কেন আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা কমিয়ে দিচ্ছেন?

By স্টার অনলাইন ডেস্ক
25 October 2025, 05:18 AM

গত দুই দশকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যবহারকারীদের অনেক বেশি পোস্ট ও শেয়ার করতে দেখা গেছে। তবে এখন সেই প্রবণতা ধীরে ধীরে কমে আসছে। 

নতুন এক জরিপে দেখা গেছে, ব্যবহারকারীদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ গত বছরের তুলনায় এখন অনেক কম পোস্ট করেন। এই প্রবণতা বিশেষ করে প্রাপ্তবয়স্ক জেনজিদের মধ্যে আরও বেশি স্পষ্ট।

লেখক কাইল চায়কা নিউ ইয়র্কারে এক প্রবন্ধে লেখেন, সমাজ এখন এমন এক পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে, যেখানে মানুষ আগের মতো আর অনলাইনে নিজের ব্যক্তিগত জীবন শেয়ার করতে আগ্রহী নয়। তিনি এই প্রবণতাকে বলেছেন 'পোস্টিং জিরো'।

অনেকের সোশ্যাল ফিডেও এই নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বন্ধুর বেড়ানোর ছবি বা সহকর্মীর সন্তানের ছবির বিপরীতে এখন টাইমলাইনে বেশি ভেসে বেড়ায় অসংখ্য ব্র্যান্ড ও ইনফ্লুয়েন্সারের পোস্ট। এসব পোস্টে তারা নতুন পণ্য প্রচার করছে বা সাম্প্রতিক কোনো ট্রেন্ড নিয়ে আলোচনা করছে।

একসময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছিল বাস্তব জীবনের এক প্রতিফলন। তা কিছুটা অসম্পূর্ণ হলেও ছিল প্রাণবন্ত। তবে এখন তা যেন শুধু কনটেন্টে পরিণত হয়েছে।

এর কিছুটা কারণ প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজেদের পরিবর্তন। টিকটক ও ইনস্টাগ্রামে এখন অসীম সংখ্যক ভিডিও ভেসে বেড়ায়। এই মাধ্যমগুলো গড়ে তুলেছে অদ্ভুতভাবে শক্তিশালী অ্যালগরিদম, যা ব্যবহারকারীদের পছন্দ অনুযায়ী ভিডিও সাজিয়ে তাদের সামনে এনে দেয়।

মাস কয়েক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পরিবর্তিত পরিমণ্ডল নিয়ে আলোচনা করেন লেখক কাইল চায়কা এবং বিবিসির বিশেষ প্রতিবেদক ক্যাটি কে। চায়কা নিউ ইয়র্কারের স্টাফ রাইটার এবং তার সর্বশেষ বই 'ফিল্টারওয়ার্ল্ড: হাউ অ্যালগরিদমস ফ্ল্যাটেনড কালচার'।

ক্যাটি কে বলছিলেন, যখন আমি আমার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ফিড দেখি, তখন সেটি ভরা থাকে বিজ্ঞাপন এবং সুন্দর সুন্দর বাড়ির ছবিতে। কিন্তু এসব আমি কখনো কিনব না কিংবা সেখানে আমার যাওয়াও সম্ভব নয়। আমি ঠিক মনে করতে পারছি না, শেষবার কখন আমি কোনো বন্ধুর পোস্ট দেখেছি। যদি এখন আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসার কারণ কয়েক বছর আগের মতো না থাকে, তাহলে সামনে কী হবে?

কাইল চায়কা উত্তরে বলেন, আমি মনে করি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন আগের মতো সামাজিক নয়। এখন এটি বেশি হয়ে গেছে শুধু বিজ্ঞাপন বা আকর্ষণীয় কনটেন্ট দেখার জায়গা। এটি জীবনধারা ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বেশি সম্পর্কিত, শুধু আপনার চারপাশে কী ঘটছে বা আপনি আপনার বন্ধু ও পরিবারের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক রাখছেন তা নিয়ে নয়। আমার কাছে মনে হয়, এতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মূল উদ্দেশ্য অনেকটাই হারিয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, যদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে আর জুড়ে না থাকে এবং মানুষ পোস্ট করতে আগ্রহ না দেখায়, তখন তা টেলিভিশনের মতো হয়ে যায়। তখন শুধু ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন, ফাস্ট ফ্যাশন, বাড়ি এবং হোটেলের বিজ্ঞাপনই থাকে। আর তা আর সেই প্রাকৃতিক, জীবন্ত এবং বিস্তারিত কনটেন্ট নয়, যার সঙ্গে আমরা আগে অভ্যস্ত ছিলাম।

