বাংলাদেশে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গবেষণাকেন্দ্রিক ইসলামি আলোচনা প্রয়োজন

মাহফুজ আনাম
মাহফুজ আনাম
12 December 2025, 16:31 PM

বাংলাদেশের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা, যেটা কিনা জ্ঞানের নিকশিত আধারগুলোর অন্যতম, সেই পদার্থবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক সম্প্রতি রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্মবার্ষিকীতে তাকে 'মুরতাদ' ও 'কাফির' বলে উল্লেখ করেছেন বলে জানা গেছে। বাঙালি মুসলিম নারী শিক্ষার এই অগ্রদূত, বেগম রোকেয়া (১৮৮০–১৯৩২) নামেই সমধিক পরিচিত।

তিনি দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষত বাংলার মুসলিম নারীর জীবনে আমূল পরিবর্তন এনেছেন। নারীদের শিক্ষিত, জ্ঞানবান ও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পারঙ্গম করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। যখন নিরক্ষরতা, শোষণ ও দারিদ্র্য নারীর জীবন গ্রাস করে রেখেছিল, সেই সময়ে তার কাজ বাঙালি মুসলিম নারীদের বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত পরিসর বৈপ্লবিকভাবে বদলে দেয়।

১৯১৬ সালে তিনি পাটনায় সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে কলকাতায় স্থানান্তরিত হয় এবং মুসলিম মেয়েদের আধুনিক শিক্ষার অন্যতম প্রাচীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। মেয়েদের ইংরেজি ও বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ করে দিতে তিনি নিরলস পরিশ্রম করেছেন।

১৯০৫ সালে প্রকাশিত 'সুলতানার স্বপ্ন'-তে তিনি কল্পনা করেছিলেন এমন এক জগৎ, যেখানে নেতৃত্ব দেবে নারী এবং পুরুষ তাদের অনুসরণ করবে। তাই বলে তিনি যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে উল্টে নারীশাসিত সমাজ প্রবর্তনের পক্ষে ছিলেন তা মোটেও নয়। সেটা তার উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি কেবল পুরুষদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছিলেন, নারীরা কী ভয়াবহ দমন-পীড়নের মধ্যে বসবাস করে।

'স্ত্রীজাতির অবনতি' ও অন্যান্য প্রবন্ধে তিনি নারীর বঞ্চিত বুদ্ধিবৃত্তিক জগতকে তুলে ধরেন। তিনি নারীর আইনি ও সামাজিক অধিকারের পক্ষে কথা বলেছেন, বাল্যবিয়ের কঠোর বিরোধিতা করেছেন এবং তার সক্রিয়তা, সমাজে নারী-পুরুষের ভূমিকা নিয়ে সবাইকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। তিনি নারী সংগঠন 'আঞ্জুমান-এ-খাওয়াতিন-ই-ইসলাম' প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ইসলাম যুক্তিবাদ ও নারীর ক্ষমতায়ন সমর্থন করে।

প্রশ্ন জাগে, এত কিছুর পরও কেন একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক তাকে 'কাফির' ও 'মুরতাদ' বললেন? আমি সচেতনভাবেই ওই শিক্ষকের বা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিচয় উল্লেখ করছি না। কারণ, এই আলোচনাটি একেবারেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক করতে চাইনি।

প্রতিটি লেখক, গবেষক বা সামাজিক সংস্কারক বিভিন্ন মত ও সমালোচনার মুখোমুখি হতে পারেন। এটাই স্বাভাবিক। ইতিহাসজুড়েই বুদ্ধিজীবী, সংস্কারক ও জননেতাদের যেতে হয়েছে নানা আলোচনা, প্রশ্ন ও ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে। কিন্তু, অনন্য সাধারণ বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যক্তিত্বের সমালোচনা বা তাকে আক্রমণ করতে হলে সেটা কি তথ্য, যুক্তি ও প্রমাণের ভিত্তিই করা উচিত না? ইসলাম ধর্মে যেসব শব্দের গভীর তাৎপর্য আছে, সেগুলো কি ইচ্ছেমতো কারও দিকে এভাবে ছুঁড়ে দেওয়া যায়? এভাবে ভর্ৎসনা করা যায়?

পদার্থবিজ্ঞানের ওই শিক্ষক আরেকটি ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, 'একজন মুসলমান কখনো এমন অবস্থান গ্রহণ করতে পারে না যার কারণে তার ঈমান সন্দেহে পতিত হয়, তার উপর কুফরে লিপ্ত হওয়ার অপবাদ তৈরি হয়। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, নারীবাদ ও লালনবাদ এগুলোর কথা বলছি।' অর্থাৎ, এ দেশের করদাতাদের টাকায় বেতন পাওয়া এই শিক্ষক মনে করেন, 'গণতন্ত্র' হলো 'কুফরি'র অংশ এবং বেগম রোকেয়া 'মুরতাদ' ও 'কাফির'! তরুণ প্রজন্মকে তিনি কী শিক্ষা দিচ্ছেন, সেই প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

বেগম রোকেয়া ছিলেন গভীরভাবে ধার্মিক ও ইসলামের মূল্যবোধের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল। তিনি কখনো তার প্রিয় ধর্মের বিরুদ্ধে সামান্যতম কিছু লেখেননি। ১৯৩২ সালে তার মৃত্যুর পর এত বছরেও কোনো ইসলামি গবেষক বা বিদ্বান তার বিরুদ্ধে এমন অসম্মানজনক শব্দ ব্যবহার করেননি। বরং, একজন মুসলিম নারী হিসেবে সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং একই ধর্মের অনুসারী নারীদের উন্নত জীবন গড়াকে তিনি নিজের দায়িত্ব বলেই মনে করতেন।

আমি ইসলামি পণ্ডিত নই, কোনো ক্ষেত্রেই পণ্ডিত নই। কেবল একজন একনিষ্ঠ শিক্ষার্থী। এই প্রবন্ধটি লিখতে গিয়ে ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করেছি এবং কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। তার আলোকেই কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য তুলে ধরছি।

বিশ্বজুড়ে বহু খ্যাতিমান মুসলিম নারী গবেষক আছেন, যারা ইসলাম ও নারীর মৌলিক বিষয়ে বহু বছর ধরে গবেষণা করেছেন—যা আধুনিক সমাজ গঠনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা হয়তো তাদের কাজ সম্পর্কে খুব বেশি জানি না। উদাহরণ হিসেবে পাকিস্তানের আসমা বারলাসের কথা বলা যায়, যিনি তার যুগান্তকারী 'বিলিভিং উইমেন ইন ইসলাম' বইয়ে দেখিয়েছেন, কোরআনের বাণী আল্লাহ প্রদত্ত, কিন্তু এর অনেক তাফসিরে অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষতান্ত্রিকতা দেখা গেছে। তিনি 'ন্যায়'কে ইসলামের সকল মূল্যবোধের ভিত্তি হিসেবে তুলে ধরেন।

মরক্কোর ফাতিমা মারনিসি হাদিস নিয়ে গভীর গবেষণা করেছেন এবং ইসলামে নারীর অবস্থান বিষয়ে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি নতুনভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে কিছু ঐতিহাসিক সময়ে রাজনৈতিক ব্যাখ্যা প্রাধান্য পেয়েছে। মিশরের লেইলা আহমেদ তার বই 'উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার ইন ইসলাম' বইয়ে তৎকালীন সমাজে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর উৎপত্তি বিশ্লেষণ করেছেন। মিশরের উমাইমা আবু-বকর দেখিয়েছেন, ইসলাম কীভাবে নারীসহ সব মানুষের সাম্যকে সমর্থন করে।

সৌদি আরবের হাতুন আল-ফাসসি ইতিহাস ও কোরআন বিশ্লেষণের মাধ্যমে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করছেন। ইবনে আরাবীর দর্শনকে নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে পুনরায় তুলে ধরেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার সাদিয়া শাইখ—যেখানে আধ্যাত্মিকতা, নৈতিকতা ও নারীবাদ পরস্পরের সঙ্গে মিশে গেছে।

ইসলামি শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাস শুরু হয় আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে। তিনি সপ্তম শতকে নারীর জন্য অভূতপূর্ব অধিকারের ঘোষণা দেন। উত্তরাধিকার, বিবাহে সম্মতি, সম্পত্তির মালিকানা ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীর অধিকার তিনি ঘোষণা করেন। হজরত আয়েশা (রা.), হজরত ফাতিমা (রা.)-সহ অনেক নারী হাদিস বর্ণনা করেছেন এবং মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা ব্যাখ্যা করার কর্তৃত্বও তাদের ছিল।

