিয়ায় এত জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি সামিয়া হাসানের বিজয় ধরে রাখতে হচ্ছে শত শত নিরীহ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে। একে নির্বাচনী সংঘাত বলে আর পাশ কাটানো যাচ্ছে না। তানজানিয়ার ঘটনাগুলো ক্রমশ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে গুরুত্ব পাচ্ছে।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে—রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সামিয়ার বিরুদ্ধে কোনো শক্তিশালী প্রার্থী ছিলেন না। বিরোধীদের অভিযোগ¬—এমন পরিস্থিতিতেও সামিয়ার প্রশাসন বিরোধী প্রার্থীদের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেয়। তাদেরকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার পাশাপাশি জেলে ভরা হয়। অনেক রাজনৈতিক কর্মীকে গুম করা হয়েছে। অনেকে হয়েছেন গুপ্তহত্যার শিকার।
দেশটির প্রধান বিরোধীদল ছাদেমা-সহ অন্যান্য রাজনৈতিকদল সেই নির্বাচনকে 'গণতন্ত্রের তামাশা' বলে আখ্যা দিয়েছে। তাদের অভিযোগ, নির্বাচনের পর নিরাপত্তা বাহিনী পাঁচদিন ইন্টারনেট বন্ধ রেখে বিরোধীদের 'বিধ্বস্ত' করেছে। মৃতদের ছবি ও সংবাদ যেন অন্যদের কাছে পৌঁছাতে না পারে সেজন্যই এই ব্যবস্থা। এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে মৃতের সংখ্যা ঘোষণা করা হয়নি। পরবর্তী নির্যাতনের ভয়ে আহত মানুষও যেতে পারছে না হাসপাতালে।
গুলিবিদ্ধ এক তরুণ নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডয়েচে ভেলেকে বলেন, 'রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। পায়ে গুলি এসে বিঁধলো। দেখলাম পুলিশ টার্গেট করে করে গুলি করছে।'
অপর এক বিক্ষোভকারীর কথা—'তিনি যদি এতই জনপ্রিয় হবেন তাহলে তানজানিয়া জ্বলছে কেন? তার নির্বাচনী প্রহসনের প্রতিবাদ জানাতেই তো সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছে।
সংবাদমাধ্যমগুলোর ভিডিওতে দেখা গেল—তানজানিয়ার শহরগুলোয় গাড়ি-বাড়ি, দোকান ও সরকারি ভবন জ্বলছে। মানুষর মৃতদেহ ছড়িয়ে আছে রাজপথে, অলিতে-গলিতে। আহত মানুষদের আত্মচিৎকারে ভারী হচ্ছে আকাশ-বাতাস। কিন্তু, সরকারের যেন ভ্রুকুটিও নেই সেদিকে। সরকারি ভাষ্য—এসব নাশকতাকারীদের কাজ। তারা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। প্রশাসন চেষ্টা করছে বিশৃঙ্খলাকারীদের দমন করে শান্তি ফেরাতে।
জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে 'জাতীয় বিপর্যয়'
গত ১৮ নভেম্বর বিবিসি-এর এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়—রাষ্ট্রপতি বলছেন, নির্বাচনী সংঘাত তানজানিয়ার বৈশ্বিক ভাবমূর্তিকে 'কলঙ্কিত' করেছে। এর মাধ্যমে নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সামিয়া হাসান যেন প্রকারান্তরে মেনে নিলেন যে, গত মাসের নির্বাচন ছিল ভীষণ বিতর্কিত।
প্রতিবেদনে বলা হয়—সামিয়া তার নতুন মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠানে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন যে এই সংঘাত 'দেশকে পেছনে ঠেলে দিতে পারে'। ৬৫ বছর বয়সী এই নেতা আরও বলেন, 'আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে চলি। দেশে যা চলছে তা আমাদের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে।'
বিবিসি-এর সেই সংবাদ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিক্ষোভের পর অন্তত ২৪০ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছে। দেশটিতে প্রায় ৬০ বছর ধরে চলা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবার যেন সজোরে ধাক্কা খেল।