চায়কা মনে করেন, সামাজিক মাধ্যম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল গ্রাহক হলো বিজ্ঞাপনদাতারা। তাই যতক্ষণ ব্যবহারকারীরা সক্রিয় থাকেন, তাদের ব্যবসা চলে। ধীরে ধীরে মানুষের তৈরি পোস্টের জায়গা নেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় তৈরি কনটেন্ট। মেটা এরইমধ্যেই ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে এ ধরনের কনটেন্ট বাড়াচ্ছে। এর সংখ্যা অনেক, খরচও কম, কিন্তু অর্থহীন।

ক্যাটি জানতে চান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কি এমন ব্যবহারকারীদের সংখ্যা কমে যাবে, যারা আগে বন্ধুদের ছুটির যাত্রা কিংবা সকালের নাস্তার ছবি-ভিডিও দেখার জন্যই সেখানে যেতেন?

চায়কা বলেন, আমি মনে করি তা সম্ভব। ধীরে ধীরে কমে আসছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, আগের চেয়ে কম মানুষ টিকটকে পোস্ট করছে। কিন্তু এই প্ল্যাটফর্মগুলো, বিশেষ করে ইনস্টাগ্রাম লক্ষ্য করেছে যে আমাদের ব্যক্তিগত শেয়ারিং এখন বেশি হচ্ছে সরাসরি মেসেজে।

তিনি বলেন, আমাদের সত্যিই একটি অনলাইন সামাজিক নেটওয়ার্কের প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে যেসব সামাজিক নেটওয়ার্ক আছে, তারা সেটা দেওয়ার দিকে মনোযোগ দেয় না। তাই আমার মনে হয় নতুন জায়গা বা নতুন অ্যাপ তৈরি হবে, যা এই চাহিদা পূরণ করবে—হয়তো আরও উন্নত হোয়াটসঅ্যাপ বা বন্ধুদের গ্রুপ চ্যাট ভালোভাবে পরিচালনার কোনো সিস্টেম। আমরা আসলে অনলাইনে আরও ব্যক্তিগত এবং ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত হওয়ার দিকে এগোচ্ছি।

ক্যাটি মনে করেন, তার প্রজন্ম ভেবেছিল আজকের তরুণরা গোপনীয়তা নিয়ে ভাবেন না এবং সব কিছু অনলাইনে শেয়ার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, অনেক তরুণ বেশি ব্যক্তিগত ও নির্বাচিত গ্রুপে শেয়ার করতে পছন্দ করছেন, যেন পুরো বিশ্ব তাদের ছোটখাটো বিষয় না জানতে পারে।

'আমি মনে করি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিয়ম বদলে গেছে। আগে পোস্ট করলে অনেক মানুষ আপনার পোস্ট দেখত। কিন্তু এখন এটা এমন একটা চক্র হয়ে গেছে যা আপনার পুরো জীবনকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাই, যদি আপনি ইনফ্লুয়েন্সার বা পেশাদার পোস্টার না হন, তাহলে পোস্ট করার সুবিধা কম আর ঝুঁকি বেশি। তাই বরং বন্ধুদের সঙ্গে সরাসরি মেসেজ করা ভালো।'

ক্যাটি জানতে চান, 'আপনি কি মনে করেন আমরা এমন এক জগতে পৌঁছাব যেখানে সাধারণ মানুষ আমাদের মতো আর পোস্ট করবে না?'

কাইল বলেন, আমি মনে করি তাই। ভাবনার চেয়ে দ্রুত এটি হচ্ছে। কারণ এখন আর পোস্ট করার পেছনে কোনো প্রেরণা নেই। যদি পোস্ট করার মাধ্যমে কোনো মনোযোগ না পাই, বন্ধুদের কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়, আর এত সব অপ্রাসঙ্গিক কনটেন্টের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়— তাহলে কেন সেলফি বা সকালের নাস্তার ছবি বা ভিডিও পোস্ট করব?

সম্ভবত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছিল এক ধরনের অস্বাভাবিকতা বা বিকল্প পথ। 'সাধারণ মানুষ যেন তাদের জীবনধারা প্রকাশ্যে শেয়ার করে'— এই ধারণা শুরু থেকেই কিছুটা ভুল ছিল। এখন আমরা এর ক্ষতি বুঝতে পারছি এবং ধীরে ধীরে আমাদের ব্যবহার বদলাচ্ছি, বলেন তিনি।