চলতি পথে মানুষের হঠাৎ থমকে দাঁড়ানোর বৈজ্ঞানিক ব্যাখা

By স্টার অনলাইন ডেস্ক
26 September 2023, 06:06 AM
UPDATED 26 September 2023, 12:46 PM

ধরুন, দীর্ঘদিনের বন্ধের পর আবার খুলেছে আপনার বিশ্ববিদ্যালয়। ট্রেনে করে ফিরছেন আপনি। প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়িয়েছে ট্রেন। আপনি নামতে উদ্যত হলেন। কিন্তু আপনার সামনের যাত্রী যেন হঠাৎই থমকে গেছেন। কিছুতেই আর নড়ছেন না। এমন নয় যে, তিনি ফোনের স্ক্রিনে কিছু দেখছেন। এমনও নয় যে, ট্রেনে অনেক ভিড়। তাহলে?

আসলে আপনার সামনে থাকা মানুষটির ওপর 'ডোরওয়ে ইফেক্ট'র প্রভাব পড়েছে। নিউরো সায়েন্টিস্টদের মতে, কোনো একটি ঘটনা এর সীমা অর্থাৎ 'ইভেন্ট বাউন্ডারি' পেরিয়ে গেলে এমনটি হতে পারে। এতে আশপাশের প্রতিবেশে ঘটা পরিবর্তনের ফলে ব্যক্তি হঠাৎ কিছু সময়ের জন্য স্থবির হয়ে পড়েন।

বিষয়টি আরেকটু সহজ করে বলা যাক। যখন কোনো বাহনে আমরা ভ্রমণ করি, তখন নিজেদের কিছু করতে হয় না (নিজে ড্রাইভ করলে সেটা ভিন্ন ব্যাপার)। ফলে নিজেদের চেনা গণ্ডির বাইরে হঠাৎ করে অচেনা কোনো জায়গায় এসে পড়লে আমাদের মস্তিষ্ক তখন নতুন করে নতুন জায়গাটিকে মাথায় গেঁথে নেয়। ফলে পৌঁছানোর পর জায়গাটির সঙ্গে পরিচিত হতে মস্তিষ্কের সময় লাগে। যেমন- চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামার সময় কিংবা এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাওয়ার সময় কী প্রয়োজনে আসা হলো, তা অনেকে ভুলে যান।

২০২১ সালে এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের নিউরো সায়েন্টিস্ট জেসিকা ম্যাকফেডাইয়েন। তা মতে, 'এখানে দরজার কারণে ভুলে যাওয়ার ব্যাপারটি ঘটে না। বরং তা ঘটে প্রতিবেশের পরিবর্তনের ফলে।'

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, 'ধরুন, আপনি নিজে কোনো শপিং সেন্টারে আছেন। গাড়ি রাখার জায়গা থেকে লিফটে করে অন্য কোনো ফ্লোরে যাবেন। সেক্ষেত্রে প্রতিবেশের পরিবর্তন আপনাকে ভুলিয়ে দিতে পারে যে আপনি কোনদিকে যাবেন।'

radbi_reza_11.jpg
ফ্রিজের দরজা খুলে কক্ষে ঢুকলেন, কিন্তু ভুলে গেলেন ফ্রিজ থেকে কী বের করবেন--ডোরওয়ে ইফেক্টের উদাহরণ। ছবি: সংগৃহীত

ম্যাকফাইডেন বলেন, 'গবেষণায় প্রাপ্ত ফল থেকে আমরা দেখছি, যত বেশি কাজ বা মাল্টিটাস্কিংয়ের সঙ্গে আমরা যুক্ত থাকব, দরজা পেরোতে পেরোতে তত বেশি ব্যাপার আমাদের মাথা থেকে বেরিয়ে যাবে। আমরা যখন অন্যান্য ব্যাপারে চিন্তামগ্ন থাকি, তখন মস্তিষ্কে এমনিতেও চাপ তৈরি হয়, ফলে অনেককিছু আর স্মৃতিতে থাকে না।'

একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আরেক নিউরো সায়েন্টিস্ট ড. স্যাম গিলবার্ট বলছেন, 'এই ডোরওয়ে ইফেক্ট বিশেষভাবে বোঝা যায় অন্ধকারে। বিশেষ করে নিচে নামার সময়। কারণ অন্ধকার নেমে এলে স্থানিক ভিন্নতার ব্যাপারটি আর আলাদাভাবে বোঝা যায় না।'

তিনি আরও বলেন, 'এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনের (ট্রেনে) পার্থক্যসূচক চিহ্ন খুব কমই থাকে। তাই সব স্টেশনকে একই মনে হয়। ফলে একটি নির্দিষ্ট স্টেশনে নেমে কী করার কথা তা আর মনে আসতে চায় না। নিজের উদ্দেশ্য ও স্মৃতি ধরে রাখা কঠিন হয়ে যায়।'

স্থানিক ভিন্নতার নেপথ্যের বিজ্ঞান

বেশকিছু গবেষণায় এই 'ডোরওয়ে ইফেক্ট'র বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এতে প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীকে এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে যাওয়ার সময় কয়েকটি জিনিসের নাম মনে রাখতে বলা হয়। ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় যাওয়া-আসার বিষয়টি যে মস্তিষ্ককে দ্বন্দ্বের ভেতর ফেলে দেয় তা স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব স্টার্লিং, ইউনিভার্সিটি অব সেইন্ট অ্যান্ড্রুস ও যুক্তরাষ্ট্রের নটর ডেম ইউনিভার্সিটিতে করা গবেষণায়ও দেখা গেছে।

এর কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে—যে প্রক্রিয়ায় মস্তিষ্ক স্মৃতি সংরক্ষণ করে, এটি সেই প্রক্রিয়ার নকল করে। এতে আমাদের অভিজ্ঞতা, ঘটনা ও আবেগকে স্থান ও কালের ভিন্নতার ওপর ভিত্তি করে আলাদা আলাদা খণ্ডে ভাগ করা হয়। নতুন কোনো স্টেশনে এসে পৌঁছালে এর অনুকরণ ঘটে। নতুন এই স্টেশনকে ঠিক আগের  স্টেশন ভেবে ভুল করে মস্তিষ্ক৷ স্মৃতিতে তুলে রাখা ঘটনাকে বাস্তব মনে করে ভুল করে। তাই আমরা যখন কোনো স্টেশনে পৌঁছাই, তখনো ট্রেনটি পুরোপুরি থেমেছে বলে মনে হয় না আমাদের কাছে। তাই নামতে গিয়েও স্থবির হয়ে আমরা দাঁড়িয়ে পড়ি।

এই ঘটনার আরেকটি সাধারণ উদাহরণ হলো এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে যাওয়া ও কী কারণে আসা হয়েছে, তা ভুলে যাওয়া। গিলবার্ট ব্যাখ্যা করেন, 'কোনো কিছু আমাদের স্মৃতিতে দাগ কাটলে বা উসকে দিলে মনে পড়ার ব্যাপারটি ঘটে। যেমন- কারো চেহারা দেখে আপনি তার নাম মনে করার চেষ্টা করতে পারেন, কিংবা আপনার নির্দিষ্ট কোনো স্মৃতি আরেকটি ঘটনাকে মনে করাতে পারে। যখন কোনো কিছু করার উদ্দেশ্য নিয়ে আপনি অন্য কোনো কক্ষে যান, তখন আপনাকে মনে করিয়ে দেয়ার সেই সূত্রটি থাকে না। কাজেই মনে করার ব্যাপারটি ভেতর থেকেই আসতে হয়। আর এটিই তখন প্রধান প্রতিবন্ধকতা হয়ে ওঠে।'

সবচেয়ে মোক্ষম উপায়

Black Panther
দরজা খুলে কক্ষে ঢুকলেন, কিন্তু ভুলে গেলেন কেন ঢুকেছেন--ডোরওয়ে ইফেক্টের উদাহরণ। ছবি: সংগৃহীত

ব্যাপারটা সচরাচর ঘটেই থাকে। তবে ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে পড়া যাত্রী কিংবা চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়া কেউ আপনার বিরক্তির কারণ হতে পারে। এক্ষেত্রে তাকে নম্রভাবে সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ করা উচিত বলে মনে করেন ড. গিলবার্ট।

তিনি বলেন, 'হয়তো আজ আমাদের পথরোধ করে কেউ আমাদের বিরক্তির কারণ হয়েছেন। আগামীকাল হয়তো আমরাই একই বিরক্তির কারণ হতে পারি।'

চারপাশ নিয়ে সচেতন থাকলেই এর প্রভাব প্রশমিত করা সম্ভব বলেও মনে করেন গিলবার্ট। এজন্য মনোসংযোগ ব্যাহত হয়, এমন ব্যাপারগুলো পরিহার করতে হবে। শব্দনিরোধক ইয়ারফোন ব্যবহার করা কিংবা এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে যাওয়ার সময় ভাবালু হয়ে থাকা থেকে বিরত থাকতে হবে।

আর বিশেষ করে কোনো কিছু একেবারেই মনে না পড়লে বারবার তা মনে করার চেষ্টা না করার পরামর্শ দেন এই নিউরো সায়েন্টিস্ট। বলেন, 'এর ফলে ব্যাপারটি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। মস্তিষ্ক যে স্মৃতি মুছে দিয়েছে, জোর করে তা মনে করতে চাইলে তা পাকাপাকি মুছে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।'

 

তথ্যসূত্র: ডেইলি টেলিগ্রাফ

গ্রন্থনা: মাহমুদ নেওয়াজ জয়