‘মা এখন আর কষ্ট নাই’

By স্টার অনলাইন রিপোর্ট
14 December 2025, 14:57 PM
UPDATED 14 December 2025, 22:40 PM

'গতকালই ছেলের সঙ্গে কথা হয়। ডিউটির কথা জানতে চাইলে বলে, "মা এখন আর কষ্ট নাই, ডিউটি কম।" আমাকে ভালো থাকতে বলে ছেলে নিজেই চলে গেলো।'

কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন সুদানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত করপোরাল মাসুদ রানার মা মর্জিনা বেগম।

সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘের ঘাঁটিতে গতকাল এক সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৬ শান্তিরক্ষী। আহত হন আরও ৮ জন।

নিহতদের একজন করপোরাল মাসুদ রানার (৩০) গ্রামের বাড়ি নাটোরের লালপুর উপজেলার বোয়ালিয়াপাড়ায়। 

স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে শোকে স্তব্ধ স্ত্রী আসমাউল হুসনা। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গতকাল বিকেলে (মাসুদের সঙ্গে) কথা হলো। বলেছিল, আধা ঘণ্টা রেস্ট নিয়ে ডিউটিতে যাওয়ার আগে ফোন দেবে। তারপর আমি আর তাকে ফোনে পাইনি। সেই আধাঘণ্টা এখনো শেষ হচ্ছে না।'

পরিবারের সদস্যরা জানান, মাসুদ রানা ২০০৬ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। গত ৭ নভেম্বর তিনি শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দিতে সুদান যান।

বাড়িতে তার রয়েছে ৮ বছর বয়সী মেয়ে।

'আমাকে বলেছিলেন সাবধানে থাকতে'

সুদানে নিহত ৬ বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীর আরেকজন গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার ছোট ভগবানপুরের সবুজ মিয়া (২৭)। তার মৃত্যুর খবর শুনে গ্রামের বাড়িতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

সবুজের চাচাতো ভাই পলাশ মিয়া ডেইলি স্টারকে জানান, সবুজ ২০১০ সালে সেনাবাহিনীতে লন্ড্রি কর্মচারী হিসেবে যোগ দেন। ২০২৩ সালে বিয়ে করেছেন সবুজ। বাবা হামিদুল ইসলাম মারা গেছেন ২০০২ সালে।

চাকরি করে ছোট বোনের বিয়ে দিয়েছেন সবুজ। বাড়িতে মা ও স্ত্রী নুপুর আক্তার। মাত্র এক মাস আগে গত ৭ নভেম্বর সুদানে শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দেন সবুজ।

সবুজের স্ত্রী নূপুর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তার সঙ্গে গতকাল ৩টার সময় শেষ কথা হয়। আমাকে বলেছিলেন যেখানেই থাকি যেন সাবধানে থাকি। আজ তিনি নিজেই চলে গেলেন।'

'তার পড়াশোনা কম, তাই ইচ্ছে ছিল আমাকে পড়াশোনা করাবেন, চাকরি করাবেন। যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলেন মিশন থেকে ফিরে বাড়ি-ঘর ঠিক করবেন,' বলেন নূপুর।
মরদেহ দ্রুত দেশে আনতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন সবুজের পরিবার।

কিশোরগঞ্জের জাহাঙ্গীর আলম

সুদানে নিহত বাংলাদেশের ৬ শান্তিরক্ষীর একজন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের (৩০) গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায়।

নিহত জাহাঙ্গীর তারাকান্দি গ্রামের কৃষক হজরত আলীর ছেলে। বাড়িতে বাবা-মার সঙ্গে থাকেন স্ত্রী ও তিন বছর বয়সী সন্তান। 

জাহাঙ্গীরের বাবা হজরত আলী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শনিবার রাত ১২টার দিকে সৌদি আরবে থাকা বড় ভাইয়ের কাছ থেকে প্রথম জাহাঙ্গীরের খবর পাই। আজ সকালে রংপুর ক্যান্টমেন্টের এক কর্মকর্তা মোবাইলে মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন।'

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, অভাবের সংসারে ভাগ্য বদলের আশায় ২০১৪ সালে সেনাবাহিনীতে মেস ওয়েটার হিসেবে যোগ দেন মো. জাহাঙ্গীর আলম। গত ৭ নভেম্বর শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিতে সুদানে যান তিনি। 

মরদেহ দ্রুত ফেরত আনার পাশাপাশি সরকারি সহায়তার দাবি জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরের পরিবার।

'আব্বা আমি ডিউটিতে যাব'

আফ্রিকার দেশ সুদানের আবেই এলাকায় সন্ত্রাসী হামলায় নিহত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিক শামীম রেজার গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী জেলার কালুখালী উপজেলার হোগলাডাঙ্গী গ্রামে চলছে শোকের মাতম। 

ওই গ্রামের আলম ফকির ও চম্পা খাতুনের বড় ছেলে শামীম রেজা (২৮)। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে শামীম সবার বড়। দেড় বছর আগে তিনি বিয়ে করেন।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে যোগ দিয়েছিলেন শামীম। গত ৭ নভেম্বর সুদানে যান তিনি।

