বসু বাহিনী: ডাকাত থেকে মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী
বিজয়ের ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও মুক্তিযুদ্ধের বহু ঘটনাই এখনো প্রচারের আলোয় আসেনি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে এমনই বীরত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে দ্য ডেইলি স্টার। বিজয়ের মাসে ১২ পর্বের মধ্যে দ্বিতীয় পর্বে আজ থাকছে কিশোরগঞ্জের হাওরের 'ডাকাত থেকে গেরিলা বাহিনীর রূপান্তরের' বীরত্বগাথা।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে কিশোরগঞ্জের হাওরের দুর্ধর্ষ এক ডাকাতের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল একটি গেরিলা বাহিনী। আবদুল মোতালিব বসুর নেতৃত্বে গড়ে উঠা বাহিনীটি পরিচিত ছিল 'বসু বাহিনী' নামে। শুরুতে বসুর নিজস্ব অনুসারীদের নিয়ে বাহিনীটি গঠিত হলেও পরে এতে যোগ দেন অন্তত ৩০০ মুক্তিযোদ্ধা। কিশোরগঞ্জ ও হবিগঞ্জের ৩টি জেলার ৯টি উপজেলাজুড়ে ছিল এই বাহিনীর বিস্তৃতি।
বসু বাহিনীর বীরত্বগাথার কথা জাহাঙ্গীর আলম জাহানের 'কিশোরগঞ্জ জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস' এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। প্রতিবেদনটির জন্য চলতি বছরের মে মাসে কিশোরগঞ্জ ও হবিগঞ্জের পাঁচটি উপজেলা সরেজমিন পরিদর্শন করেন দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদক। এ সময় বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা, আশ্রয়দাতা ও গ্রামবাসীসহ অন্তত ২৫ জনের সঙ্গে কথা হয়।
হাওরাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাওরে 'ভর্সা ডাকাত' নামে পরিচিত ছিলেন বসু। একাত্তরের শুরুতে কয়েকটি হত্যা মামলার আসামি হয়ে কিশোরগঞ্জ কারাগারে বন্দী ছিলেন তিনি। মার্চ মাসের শেষের দিকে ছাত্র-জনতা কারাগার ভাঙলে বসু বের হয়ে নিজ গ্রাম নিকলী উপজেলার গুরুইতে চলে যান। যুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজস্ব অনুসারী ও স্থানীয় গ্রামবাসীদের সংগঠিত করতে শুরু করেন।
১৮ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা বাজিতপুর দখল করলে বাজিতপুর সংগ্রাম কমিটির সদস্য অধ্যাপক ইয়াকুব মিয়া বসুকে তার বাহিনীতে যোগ দিতে অনুরোধ করেন। শুরু হয় বসু বাহিনীর যাত্রা। বাহিনীর সদস্য মুক্তিযোদ্ধা আবদুল ওহাব বলেন, ৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমরা গুরুই ইউনিয়ন পরিষদে ক্যাম্প স্থাপন করি।
প্রথমে মুক্তিবাহিনীর অনেকেই বসুর উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। ৩ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর শফিউল্লাহ ইয়াকুব মিয়াকে এক চিঠিতে সতর্ক করেছিলেন, 'প্রফেসর সাহেব, আপনি ডাকাত নিয়ে যুদ্ধে নেমেছেন। যেকোনো সময় মারা পড়বেন।' জবাবে ইয়াকুব মিয়া লিখেছিলেন, 'বসু পূর্বে ডাকাত হলেও বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কাজ করছেন।' বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা সমু মিয়া (৮০) বলেন, ভারত থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকবার বসুকে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন, প্রতিবারই ইয়াকুব স্যার তাদের বুঝিয়ে ফেরত পাঠান।
মে মাসে বসু বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা নরসিংদীর বেলাবোর উজলাবর গ্রামের প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রশিক্ষণ নেন। সেখান থেকে অস্ত্র নিয়ে তারা গুরুইয়ের পাশের হিলচিয়া গ্রামের বাদল পালের বাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করেন। এ সময় তারা হাওরের কুখ্যাত দুই পাকিস্তানি দালালকে হত্যা করেন। মে মাসের শেষের দিকে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে আগ্রহী শতাধিক লোককে গুরুই মসজিদে জড়ো করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের নির্দেশ দেন বসু।
বসু বাহিনীর উল্লেখযোগ্য অপারেশনগুলোর মধ্যে ছিল ২৫ জুন বাজিতপুর থানা আক্রমণ, ২০ জুলাই নিকলী থানা অপারেশন, ২৫ জুলাই শিয়ালদী শ্মশানঘাটের যুদ্ধ, ৩০ জুলাই মানিকখালী ডুইলজা ব্রিজের যুদ্ধ ও বাজিতপুর ন্যাশনাল ব্যাংক অপারেশন।
