দেশে প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতায় আলোচিত কিছু ঘটনা, বিচার ও আইনের সীমাবদ্ধতা

ফাহিমা কানিজ লাভা
ফাহিমা কানিজ লাভা
3 December 2025, 11:26 AM
UPDATED 3 December 2025, 18:27 PM

সাম্প্রতিক সময়ে পাবনার ঈশ্বরদীতে ঘটে গেছে এক অমানবিক ঘটনা। সদ্য জন্ম নেওয়া আটটি কুকুরছানাকে বস্তাবন্দী করে পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে মারা হয়েছে। তবে প্রাণীদের প্রতি এমন নিষ্ঠুরতা এবারই প্রথম নয়। প্রতিনিয়তই এমন নৃশংসতার ঘটনা ঘটছে দেশের নানাপ্রান্তে। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা গণমাধ্যমে আলোচনা হলেই কেবল তা জানা যায়।

প্রাণী নির্যাতন ও হত্যার ঘটনায় দেশের প্রচলিত আইনে বিচারের সুযোগ আছে। তবে যে ব্যাপকতায় প্রাণী নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে সেই তুলনায় খুব অল্প কিছু ক্ষেত্রেই বিচার পর্যন্ত পৌছানো যাচ্ছে।

বাংলাদেশে প্রাণীর সঙ্গে বর্বরতার কয়েকটি আলোচিত ঘটনা:

রামপুরায় কুকুর পিটিয়ে মাটিচাপা

২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর ঢাকার রামপুরার বাগিচারটেক কল্যাণ সমিতির একজন নিরাপত্তাকর্মী ছিদ্দিক মিয়া দুই মাদি কুকুরসহ ১৪টি বাচ্চা কুকুরকে রড দিয়ে পেটায়। পরে মাদি কুকুর দুটিকে অর্ধমৃত অবস্থায় পা বেঁধে এবং বাচ্চাগুলোকে বস্তায় ভরে বাড়ির পাশে মাটিচাপা দিলে প্রাণীগুলো মারা যায়।

ওই ঘটনার কয়েকদিন পর রামপুরা থানায় পিপল ফর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন রাকিবুল হক এমিল ১৯২০ সালের প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা আইনের ৭ ধারায় মামলা করেন। অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় পরের বছর আদালত অভিযুক্ত ছিদ্দিক মিয়াকে ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং ২০০ টাকা জরিমানা করেন। তবে আসামি পলাতক থাকায় সাজা কার্যকর করা যায়নি।

জাপান গার্ডেন সিটিতে কুকুর-বিড়ালদের বিষ প্রয়োগ

২০২৪ সালের ২২ নভেম্বর ঢাকার মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটি হাউজিং সোসাইটিতে ১০টি কুকুর ও একটি বিড়াল মারা যায়। পরে জানা যায়, ওই হাউজিং সোসাইটির সভাপতি ও সেক্রেটারির পরিকল্পনায় কয়েকজন মিলে খাবারে বিষ মিশিয়ে প্রাণীগুলোকে মেরে ফেলেন। বিষক্রিয়ায় প্রাণীগুলো দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে রক্ত বমি করে মারা যায়।

এ ঘটনায় চারটি প্রাণী সংগঠনের পক্ষ থেকে রাকিবুল হক এমিল ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে এমিল জানান, জাপান গার্ডেন সিটির ঘটনায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। পিবিআই কদিন আগে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে, এখন আদালতে জমা হওয়ার অপেক্ষায় আছে।

ঈশ্বরদীতে পুকুরে ফেলে কুকুরছানা হত্যা

পাবনার ঈশ্বরদীতে আটটি কুকুরছানাকে বস্তাবন্দী করে পুকুরে ডুবিয়ে হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে সমালোচনা হচ্ছে। সপ্তাহখানেক আগে নিশি রহমান নামে এক নারীর বাসার আঙিনায় একটি মা কুকুর ওই ছানাগুলোকে জন্ম দেয়। গত সোমবার হঠাৎ মা কুকুরটিকে ছোটাছুটি ও আর্তনাদ করতে দেখা যায়। পরে জানা যায়, ছানাগুলোকে পুকুরে ফেলে হত্যা করেছেন নিশি রহমান।

ঈশ্বরদী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আকলিমা খাতুন ঈশ্বরদী থানায় 'প্রাণিকল্যাণ আইন, ২০১৯'–এর ৭ ধারায় তার বিরুদ্ধে মামলা করেন।

কবুতর হত্যায় বিড়ালের ফাঁসি

বাড়ির কবুতর মেরে ফেলত বিড়াল। তাই 'অপরাধী' বিড়ালকে রশিতে ঝুলিয়ে ফাঁসি দিয়ে মারা হয়েছিল ২০১৯ সালে। এরপর সেই হত্যার ভিডিও আপলোড করে ছাড়া হয় ফেসবুকেও।

নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার মদনগঞ্জের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেনের ছেলে রাব্বি হোসেন এ নৃশংস ঘটনা ঘটায়। সেই ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। পরে এএলবি অ্যানিম্যাল শেল্টার বাংলাদেশের এক সদস্য মামলা করেন। 

বগুড়ার আদমদীঘিতে বিড়াল জবাই

রান্নাঘর থেকে খাবার চুরি করে খায় বলে এক ক্ষিপ্ত নারী মাঠ থেকে 'চোর' বিড়ালকে ধরে এনে বটি দিয়ে জবাই করেন। এরপর বিড়ালের বুক চিরে নাড়ি-ভুঁড়ি বের করে বাড়ির পাশে একটি ধান খেতে ফেলে দেয়। আদমদীঘির নশরতপুর ইউনিয়নের দত্তবাড়ীয়া গুচ্ছ গ্রামের বুলবুলি বেগম এমন কাণ্ড ঘটান।

পরে প্রতিবেশী আরেক নারী সেই বিড়ালটির মরদেহ এনে বরফ দিয়ে সংরক্ষণ করে রাখেন এবং পুলিশে খবর দেন। বিষয়টি জানাজানির পর বাংলাদেশ অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে একজন থানায় লিখিত অভিযোগ করেন।

চসিকের কুকুর নিধন

সিটি করপোরেশনগুলো অনেক বছর ধরেই পথকুকুর নিধন করছিল। তবে ২০১৪ সালে একটি বেসরকারি সংস্থার রিটের পরিপ্রেক্ষিতে কুকুর নিধন বন্ধের নির্দেশ দেন আদালত। সেই আদেশকে অমান্য করেই ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে কুকুর নিধনে নামে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)।

এমন ঘটনায় প্রাণীদের কল্যাণে কাজ করা সংগঠনগুলো ও সচেতন মহল প্রতিবাদে নামে। তারা নিধন না করে কুকুরকে বন্ধ্যাকরণ ও জলাতঙ্ক টিকা দেওয়ার প্রস্তাব করেন।

আইনের সীমাবদ্ধতা

২০১৯ সালের নতুন প্রাণিকল্যাণ আইনে প্রাণীদের নিধন বা অপসারণ করা যাবে না বলে বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া পুরনো ১৯২০ সালের 'দ্য ক্রুয়েলটি টু অ্যানিমেলস অ্যাক্ট' বাতিল করে প্রণয়ন করা এই আইনে শাস্তি ও জরিমানার পরিমাণও বাড়ানো হয়েছে।

তবে নতুন আইনে শুধুমাত্র প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বা ভেটেরিনারি সার্জনকে মামলা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বেওয়ারিশ প্রাণী হত্যায় কর্তৃপক্ষ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রাথমিক তদন্ত শেষে লিখিত অভিযোগ দেন। লিখিত অভিযোগ থাকলেই শুধু আদালত মামলা গ্রহণ করে।

এর বাইরে যদি কারো পোষা প্রাণী মারা যায়, তবে মালিক হিসেবে তিনি সরাসরি মামলা করতে পারেন। কিন্তু বেওয়ারিশ প্রাণীদের ক্ষেত্রে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে (রাষ্ট্রের পক্ষে) বাদী হয়ে মামলা লড়তে হয়।

এ ব্যাপারে রাকিবুল হক এমিল বলেন, 'কর্তৃপক্ষের লিখিত অভিযোগসহ থানায় একটি জিডি করতে হয়। থানা সরাসরি মামলা না নিয়ে জিডির কপি আদালতে পাঠায়। এই প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ, ফলে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মামলা রুজু হয় না।'

প্রাণিকল্যাণ আইনের বেশিরভাগ ধারা অ-আমলযোগ্য ও জামিনযোগ্য। এটিকেও এই আইনের একটি বড় দুর্বলতা বলে উল্লেখ করেন এমিল। তিনি বলেন, 'অ-আমলযোগ্য হওয়ায় মামলার কার্যক্রম আদালতে না পৌঁছানো পর্যন্ত এবং বিচারকের নির্দেশ না আসা পর্যন্ত পুলিশ আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারে না।'

এছাড়া মামলা আদালতে গেলে আসামি সহজেই আগাম জামিন নিতে পারেন। মামলাও বছরের পর বছর চলতে থাকে। ফলে দ্রুত ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে বলে জানান এমিল।

তবে জনমতের চাপে পুলিশ অনেক ক্ষেত্রে প্রাণিকল্যাণ আইনে মামলা না করে পেনাল কোড, ১৮৬০ (দণ্ডবিধি)-এর ৪২৯ ধারায় মামলা করেন। এতে পুলিশ তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পায়।

প্রাণীর প্রতি কোন ধরনের আচরণকে নিষ্ঠুর হিসেবে বিবেচনা করা হবে তা-ও বলা হয়েছে নতুন আইনে। পোষ্য ও বেওয়ারিশ প্রাণীদের নির্যাতন বা হত্যায় ছয়মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড থেকে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

২০১৫ সাল থেকে প্রাণীদের কল্যাণে কাজ করে আসা পিপল ফর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের ফাউন্ডার চেয়ারম্যান রাকিবুল হক এমিল তার চাওয়ার কথাও জানান।

তিনি বলেন, 'সরকারকে আসলে খুব সিরিয়াসলি ভাবতে হবে। সরকারের যেসব স্টেকহোল্ডাররা আছে, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, আইন বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সবাইকে এ ব্যাপারে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। কারণ অ্যানিমেল ক্রুয়েলটি (প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা) তো আসলে শুধু এনিমেল ক্রুয়েলটি না। এটা পুরো জাতির মানসিক স্বাস্থ্য, তার শিক্ষা এবং মূল্যবোধের উন্নতির বিষয়। এই জায়গায় যদি রাষ্ট্র গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা না করে, তাহলে আমরা হাজারও মামলা করেও মানসিকতা পরিবর্তন করতে পারব না। রাষ্ট্র যেন প্রাণীদের কল্যাণকে নীতি হিসেবে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করে এবং সামাজিক পরিবর্তনে পদক্ষেপ নেয়—আমরা এটাই চাই।'