দাবি আদায়ের দেশ

আমীন আল রশীদ
আমীন আল রশীদ
15 December 2025, 14:48 PM
UPDATED 15 December 2025, 20:56 PM

প্রায় ৭ ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর পুলিশি সহায়তায় সচিবালয় ছাড়লেন অর্থ উপদেষ্টা। বুধবার গণমাধ্যমে এই খবর প্রকাশের কিছু সময় পরে আরেকটি খবরের শিরোনাম: 'অর্থ উপদেষ্টা বাসায় ফিরেছেন, কাল জারি হতে পারে সচিবালয় ভাতার প্রজ্ঞাপন।' একই দিন রাত ১১টার পরে একাধিক সংবাদমাধ্যমের খবর: আন্দোলনরত মোবাইল ফোন ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে পুরোনো ফোন আমদানির অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

প্রসঙ্গত, বেশ কয়েক দিন ধরেই আন্দোলন করছিলেন মোবাইল ফোন ব্যবসায়ীরা। বুধবার সন্ধ্যায়ও তারা রাজধানীর সার্ক ফোয়ারা মোড় অবরোধ করেন। তাতে পুরো কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, বাংলামোটর ও পান্থপথ এলাকায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। অফিস থেকে ঘরমুখো মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছায়। সচিবালয়ের মতো এখানেও দেখা যাচ্ছে, আন্দোলনের মুখে বা দাবি আদায়ের নামে জনভোগান্তি তৈরির পরে সরকার তাদের দাবি মেনে নিচ্ছে।

এসব ঘটনায় বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে আসছে:

১. যেকেউ যেকোনো সময় যেকোনো দাবি নিয়ে চাইলেই রাস্তায় নেমে যেতে পারে কি না। রাষ্ট্রের সংবিধান ও আইন কি এটা অনুমোদন করে?

২. কিছু লোক একত্র হয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ সড়কে বা মোড়ে ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে আর রাস্তার দুদিক দিয়ে যানবাহন আটকে যাবে—এরকম পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা কী হওয়া উচিত? পুলিশ লাঠিচার্জ করলে একদিকে পুলিশের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলা অন্যদিকে পুলিশ নীরব বা নির্লিপ্ত থাকলে তারও সমালোচনা করার যে দ্বৈত নীতি—সেটির সমাধান কী?

৩. অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পরে গত প্রায় দেড় বছরে অন্তর্বর্তী সরকারকে কতগুলো আন্দোলন বা বিক্ষোভ মোকাবিলা করতে হয়েছে এবং এই বিক্ষোভ দমনে সরকারের কৌশল কি সঠিক ছিল?

৪. একটি অনির্বাচিত এবং সাময়িক সময়ের জন্য দায়িত্বে থাকা সরকারের আমলেই কেন সবাই নিজেদের দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়লো? বিগত দিনে কি এসব দাবি নিয়ে রাস্তায় নামা যেত না বা রাস্তায় নামলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থানে যেত বলে? নাকি এই সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা নেই বলে বিক্ষোভকারীরা মনে করছেন যে দাবি আদায়ের এটাই উপযুক্ত সময়?

৫. অধিকার বা দাবি আদায়ে মিছিল বা সমাবেশ করার অধিকার সংবিধান স্বীকৃত। কিন্তু সেখানে শর্তগুলো কী কী এবং সেই শর্ত মেনে বিক্ষোভ করলে দাবি আদায় হবে না—এই ধারণা থেকেই কি সবাই জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করেন?

৬. অধিকার আদায়ের জন্য নাগরিকদের রাস্তায় নামতে হয় কেন এবং অযৌক্তিক দাবিতে কেউ যদি রাস্তায় নামে তাহলে সেই বিক্ষোভ দমনে সরকারের কঠোর হতে বাধা কোথায়?

৭. সব বিক্ষোভই কি দাবি আদায়ের জন্য হয়ে থাকে নাকি এর পেছনে অন্য কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা থাকে বা বিশেষ কোনো দল বা গোষ্ঠীর ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য থাকে?

৮. অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের প্রতি সংবেদনশীল কোনো পক্ষ বা আওয়ামী লীগের পরোক্ষ সমর্থনেও কি কোনো কোনো গ্রুপ মাঠে নেমেছে—যাতে তারা দেশে ও দেশের বাইরে এটা বলতে পারে যে, সরকার দেড় বছরেও দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারেনি?

প্রসঙ্গত, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই শিক্ষক, শিক্ষার্থী, আনসার, অটোরিকশাচালকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন নিজেদের দাবি-দাওয়া নিয়ে। সরকারি হিসাবে গত প্রায় দেড় বছরে দুই হাজারের বেশি আন্দোলন-বিক্ষোভ হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীর নির্দিষ্ট কিছু পয়েন্ট, যেমন: প্রেসক্লাব, সচিবালয়, শহীদ মিনার, শাহবাগ ইত্যাদি এলাকায় বিক্ষোভ হয়েছে এবং তাতে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, রাজধানীবাসীকে রাস্তায় বের হওয়ার আগে খোঁজ নিতে হতো যে, কোনো সড়কে আন্দোলন চলছে কি না।