বাজিতপুর থানা আক্রমণে ১৫০ জন রাজাকার ও পুলিশ সদস্যকে পরাস্ত করেন মুক্তিযোদ্ধারা। ২৫ জুন ভোরে বসু বাহিনীর শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা থানা ঘেরাও করে আক্রমণ চালান। সাত ঘণ্টার যুদ্ধের পর গুলি শেষ হয়ে এলে রাজাকার ও পুলিশ সদস্যরা সুড়ঙ্গ দিয়ে পালিয়ে ওসির বাসায় আশ্রয় নেয়। পরে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আটক করেন।
অপারেশনের অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হেকিম (৮২) বলেন, 'গুলি শেষ হওয়ায় টিকতে না পেরে ওরা থানার ভিতরের সুড়ঙ্গ দিয়ে ওসির বাসায় গিয়ে লুকিয়েছিল। আমরা তাদের আটক করে বাঁশমহল এলাকায় নিয়ে যাই।'
নির্যাতনকারী রাজাকার ও পুলিশদের ধরা পড়ার খবর শুনে হাজার হাজার মানুষ বাজারে জড়ো হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে রাজাকার ও পুলিশদের একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে বলে জানান আবদুল হেকিম।
সমসাময়িক সময়ে পাকিস্তানিদের তৎপরতা বন্ধে কটিয়াদীর গচিহাটা ও মানিকখালী স্টেশনের মধ্যবর্তীতে একটি রেল ব্রিজ উড়িয়ে দেন বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা।
জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে বসুর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের স্ত্রী ও সন্তানদের নিকলী থেকে ভারতে পৌঁছে দিতে রওনা হন। সুনামগঞ্জের রাটরী হাওরে পৌঁছালে রাজাকাররা হামলা চালায়। বসু বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল ওহাব বলেন, যুদ্ধে ৮ রাজাকার নিহত হয় এবং একজনকে আটক করা হয়।
৬ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের একটি দল গুরুই গ্রামে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করলে বসু বাহিনীর ২০-২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা পাল্টা আক্রমণ চালান। এতে পাঁচ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। গোলাবারুদ ফুরিয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা হিলচিয়ায় ফিরে যান। তখন রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা গুরুই বাজারে ২৫ জন গ্রামবাসীকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে।
বসু বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ আলী বলেন, পরে ৪০-৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা পুনরায় হামলা চালালে ১৫-১৬ জন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়। এ যুদ্ধের পর গুরুই ও হিলচিয়াসহ আশপাশের এলাকা মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়।
বসু বাহিনীর যুদ্ধগুলোর মধ্যে আরও ছিল বগামারা ব্রিজ অপারেশন, নিকলী থানায় অপারেশন, মদন থানা আক্রমণ, ছাতিরচরে পাকিস্তানিদের ট্রলার আক্রমন, সরারচর ট্রেন অপারেশন, অষ্টগ্রামে রাজাকার নিধন, কিশোরগঞ্জ শহর রাজাকার মুক্তকরণ প্রভৃতি।
বসু বাহিনীর সবচেয়ে সফল যুদ্ধগুলোর একটি ছিল নিকলী থানার যুদ্ধ। ১৪ অক্টোবর শুরু হওয়া এই যুদ্ধে ৩০ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং চারজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
১৪ অক্টোবর রিয়াজুল বাচ্চুর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা অপারেশনের আগে রেকি করতে গিয়ে রাজাকারদের দ্বারা ঘেরাও হন। তখন খবর পেয়ে বসু বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের উপর আক্রমণ চালালে রাজাকারেরা সরে যায়।
এসময় চার কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে নিকলী থানায় অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন বসু। এক স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা জানতে পারেন থানা ও তৎসংলগ্ন এলাকায় মোট ১৫১টি বাঙ্কার ও ১৫৭ জন সেনা, পুলিশ, ও আলবদর সদস্য রয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা আবদুল ওহাব বলেন, '১৫-১৬ অক্টোবর বসুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা চতুর্দিক থেকে থানা ঘেরাও করি। ১৭ অক্টোবর থেকে ১৫১টি বাঙ্কারের মধ্যে ১৫০টি বাঙ্কার চিহ্নিত করে আক্রমণ চালাই। তিন দিনব্যাপী চলা যুদ্ধে শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধা মেঘু মিয়া, আবদুল মালেক মালু ও নান্টু মিয়া।'
১৯ অক্টোবর পাকিস্তানি সেনারা পুরোপুরি পর্যদুস্ত হয়ে পড়ে। এদিন দুপুরে নিকলী হাসপাতালের দক্ষিণ পাশের কবরস্থানে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাকে দেখতে পেয়ে অচিহ্নিত একমাত্র বাঙ্কারটিও চিহ্নিত করে ফেলেন মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান। এসময় তিনি দৌড় দিয়ে জানাতে গেলে আলবদর সদস্যরা গুলি করে। শহীদ হন মতি। বাকি মুক্তিযোদ্ধারা তখন আক্রমণ চালালে ৩০টিরও বেশি লাশ ফেলে পাক সেনারা সুনামগঞ্জে পালিয়ে যায়।
ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তানি সেনারা কিশোরগঞ্জ থেকে পালিয়ে ময়মনসিংহে চলে গেলেও রাজাকার ও আলবদরদের জন্য বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ রেখে যায়। ১১ ডিসেম্বর কালিয়াচাপড়া সুগার মিলের রাজাকার ঘাঁটিতে আক্রমণ চালান বসু বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। তখন রাজাকারেরা পার্শ্ববর্তী ওয়াপদা অফিসে আশ্রয় নেয়। সকল রাজাকার ওয়াপদা অফিসে আশ্রয় নিয়েছে ধারনা করে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের অবস্থান ছেড়ে উঠতেই অতর্কিত আক্রমণ চালায় রাজাকারেরা। এসময় বসু বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম গেন্দু শহীদ হন। পাল্টা আক্রমণ গড়ে তুলেন বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। দুইপক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধে শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম ও জসিম উদ্দীন।
১২ ডিসেম্বর অন্যান্য অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কিশোরগঞ্জ শহর ঘেরাও করে বসু বাহিনী। এই অপারেশনে অংশ নেন আরেকটি মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপের অধিনায়ক রফিক মাস্টার। তিনি বলেন, 'টানা চারদিনের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সোমরাজ, আনোয়ার ও নিজামউদ্দিন শহীদ হন। নিহত হয় ৫০ জনেরও বেশী রাজাকার। ১৭ ডিসেম্বর দুপুরে রাজাকার ও আলবদর সদস্যরা আত্মসমর্পণ করে।'
১৯৭২ সালের ২৬ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ মহকুমা প্রশাসকের কাছে অস্ত্র জমা দেন বসু বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা।
সখিনা বেগম: রাঁধুনি থেকে গুপ্তচর
বসু বাহিনীতে নারীদেরও অংশগ্রহণ ছিল। তাদেরই একজন সখিনা বেগম। তিনি প্রথমে ক্যাম্পে রাঁধুনির কাজ করতেন, পরে গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ পান। পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের হাতে দুবার ধরা পড়লেও কৌশলে পালিয়ে আসেন তিনি। নিকলী থানা যুদ্ধে ভাগনে মতিউর রহমান শহীদ হলে প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধে অংশ নেন সখিনা। বাজিতপুরে আটক পাঁচ রাজাকারকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন তিনি। সখিনার সেই দা বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। গত জুন মাসে ৯৩ বছর বয়সে মারা যান তিনি।
খুনের শিকার বসু, দুরবস্থায় পরিবার
যুদ্ধে অবদানের জন্য সাধারণ ক্ষমা পান বসু। ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন তিনি। কিন্তু দলের একটি পক্ষ তা মেনে নিতে পারেনি। ১৯৭২ সালের শেষের দিকে বসুকে গুলি করে হত্যা করে লাশ ঘোড়াউত্রা নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়।
বসুর মৃত্যুর পর তার জায়গা-জমি সব বেদখল হয়ে যায়। বর্তমানে টিনের ছোট্ট একটি ঘরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তার অসুস্থ স্ত্রী ও মেয়ে রহিমা খাতুন। ছেলে নজরুল ইসলাম চট্টগ্রামে শ্রমিকের কাজ করেন। রহিমা জানান, অর্থের অভাবে অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা করাতে পারছেন না। ভাই মুক্তিযোদ্ধা ভাতার টাকা এককালীন তুলে নেওয়ায় সে ভাতাও আর পান না তারা।
বসু বাহিনী নিয়ে দীর্ঘ ১১ বছর গবেষণা করেছেন গবেষক সুখেন দত্ত। তিনি বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধ এক কুখ্যাত ডাকাতকে দেশমাতৃকার সেবকে পরিণত করেছিল। হাওরের যুদ্ধে বসু বাহিনীর অবদান ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।'