সামিয়ার ২৭ সদস্যের নতুন মন্ত্রিসভায় নতুন মুখ তার মেয়ে বানু হাফিদ আমির। তাকে দেওয়া হয়েছে উপ-শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব। পুরোনো মন্ত্রিসভায় থাকা বানু হাফিদের স্বামী মোহাম্মদ চেঙ্গেরবা নতুন মন্ত্রিসভাতেও জায়গা পেয়েছেন। তিনি পালন করছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব। তবে পুরোনো সাতজনকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ফিরে আসা যাক দেশটির বর্তমান অবস্থায়। গত ২১ নভেম্বর তানজানিয়ার ইংরেজি দৈনিক দ্য সিটিজেন জানায়, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে সংঘাত হয়েছে তা তদন্তের জন্য নয় সদস্যের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করেছেন নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সামিয়া। এই কমিটিতে আইন ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞের পাশাপাশি কূটনীতিক ও আঞ্চলিক শীর্ষ কর্মকর্তারা আছেন।
এর আগে, গত ১৮ নভেম্বর ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠান আফ্রিকা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ-এর এক প্রতিবেদনে তানজানিয়ার 'জাতীয় বিপর্যয়ের' কথা তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে দেশটিতে 'জাতীয় বিপর্যয়' সৃষ্টি হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়—সরকার বিক্ষোভকারী ও সাধারণ জনগণের ওপর নির্মম অত্যাচার চালাচ্ছে। কারফিউ দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য তথা জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। ১৯৬৪ সালে স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তানজানিয়ায় এই প্রথম এতটা রক্তক্ষয়ী সংঘাত দেখা গেল। বিক্ষোভকারীদের মুখে আওয়াজ উঠেছে—'সিসিএম-কে চাই না'। অর্থাৎ, ক্ষমতাসীনদের বিদায় নিতে হবে।
এই দাবি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ায় এ কথা বলা যেতে পারে যে নির্বাচনে সামিয়া হাসান রাষ্ট্রপতি হলেও তার পতন ঘটে যেতে পারে যখন-তখন। কেননা, জনগণ নির্যাতন দীর্ঘদিন মেনে নেয় না। ইতিহাস তো তাই বলে।
মরদেহের স্তূপ, জ্বললে তানজানিয়া
গত ২১ নভেম্বর মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর এক প্রতিবেদনে তানজানিয়ার প্রধান শহর দার-এস-সালামের বানানিয়ামালা হাসপাতালের ভেতরে মরদেহের স্তূপের ছবি প্রকাশ করা হয়েছে।
একই প্রতিবেদনে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ভিক্টোরিয়া হ্রদের তীরে বন্দর বানজার সেকু-তুরে রিজিওনাল রেফারাল হাসপাতালের বাইরে মরদেহের আরেকটি স্তূপের ছবি প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনটির শিরোনামে বলা হয়—'হায় খোদা, এটি আমাদের তানজানিয়া'। শিরোনামে সিএনএন-এর তদন্ত তুলে ধরে বলা হয়েছে যে, বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি ছুড়েছে এবং গণকবরের চিহ্ন দেখা গেছে।
প্রতিবেদন অনুসারে, তানজানিয়ায় বিক্ষোভের অডিও-ভিডিওগুলো সিএনএন পরীক্ষা করে সত্যতা পেয়েছে। সেখানকার মর্গগুলো মরদেহে উপচে পড়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা ইউএনএইচআর বলেছে, শত শত বিক্ষোভকারী ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আহত বা আটক ব্যক্তিদের প্রকৃত সংখ্যা জানা যাচ্ছে না।
অর্থাৎ, তানজানিয়ার মানুষ প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রের চর্চা চায়। লোক দেখানো গণতন্ত্র নয়। দশকের পর দশক ধরে এক দলীয় শাসন থেকে মুক্তি চায় তানজানিয়াবাসী। তাই তাদের টাকায় কেনা গুলিতে নিজ দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে অকাতরে প্রাণ দিয়ে যাচ্ছে দেশটির সাধারণ মানুষ। আবার এসবের প্রতিবাদে সেইসব মানুষ পুড়াচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ। মূলত প্রহসন নয় প্রকৃত গণতন্ত্রের জন্য জনতার হাতে জ্বলছে তাদেরই প্রিয় দেশ তানজানিয়া।