নাগরিকের এই উদ্বেগ বিবেচনায় নিয়ে গত ২২ মে একটি জাতীয় দৈনিক তাদের অনলাইন ভার্সনে 'আজ ঢাকায় কোথায় কী' শিরোনামে একটি ফটোকার্ড প্রকাশ করেছিল, যেখানে লেখা ছিল: 'আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে নগর ভবন (ডিএসসিসি), হাইকোর্ট এলাকা, মৎস্য ভবন ও কাকরাইলে ইশরাক সমর্থকদের সড়ক অবরোধ। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত শাহবাগ মোড় ও ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে সাম্য হত্যা মামলার তদন্তে গাফিলতির প্রতিবাদে ছাত্রদলের অবস্থান কর্মসূচি। বিকেল ৪.৩০ মিনিটে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে জাতীয় নাগরিক পার্টির বিক্ষোভ মিছিল।'

গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরে ঢাকা শহরে অটোরিকশার চালুর দাবি; শিক্ষার্থীদের অটোপাস; আনসারদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো; চাকরিচ্যুত সেনা ও পুলিশ সদস্যদের পুনর্বহাল; বিডিআর বিদ্রোহে কারাবন্দি সদস্যদের মুক্তি, ক্ষতিপূরণ ও চাকরিতে পুনর্বহাল; নিয়োগ বঞ্চিত বিসিএস ক্যাডারদের নিয়োগ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত সাত কলেজ পৃথকীকরণ এবং স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় গঠন; এবতেদায়ী শিক্ষকদের জাতীয়করণের দাবি; সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিয়োগসহ বিভিন্ন দাবিতে রাজপথে মিছিল, সমাবেশ ও বিক্ষোভ হয়েছে। এ ছাড়া পলিটেকনিক্যালের শিক্ষার্থীদের অবরোধ, ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ভাতা বৃদ্ধির আন্দোলন, রেলের কর্মচারীদের আন্দোলনও হয়েছে। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ওয়াসা, ডেসা, সচিবালয় কর্মচারী থেকে বিভিন্ন সরকারি, আধা-সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের দাবি নিয়ে মাঠে নামেন।

সবশেষ মাঠে নামেন মোবাইল ফোন ব্যবসায়ীরা। দেশে ব্যবহার করা মোবাইল ফোনের তথ্যভাণ্ডার এনইআইআর (ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার) ব্যবস্থা চালুর প্রতিবাদে এই আন্দোলন। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বুধবার সন্ধ্যায় সচিবালয়ে বহুপক্ষীয় সভায় পুরোনো ফোন আমদানির অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তবে বলা হয় যে, কোন মডেলের পুরোনো ফোন বিদেশে থেকে আনা যাবে, সরকার তা নির্ধারণ করে দেবে। সেইসঙ্গে অবৈধ বা আনঅফিসিয়াল ফোনগুলো ১৫ মার্চ পর্যন্ত নিবন্ধন করারও সুযোগ দেওয়া হয়।

মোবাইল ফোন ব্যবসার আড়ালে অবৈধ অনেক ব্যবসা চলে—এই অভিযোগ বেশ পুরোনো। সেসব অভিযোগের বিষয়ে কতটা নির্মোহ অনুসন্ধান হয়েছে সেটি যেমন প্রশ্ন, তেমনি আন্দোলনের মুখে দাবি মেনে নেওয়া সরকারের দুর্বলতার প্রকাশ কি না—সেই প্রশ্নও জনমনে আছে।

দাবির কাছে সরকাররে নতি স্বীকারে আরেকটি সাম্প্রতিক উদাহরণ সচিবালয়ের কর্মচারীদের বিক্ষোভের মুখে সচিবালয় ভাতা চালুর সিদ্ধান্ত। সচিবালয়ে কর্মরত সব কর্মচারীর জন্য ২০ শতাংশ 'সচিবালয় ভাতা'র দাবিতে বুধবার প্রায় ৭ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখা হয় অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদকে। এরপর বুধবার রাতেই সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, বৃহস্পতিবারই সচিবালয় ভাতার প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে। তার মানে এখানেও সরকার কি আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে?

প্রশ্ন হলো—এরপরে সরকারের অন্যান্য বিভাগও যদি এরকম ভাতার দাবি করে বিক্ষোভ শুরু করে, সরকার কি সেটা মেনে নেবে? ধরা যাক স্থানীয় সরকার ভাতা, গণপূর্ত ভাতা, এনবিআর ভাতা ইত্যাদি। তা ছাড়া সরকার যখন কোনো একটি পক্ষের এমন দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়, তখন আরও অনেক পক্ষ নিজেদের দাবি পূরণে সরকারের ওপর চাপ তৈরির চেষ্টা করে।

সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হওয়ার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।

কিন্তু অনেক সময়ই দাবি আদায়ের নামে যেভাবে মূল সড়ক অবরোধ করে নাগরিকের দুর্ভোগ সৃষ্টি করা হয়; দেশের একমাত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন শাহবাগ মোড় অবরোধ করে যেভাবে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রোগী ও তার স্বজনদের বিপদের সম্মুখীন করা হয়, সেই বিক্ষোভ ও আন্দোলন কোনো অর্থেই সংবিধানের এই ৩৭ অনুচ্ছেদে অনুমোদন করে না। যারা এসব করেন তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন তো বটেই, সংবিধানের এই বিধান লঙ্ঘনের দায়েও ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

কিছু দাবি অবশ্যই অযৌক্তিক। কিন্তু অটোপাস বা অবৈধ মোবাইল ফোন আমদানির সুযোগ কিংবা সচিবালয় ভাতা—এসব দাবিকে মূল মামাবাড়ি আবদার বলেই মনে হয়। রাষ্ট্র কারো মামাবাড়ির আবদার পূরণে বাধ্য নয়।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক