তানজানিয়ার ‘মা’ সামিয়া হাসান সবার প্রিয়মুখ হতে পারবেন কি?

By স্টার অনলাইন ডেস্ক
29 October 2025, 05:51 AM
UPDATED 29 October 2025, 12:44 PM

পূর্ব আফ্রিকার দেশ তানজানিয়া। অনেকের কাছে তানজানিয়া দুর্লভ বন্যপ্রাণী সমৃদ্ধ মনমুগ্ধকর সেরেঙ্গাতি বনাঞ্চল ও সুবিশাল সুপ্ত আগ্নেয়গিরি কিলিমানজারো দেশ হিসেবে পরিচিত। রাজনৈতিকভাবে পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোর তুলনায় স্থিতিশীল তানজানিয়ার ইতিহাসে ঘটতে যাচ্ছে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। প্রথম কোনো নারী ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে দেশটির রাষ্ট্রপতি হতে যাচ্ছেন। তার নাম সামিয়া সুলুহু হাসান।

আজ বুধবার তানজানিয়ায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সেই নির্বাচনে প্রধান প্রার্থী সামিয়া। গত সোমবার বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বহু তানজানিয়াবাসীর কাছে এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেয়ে বড় বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করা উপ-রাষ্ট্রপতি সামিয়ার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

২০২১ সালে রাষ্ট্রপতির পদে থাকা অবস্থায় মারা যান জন মাগুফুলি। তার মৃত্যুর পর সেই দায়িত্ব নেন উপ-রাষ্ট্রপতি সামিয়া। নারী হিসেবে তিনি প্রথম রাষ্ট্রপতির আসনে বসেন। তবে আগামীকাল নির্বাচনে জয়ী হলে তিনিই হবেন তানজানিয়ার প্রথম নির্বাচিত নারী রাষ্ট্রপতি। শুধু তানজানিয়া নয়, তিনিই হবেন পূর্ব আফ্রিকা অঞ্চলে নির্বাচিতভাবে এমন দায়িত্ব পাওয়া প্রথম নারী।

জন মাগুফুলির বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ ছিল দুর্নীতির। এ ছাড়াও, স্বৈরশাসকের মতো বিরোধীদের দমনের অভিযোগ ছিল। করোনা মহামারি নিয়েও তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বিতর্কিত।

samia-hassan.jpg
তানজানিয়ার কিগোমা শহরে ক্ষমতাসীন সিসিএম দলের মনোনীত রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী সামিয়া সুলুহু হাসানের পক্ষে প্রচারণা। ছবি: এএফপি

কিন্তু, রাষ্ট্রপতির পদে সামিয়া বসার পর সবাই যেন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। তার বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ও সংষ্কারমুখী চিন্তাধারায় সবাই মুগ্ধ হন। তিনি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংস্কারের পাশাপাশি দেশ পুনর্গঠনের দিকে মনোযোগ দেন। তার এমন উদ্যোগের ফলে তানজানিয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ আসতে শুরু করে। তিনি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করেন। তার দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশটির ব্যবসা-বাণিজ্যে ইতিবাচক হাওয়া বইতে শুরু করে।

সামিয়া তার পূর্বসূরি জন মাগুফুলির পথে না হেঁটে রাজনৈতিক ভিন্নমতকে মেনে নেওয়া ও কঠিন পরিস্থিতিতে টিকে থাকার সক্ষমতার ওপর গুরুত্ব দেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোহাম্মদ ঈসা বিবিসিকে বলেন, 'সামিয়া তার পূর্বসূরির সঙ্গে সুস্পষ্ট পার্থক্য সৃষ্টি করেছেন। বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে নষ্ট হওয়া সম্পর্ক ভালো করেছেন।'

