গুগল জিরো: সার্চ দুনিয়ায় নতুন সংকট না সম্ভাবনা?
কয়েক মাস আগেও গুগলে কিছু সার্চ করলে একের পর এক লিংক সামনে আসতো। খবরের সাইট, ব্লগ, বিশ্লেষণ—ব্যবহারকারী ক্লিক করে যেতেন তাদের পছন্দমতো ওয়েবসাইটে। কিন্তু এখন এই চিত্রটা বদলে গেছে। সার্চ করলেই সবার আগে ভেসে উঠছে 'এআই ওভারভিউ'। মানে গুগল নিজস্ব জেনারেটিভ এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) সার্চ-কোয়েরির ওপর ভিত্তি করে নিজেই একটি সংক্ষিপ্ত সারাংশ তৈরি করে দেয়। এতে ব্যবহারকারীর সুবিধা বাড়লেও তৈরি হয়েছে এক নতুন 'আতঙ্ক'—গুগল জিরো।
কী এই 'গুগল জিরো'? কেন এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা? কারা সবচেয়ে ঝুঁকিতে? এর প্রভাবে ভবিষ্যতে কী হতে পারে? চলুন, বিষয়গুলো বুঝে নেওয়া যাক।
সুবিধার আড়ালে নতুন সংকট
গুগলের এআই ওভারভিউ সার্চের শুরুতেই ব্যবহারকারীকে সরাসরি উত্তর দিয়ে দেয়। বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে তথ্য টেনে এনে এআই একটি ছোট সারাংশ তৈরি করে। নীচে কিছু লিংক দেখায় ঠিকই, কিন্তু ব্যবহারকারীদের বড় অংশ সেগুলোতে আর ক্লিক করে না।
গুগল নিজেই যখন সব উত্তর তৈরি করে দিচ্ছে, তখন অন্য থার্ড পার্টি সাইটগুলোতে যাওয়ার প্রয়োজন কমে যাচ্ছে। এতে ওয়েব ট্রাফিক এবং বিজ্ঞাপন থেকে আয়—দুটোই কমছে। আর এখানেই সমস্যার শুরু।
২০২৪ সালে দ্য ভার্জের প্রধান সম্পাদক নিলয় প্যাটেল 'গুগল জিরো' ধারণাটি দেন। তার মতে, যেদিন গুগল বাইরের ওয়েবসাইটে ট্রাফিক পাঠানো বন্ধ করবে, সেদিনই শুরু হবে 'গুগল জিরো যুগ'। অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, সেই যুগ আসলে ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।
কেন 'গুগল জিরো' নিয়ে উদ্বেগ?
ইন্টারনেট ব্যবহারে দীর্ঘদিন ধরেই মানুষ গুগল-নির্ভর। মানুষ সার্চ করে গুগলে, ব্রাউজ করে গুগল ক্রোমে, বিজ্ঞাপন চলে গুগলের অ্যাড নেটওয়ার্কে, ওয়েবসাইটে ট্রাফিক আসে গুগল সার্চ থেকে। সব মিলিয়ে দীর্ঘদিন থেকে ওয়েব দুনিয়া গুগলের দখলে। কিন্তু এই ব্যবস্থায় এখন বিঘ্ন ঘটাচ্ছে গুগলের এআই ওভারভিউ। আগে এটি ছিল এসইও (সার্চ জেনারেটিভ এক্সপেরিয়েন্স), যা এখন এআই জেনারেটেড উত্তর। পিউ রিসার্চ সেন্টারের একটি জরিপ বলছে, যারা এআই ওভারভিউয়ের দেওয়া সামারি (সারসংক্ষেপ) দেখেন, তাদের মধ্যে মাত্র ৮ শতাংশ মানুষ রেজাল্টের লিংকে ক্লিক করেন।
অন্যদিকে, যারা এআই সামারি দেখেন না, তাদের ক্ষেত্রে এই ক্লিক রেট প্রায় দ্বিগুণ, অর্থাৎ ১৫ শতাংশ। এছাড়া, এআই সামারিতে দেওয়া সোর্সগুলোর (উৎস) লিঙ্কে ক্লিক হয় মাত্র ১ শতাংশ ক্ষেত্রে।
নিলয় প্যাটেল বলছেন, গুগল একদিন যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে থার্ড-পার্টি ওয়েবসাইটে ট্রাফিক পাঠানোই হবে না, তাহলে তা করতে তাদের কোনো আইনি বা কারিগরি বাধা নেই। কারণ, এআই ওভারভিউ ইতোমধ্যে 'প্রথম উত্তর' হয়ে উঠেছে। ব্যবহারকারীরাও এই সারসংক্ষেপ উত্তরেই সন্তুষ্ট।
গুগল এআই-এর সক্ষমতাও দ্রুত বাড়ছে। সেই তুলনায় প্রতিদ্বন্দ্বী সার্চ ইঞ্জিনগুলো এখনও অনেক পিছিয়ে। এক কথায়, গুগল চাইলে তার সার্চ ইঞ্জিনকেই একমাত্র গন্তব্য বানিয়ে ফেলতে পারে। এর ফলে ব্যবহারকারী শুধু গুগলে থেকেই সবকিছু পাবে এবং অন্য সাইটে যাবে না, মানে 'জিরো ক্লিক' সার্চ বাড়ছে।
কারা বেশি ঝুঁকিতে?