তবে অষ্টম থেকে দশম শতকের মধ্যে তাফসির রচনা ক্রমেই পুরুষ নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। সেখানে পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ধর্মীয় ব্যাখ্যায় নারীর কণ্ঠস্বর উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়—যা মহানবী (সা.)-এর সময়ের থেকে কিছু ক্ষেত্রে ভিন্ন।

বহু পরে উনিশ শতকে জামালুদ্দিন আফগানি, মুহাম্মদ আবদুহ ও কাসিম আমীন যুক্তি দেন, ইসলাম নারীর অধিকারকে সমর্থন করে—যা পরবর্তী প্রজন্মের নারী-অধিকারকেন্দ্রিক ইসলামি গবেষণার ভিত্তি স্থাপন করে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইন্দোনেশিয়ার মুসলিম নারী গবেষকরা লিঙ্গ, ধর্ম ও সামাজিক সংস্কার নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখছেন। তারা বলেন, আল-কোরআন আল্লাহ প্রদত্ত গ্রন্থ, কিন্তু এর ব্যাখ্যা দীর্ঘদিন পুরুষদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যা নারীদের জন্য নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। তারা ইজতিহাদের পক্ষে যুক্তি দেন এবং বলেন, ইসলাম নারীর অধিকারের পক্ষে।

ইন্দোনেশিয়ার বিশিষ্ট দুই গবেষক সিতি মুসদাহ মুলিয়া ও নুর রোফিয়াহ লিঙ্গসমতায় ইসলামের ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনাকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ করেছেন। তারা তৃণমূল পর্যায়ে মুসলিম নারীদের লিঙ্গসংবেদনশীল ইসলামি ধারণায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার আন্দোলনকে শক্তিশালী করেছেন। স্থানীয় সংস্কৃতি ও ইসলামি মূল্যবোধের ভিত্তিতে তারা এক বিশেষ ধরনের ইসলামি নারীবাদ গড়ে তুলেছেন। ইন্দোনেশিয়ার নারীবাদী আন্দোলনের দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—

১. লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠায় ধর্ম ব্যাখ্যার সংস্কার।

২. ইসলামের নৈতিক ভিত্তিতে নারীবাদকে দাঁড় করিয়ে জনপরিসরের আলোচনা ও নীতিনির্ধারণে প্রভাব সৃষ্টি।

বাংলাদেশে আজ ধর্ম নিয়ে আলোচনা আগের চেয়ে অনেক বেশি হয়। কয়েকটি দল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করছে ও জনসমর্থন চাইছে। একইসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানান ধর্মীয় বিষয় আলোচিত হলেও গবেষণাসমৃদ্ধ ও বিশ্বমানের ইসলামি বয়ানের অনুপস্থিতিতে ভুল তথ্য ও ভ্রান্ত ব্যাখ্যার ঝুঁকি প্রতীয়মান।

এটা মোটেই অত্যুক্তি হবে না যে, দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম নারী গবেষকরা অনেকাংশেই বেগম রোকেয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরাধিকারের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন। পাকিস্তানের রিফাত হাসান, ফারহাত হাশমি, কুদসিয়া মির্জা ও হিনা আজম; ইরানের জিবা মির-হোসাইনি; ভারতের শায়েস্তা ইকরামুল্লাহ; বাংলাদেশের মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা—তারা সবাই সামাজিক চিন্তায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

আজ ইসলামকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে অপব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুল তথ্য ও বিকৃত ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে—যা ইসলামের আসল মূল্যবোধের পরিচায়ক নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক বক্তা ও তাদের মনগড়া ব্যাখ্যাভিত্তিক বক্তব্য এবং ধর্মকে হাতিয়ার করে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় নিমগ্ন রাজনৈতিক কর্মী—এ সবই এখন নতুন বাস্তবতা।

ফলে প্রকৃত ইসলামি গবেষণা এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি জরুরি। অপ্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি আমাদের বিপদে ফেলছে। কারণ, আমরা আমাদের ধর্মকে ভালোবাসি এবং সেটাই অনুসরণ করতে চাই। তাই এর যেকোনো ধরনের অপব্যবহার ও বিকৃতি বিপজ্জনক। গবেষণাভিত্তিক, যুক্তিনির্ভর, বিশ্বমানের ইসলামি বিদ্যার চর্চা আমাদের জন্য অতীব জরুরি।

লেখার শুরুতে যার কথা বলা হয়েছে, এমন শিক্ষকদের আমরা কখনোই আমাদের ধর্মবোধ গঠনের দায়িত্ব দিতে পারি না।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনূদিত