এক বছরে অগ্নি-ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা বেড়ে তিন গুণ
দেশজুড়ে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে থাকা ভবনের সংখ্যা ভয়াবহভাবে বেড়েছে। মাত্র এক বছরে এমন ভবনের সংখ্যা লাফিয়ে তিন গুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৯৮৭-এ। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বারবার সতর্কবার্তা দিলেও উপেক্ষা করতে থাকায় অগ্নি নিরাপত্তার সার্বিক পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবন মালিকদের উদাসীনতা, পর্যাপ্ত নজরদারির অভাব এবং দুর্বল আইন প্রয়োগই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
গত বছর সারাদেশে পরিচালিত এক পরিদর্শনে দেখা যায়, মোট ৭ হাজার ৫৬৮টি ভবনের মধ্যে ২ হাজার ৭৩১টি অগ্নিকাণ্ডের উচ্চ ঝুঁকিতে ছিল। ফায়ার সার্ভিস তখন এসব ভবন মালিককে সতর্ক করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত করার নির্দেশ দেয়।
এ বছর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ৯ হাজার ভবন পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস। এর মধ্যে ১ হাজার ৪৩৫টি ভবনকে 'চরম ঝুঁকিপূর্ণ' এবং ৬ হাজার ৫৫২টিকে 'ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
কারখানা, হাসপাতাল, ক্লিনিক, শপিং কমপ্লেক্স, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি দপ্তরসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা অন্তর্ভুক্ত ছিল এ পরিদর্শনে।
ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা বলছেন, পরিদর্শনের পরিধি বেড়েছে। তবে আগের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোতে এখনো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।
কোনো ভবনে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, জরুরি সিঁড়ি, আলাদা পানির ট্যাংক বা ফায়ার হাইড্রেন্ট না থাকলে সেটিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
ফায়ার সার্ভিসের অপারেশন বিভাগের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, 'আগের তালিকায় থাকা অধিকাংশ ভবন মালিকই নিরাপত্তা নিশ্চিতে উদ্যোগ নেননি। তাই প্রতি বছরই নতুন যুক্ত হওয়ায় অগ্নি-ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা বাড়ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা এখন অনেক বেশি ভবন পরিদর্শন করছি। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তথ্যও বেশি পাওয়া যাচ্ছে।'
ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্তের পর কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমরা ভবন মালিকদের নোটিশ দিই। তবে আমাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নেই। তাই কেউ নির্দেশ না মানলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারি না।'
ফায়ার সার্ভিস মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেন, 'সব স্তরেই সচেতনতা বাড়াতে হবে। ভবনগুলোর জন্য নির্দিষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের সচেতনতা নিশ্চিত হলে পরিস্থিতির অগ্রগতি সম্ভব।'
দুর্বল আইন
২০০৩ সালের অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইনের ১৮ ধারায় বলা আছে—লাইসেন্সের কোনো শর্ত লঙ্ঘিত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সর্বনিম্ন ছয় মাস কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড দেওয়া যেতে পারে।
এ আইন অনুযায়ী, অগ্নি নিরাপত্তা বিধি লঙ্ঘন করলে ফায়ার সার্ভিস তদন্ত করে থানায় মামলা করতে পারে।
তাজুল ইসলাম জানান, কোনো ভবন মালিক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে তারা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), স্থানীয় প্রশাসন বা সিটি করপোরেশনকে জানান। সংস্থাগুলো পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করে।
তিনি আরও বলেন, 'এ ধরনের অভিযানে ভবনের অবস্থা অনুযায়ী জরিমানা বা সিলগালা করা হয়। দেশজুড়ে মাসে ৩০-৪০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা সম্ভব হয়, অথচ প্রয়োজন প্রায় ৪০০টি। লক্ষ্য অর্জনে আমাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রয়োজন।'
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাহিরুল ইসলাম বলেন, 'ফায়ার সার্ভিস ম্যাজিস্ট্রেট চাইলে আমরা সহযোগিতা করি।'
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানও একই কথা বলেন। তিনি জানান, ডিএনসিসি নিয়মিত বাজারগুলোতে অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শন করে এবং নিয়মিত ফায়ার ড্রিল আয়োজন করে।
রাজউক কর্মকর্তারা জানান, তারা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষমতা রাখেন এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের নকশা ও অনুমোদন বাতিল করতে পারেন।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ঢাকার বহুতল বাণিজ্যিক ভবনগুলো রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যৌথভাবে পরিদর্শন করে।
তিনি বলেন, 'কোনো ভবনের নকশা অনুমোদনের আগে আমরা ফায়ার হাইড্রেন্ট, অগ্নি-প্রতিরোধ দরজা বা বিকল্প নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিষয়গুলো দেখি। এগুলো সাধারণত বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক।'
নতুন বিধিমালা সম্পর্কে তিনি জানান, 'আমরা ভবন নির্মাণ বিধিমালা সংশোধন করছি। ঝুঁকি কমাতে আরও কঠোর অগ্নি নিরাপত্তা বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হবে।'
বিশেষজ্ঞদের মতামত
অগ্নি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্যকর নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং কঠোর আইন প্রয়োগ ছাড়া নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।
ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবু নাঈম মো. শাহিদুল্লাহ বলেন, 'সবচেয়ে বড় দুর্বলতা দেখা যায় প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায়, অগ্নি সতর্কবার্তা অ্যালার্ম এবং পানি সরবরাহ ব্যবস্থায়—যা ফায়ার ম্যানেজমেন্টের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।'
তিনি বলেন, 'বাণিজ্যিক ভবন ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ফায়ার ড্রিল হতে হবে। পাশাপাশি আবাসিক ভবনগুলোরও নিয়মিত পরিদর্শন জরুরি।'
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, 'আমাদের দেশের বেশিরভাগ ভবনেই কার্যকর অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। ভবন মালিকদের অবহেলা, কর্তৃপক্ষের দুর্বল নজরদারি এবং আইন প্রয়োগের শৈথিল্য—সব মিলিয়ে ঝুঁকি আরো বাড়ছে।'
তিনি উল্লেখ করেন, 'প্রায় প্রতিটি বড় অগ্নিকাণ্ডের পরই দেখা যায়, ফায়ার সার্ভিস এর আগে ওই ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছিল। কিন্তু মালিক তা উপেক্ষা করেছেন।'
তার মতে, ভবন নকশাতেই অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থা সংযোজন করতে হবে এবং প্রাসঙ্গিক আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।