ছোট ছোট ওয়েবসাইটগুলো ইতোমধ্যেই গুগলের এই নতুন ফিচারের কারণে সংকটে পড়েছে। হাউসফ্রেশ নামে ছোট একটি রিভিউ সাইট জানিয়েছে, 'গুগল আমাদের মতো ছোট ওয়েবসাইটগুলোর অস্তিত্বই সংকটে ফেলে দিয়েছে।' তাদের এআই সহজেই সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে দেয়। ফলে ভিজিটর আসে না।
এআই ওভারভিউ অনেক নিউজ সাইট, ব্লগ এবং অন্যান্য তথ্যভিত্তিক ওয়েবসাইটের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক গণমাধ্যম ইতোমধ্যেই ট্রাফিক অর্ধেকে নেমে যাওয়ার কথা জানিয়েছে।
ঝুঁকির বাইরে নেই ই-কমার্স ও অ্যাফিলিয়েট ব্র্যান্ডগুলোও। এআই ওভারভিউ অনেক সময় সরাসরি পণ্যের সাজেশন দিচ্ছে। ফলে মানুষ আর রিভিউ দেখতে যাচ্ছে না।
বিজ্ঞাপননির্ভর প্রকাশকরাও ঝামেলায় পড়ছেন। ট্রাফিক না থাকলে বিজ্ঞাপনও নেই। পুরোনো যেসব ওয়েবসাইট এসইও (সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাউজেশন) কৌশলে কাজ চালাতো, তাদের আয় দ্রুত কমছে।
কারা তুলনামূলক নিরাপদ?
যাদের কন্টেন্ট বিশেষায়িত জ্ঞানমূলক, তাদের ঝুঁকি কিছুটা কম। যেসব ব্র্যান্ড নিজেদের পরিচিতি তৈরি করতে পেরেছে, তারাও তাদের সাইটের ট্রাফিক কম হারাবেন।
এছাড়া, ভিডিও-ভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম ইউটিউব, টিকটক, শর্ট ভিডিওর ক্ষেত্রে ক্লিক ততটা কমবে না। কারণ এআই সামারি টেক্সট-ভিত্তিক (লিখিত) কনটেন্টগুলোকে বেশি প্রভাবিত করে।
গুগল কী বলছে?
গুগলের দাবি, এআই ওভারভিউ ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতাকে আরও উন্নত করছে। এর ফলে ওয়েবসাইটের ট্রাফিক বাড়বে। তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। অনেক মিডিয়া রিপোর্টে ভিউ অর্ধেকেরও কম হয়ে গেছে।
ভবিষ্যতে কী হবে?
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ওয়েব আরও বেশি কেন্দ্রায়িত হয়ে এককেন্দ্রিক প্ল্যাটফর্ম গুগলের ওপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। ওয়েবসেইটে ক্লিক না হওয়ায় প্রকাশকদের আয় কমে যাবে। বিজ্ঞাপন-নির্ভর আয়ে টিকে থাকে সংবাদমাধ্যম, ব্লগ, রিভিউ সাইট বা গবেষণাভিত্তিক পোর্টালগুলোর আয় আরও কমে যাবে।
ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর ট্রাফিক কমে যাবে। আগে পণ্যের রিভিউ দেখতে মানুষ বিভিন্ন অ্যাফিলিয়েট ওয়েবসাইটে যেত, সেই ট্রাফিক এআই-ওভারভিউ খেয়ে ফেলবে। এতে অ্যাফিলিয়েট মার্কেটার, রিভিউ-ভিত্তিক ওয়েবসাইট ও কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের আয় কমবে।
ব্র্যান্ডগুলোকে বিজ্ঞাপনে আরও বেশি টাকা ঢালতে হতে পারে, কারণ গুগলের ভেতরেই প্রতিযোগিতা বাড়বে।
গুগল সার্চের ট্রাফিকের ওপর আর আগের মতো নির্ভর করা যাবে না। ফলে পেইড সাবস্ক্রিপশন, মেম্বারশিপ, নন-অ্যাড রেভিনিউ, বিশেষায়িত কনটেন্ট, পডকাস্ট—এই ধরনের বিকল্প আয়মুখী মডেল তৈরির প্রবণতা বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।