কিন্তু, জনগণকে হতাশ হতে বেশি সময় গুনতে হয়নি। মাত্র দুই বছরেই তানজানিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভীষণ নাজুক হয়ে পড়ে। সরকারের সমালোচকদের পাশাপাশি বিরোধীদলগুলোর ওপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জন মাগুফুলির দিনগুলোই যেন ফিরে আসে সামিয়ার শাসনামলে। দেশটিতে নিয়মিত চলছে অপহরণ-গুম ও গুপ্তহত্যা।

মোহাম্মদ ঈসার মতে, 'রাষ্ট্রপতি হয়ে সামিয়া প্রচার করেছিলেন সমঝোতার বাণী। এরপর ধীরে ধীরে তিনি কঠোর হতে শুরু করেন। তার এমন আচরণ কেউই প্রত্যাশা করেননি।'

'এখন তার বিরুদ্ধে অপহরণ-গুম-গুপ্তহত্যার অভিযোগ উঠছে। নিরাপত্তার নামে বিরোধীদের দমনের চর্চা চলছে,' বলে মন্তব্য করেন ঈসা।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউস মনে করে, ২০২০ সালে তানজানিয়া ছিল 'আংশিক স্বাধীন' গত বছর দেশটি সেই স্বাধীনতা পুরোপুরি হারিয়েছে। যদিও দেশটির সরকার এসব অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে নারাজ।

১৯৯২ সালে তানজানিয়ায় বহুদলীয় গণতন্ত্র শুরুর পর থেকে সামিয়ার 'ছামা ছা মাপিনদুজি' বা সিসিএম দল প্রতিটি নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসছে। নির্বাচনী লড়াইয়ে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোও প্রচারণা চালায় সাধ্যমত।

তানজানিয়ার আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ১৭ জন প্রার্থী হলেও প্রধান বিরোধীদল ছাদেমার প্রধান নেতা তুন্দু লিসুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বিচার চলছে। গত এপ্রিলে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তিনি নির্বাচন কমিশন সংস্কারের দাবি জানিয়েছিলেন। এখন দলটি এর সমর্থকদের নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়েছে।

tanzania.jpg
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর তানজানিয়া। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

গত সপ্তাহে এই দলের দ্বিতীয় প্রধান নেতা জন হেছেকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তিনি বিবিসিকে বলেছিলেন রাষ্ট্রপতি সামিয়ার সংস্কারের বাণী 'অন্তঃসারশূন্য'। তিনি বলেন, 'সমাবেশের অনুমতি পাওয়া গেছে। কিন্তু, ছাদেমা দল সমাবেশ করতে পারে না। কারণ, সরকারে পক্ষ থেকে সংস্কারের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।'

দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধীদল এসিটি বাজালেনদোর রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী লুহানা মপিনাকে দুইবার 'অযোগ্য' ঘোষণা করা হয়। পরে উচ্চআদালতের রায়ে তিনি প্রার্থিতা ফিরে পান।

ছোট ছোট দলগুলো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পেলেও তাদের পক্ষে সামিয়াকে পরাজিত করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের অনেকে। আর এ কারণে অনেক নতুন ভোটার এই নির্বাচনে ভোট দিতে আগ্রহী নন।

দেশটির সবচেয়ে বড় শহর দার এস সালামের বাসিন্দা গডফ্রে লুসানা বিবিসিকে বলেন, 'আমাদের নির্বাচনে শক্তিশালী বিরোধীদল নেই। নির্বাচন ব্যবস্থাও স্বাধীন নয়। নির্বাচনের আগেই জানতে পারি কে বিজয়ী হতে যাচ্ছেন। ভোট দিয়ে সময় নষ্ট করতে চাই না। নির্বাচন কমিশন যদি সত্যিই স্বাধীন হতো তাহলে ভোট দিতে উৎসাহ পেতাম।'

তবে তানজানিয়ার আধা স্বায়ত্তশাসিত জানজিবার দ্বীপের চিত্র একেবারে উল্টো। সামিয়ার বাড়ি সেই দ্বীপে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর সিকিউরিটি স্টাডিজের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ, বিরোধীদলকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে রাখার প্রচেষ্টা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষপাতিত্ব নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতাকে দুর্বল করে দিয়েছে। সাধারণ নাগরিকদের অনাস্থা ও ভোট দিতে ভোটারদের অনাগ্রহ নির্বাচনের গুরুত্বকে আরও কমিয়ে দিয়েছে।'

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নেওয়ার প্রথমদিকে ৬৫ বছর বয়সী এই নারীকে 'মা সামিয়া' বলে সম্বোধন করা হতো। সেই সুখস্মৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে তানজানিয়ার মূল ভূখণ্ডে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো হচ্ছে। তখন তিনি আদেশ নয় আলোচনার মাধ্যমে দেশ চালানোর কথা বলেছিলেন।

তিনি সার্বিক অবকাঠামো, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে উন্নয়নের কথাও বলেছিলেন।

বিবিসির প্রতিবেদন অনুসারে, গ্রামাঞ্চলের নারীদের অনেকে সামিয়াকে স্থিতিশীলতার 'মূল শক্তি' বলে মনে করেন।

tanzania-opposition.jpg
তানজানিয়ার প্রধান শহর দার এস সালামে বিরোধীদের ওপর পুলিশের নির্যাতন। ছবি: রয়টার্স

উত্তরাঞ্চলীয় তাঙ্গা শহরের নবীন ভোটার কুইন ক্যাস্টোরিক বিবিসিকে বলেন, 'তিনি আমাদের জন্য সম্মান বয়ে এনেছেন। আমরা তরুণরা তার দিকে তাকিয়ে আছি। তাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখতে চাই।'

সংবাদ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ৬ কোটি ৮১ লাখ জনগনের দেশ তানজানিয়ার ভোটার সংখ্যা ৩ কোটি ৭৭ লাখ। তাদের অধিকাংশ তরুণ। অপহরণ-গুম-গুপ্তহত্যা নিয়ে রাষ্ট্রপতির নীরবতায় তারা ক্ষুব্ধ। কেউ আবার স্থিতিশীল অর্থনীতির জন্য সামিয়ার প্রশংসা করেন।

মূলত কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দেশ হলেও তানজানিয়ায় শিল্প-ব্যবসার প্রসার ঘটছে। এ ছাড়াও, দেশটির অর্থনৈতিক বিকাশে পর্যটন বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার পালন করছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ২০২৪ সালে দেশটির মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ১৮৬ মার্কিন ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পূর্বাভাষে বলা হয়েছে চলতি বছর এই মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ১ হাজার ২২৪ মার্কিন ডলার।

বলা বাহুল্য, দেশটির এই অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা খুবই প্রয়োজন। আর এর জন্য দরকার জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা। একটি দেশে অপহরণ, গুম ও গুপ্তহত্যার মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থাকলে তা আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে চরম প্রভাব ফেলে, যা দিনশেষে গণ-আন্দোলনের রূপ নেয়।

বিশ্বব্যাংকের অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দ্রুত নগরায়নের ফলে ৯ লাখ ৪৭ হাজার ৩০৩ বর্গকিলোমিটারের দেশে ৩৮ শতাংশ মানুষ শহরে বসবাস করছে। তাই তরুণ আইনজীবী ও রাজনীতিক টিটো মাগোতির দাবি খুবই সাধারণ। তিনি বলেন, 'আমরা চাই তানজানিয়ার মানুষ যেন স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারে। যেন স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারে। যা খুশি তা স্বাধীনভাবে করতে পারে।'

এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন: আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তানজানিয়ার 'মা' সামিয়া সুলুহু হাসান প্রকৃত অর্থেই সবার 'প্রিয়মুখ' হয়ে উঠতে পারবেন কি? তিনি নিজ দেশে ইতিবাচক পরিবর্তন এনে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সুনাম অর্জন করতে পারবেন কি?

সামিয়ার নির্বাচিত হওয়ার পর অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ তানজানিয়ার ভবিষ্যৎ কোন দিকে যায় তাই এখন দেখার বিষয়।