আজ বিকেলে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আহাজারি করছেন বাবা আলম ফকির। স্বজন ও প্রতিবেশীরা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। বাড়ির ভেতরে কান্নাকাটি করছেন শামীমের মা ও স্ত্রীসহ আত্মীয়-স্বজনেরা।

নিহত শামীমের দাদা মো. সমদাল হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গতকাল রাত ১২টার দিকে আমরা তার নিহতের খবর পাই। পরে জানতে পারি ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে আগামী পরশু তাদের মরদেহ দেশে আসতে পারে।'

বাবা আলম ফকির বলেন, 'আমি কৃষিকাজ করে শামীমকে লেখাপড়া শিখিয়েছিলাম। শুক্রবার শেষবারের মতো ছেলের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা হয়। বললাম "তোমার চোখ ফুলে গেছে।" সে বলল "ঘুমায় ছিলাম বাবা"।'

'ছেলে বলল, "আব্বা তুমি ভালো থাকো। আমি ডিউটিতে যাব।" ওই ছিল শেষ কথা। ডিউটিতে গিয়ে আর ফিরল না আমার ছেলেটা,' বলেন তিনি।

আজ বিকেল ৪টার দিকে রাজবাড়ী সদর সেনা ক্যাম্পের একটি দল শামীম রেজার গ্রামের বাড়িতে তার পরিবারের খোঁজখবর নেয়।

'শান্ত আর নেই'

নিহতদের মধ্যে শান্ত মন্ডলের (২৬) গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার সদর ইউনিয়নের সাটমাধাই ডারারপাড় গ্রামে। তিনি ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে যোগ দেন। সবশেষ তিনি বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ছিলেন। গত ৭ নভেম্বর তিনি শান্তিরক্ষী মিশনে সুদানে যান।

তার বাবা মৃত নুর ইসলাম মন্ডলও সেনা সদস্য ছিলেন। শান্তর বড় ভাই ল্যান্স করপোরাল সোহাগ মন্ডল বর্তমানে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে দায়িত্ব পালন করছেন।

আজ রোববার বিকেলে তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শোকে স্তব্ধ মা সাহেরা বেগম বিছানায় বসা। বড় ভাই সোহাগ মন্ডল কান্নাকাটি করছেন। 

সোহাগ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শান্ত এক বছর আগে বিয়ে করে। তার স্ত্রী এখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। শনিবার সন্ধ্যায় ভিডিও কলে আমাদের সবার সঙ্গে কথা বলেছিল। রাত সাড়ে ১০টার দিকে খবর পাই ওদের ক্যাম্পে হামলা হয়েছে। পরে জানতে পারি, শান্ত আর নেই। আমরা এখন শুধু তার মরদেহের অপেক্ষায় আছি। বাবার কবরের পাশে তাকে দাফন করতে চাই।'

'আমার ছেলে শহীদের মর্যাদা পেয়েছে'

সন্ত্রাসী হামলায় শহীদ আরেক শান্তিরক্ষী সৈনিক মো. মমিনুল ইসলাম (৩৮) কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নের পারুলেরপাড় গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। 

পরিবারে বাবা-মা, স্ত্রী ও দুই কন্যা সন্তান রয়েছে। বড় মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে, ছোট মেয়ের বয়স চার বছর।

পরিবারের লোকজন জানান, ৩৩ দিন আগে মমিনুল শান্তিরক্ষী মিশনে সুদানে যান। শনিবার বিকেলে ভিডিও কলে পরিবারের সঙ্গে শেষবারের মতো কথা হয় তার। রাত আনুমানিক ১১টার দিকে পরিবারের কাছে আসে তার মৃত্যুর খবর।

মমিনুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, কান্নায় ভেঙে পড়েছেন স্ত্রী ও মা। প্রতিবেশী ও স্বজনরা তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

মমিনুলের বাবা আব্দুল করিম বলেন, 'আমার ছেলে খুব ভালো মানুষ ছিল। এলাকার সবাই তাকে ভালোবাসত। আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন বলেই হয়তো শহীদের মর্যাদা দিয়েছেন। এখন শুধু তার লাশের অপেক্ষায় আছি।'

গতকালের ওই ঘটনায় আহত হয়েছেন–কুষ্টিয়ার লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার খালেকুজজামান, দিনাজপুরের সার্জেন্ট মো. মোস্তাকিম হোসেন, ঢাকার করপোরাল আফরোজা পারভীন ইতি, বরগুনার ল্যান্স করপোরাল মহিবুল ইসলাম, কুডিগ্রামের সৈনিক মো. মেজবাউল কবির, রংপুরের সৈনিক উম্মে হানী আক্তার, মানিকগঞ্জের সৈনিক চুমকি আক্তার ও নোয়াখালীর সৈনিক মো. মানাজির আহসান।

আইএসপিআর জানায়, কাদুগলি লজিস্টিকস বেসে গতকাল স্থানীয় সময় বিকেল ৩টা ৪০ থেকে ৩টা ৫০ মিনিটের মধ্যে এই হামলা চালানো হয়। একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী এই ড্রোন হামলা চালায়। এ সময় শান্তিরক্ষীরা বেসে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন দ্য ডেইলি স্টারের বগুড়া, লালমনিরহাট, ফরিদপুর ও কিশোরগঞ্জ সংবাদদাতা)