সাইবার আইনের নামে অধিকার খর্ব নয়, নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা উচিত

নাজিবা বাশার
নাজিবা বাশার
27 November 2025, 13:57 PM

প্রতি বছর ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত জাতিসংঘ বিশ্বব্যাপী সরকারগুলোকে শুধু স্লোগানে সীমাবদ্ধ না থেকে নারীর প্রতি সহিংসতা মোকাবিলার আহ্বান জানায়। এ বছর জাতিসংঘের 'ইউএনআইটিই' তাদের প্রচারণার ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে এক নতুন ক্ষেত্রকে—ইন্টারনেট।

'নারী ও কন্যাশিশুদের ওপর ডিজিটাল সহিংসতা বন্ধে একতাবদ্ধ হই' স্লোগান নির্ধারণ করে জাতিসংঘের এই সংস্থা সতর্ক করেছে, প্রযুক্তি এখন নারীদের অনুসরণ, ভয় দেখানো, অপমান করা, হেনস্তা করার বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, বিশ্বের বহু দেশের মতোই বাংলাদেশেও এমন নির্যাতন ঠেকাতে নির্দিষ্ট আইনগত সুরক্ষা এখনো অপর্যাপ্ত।

গত এক দশকে বাংলাদেশ লিঙ্গভিত্তিক ও ডিজিটাল সহিংসতা মোকাবিলায় বেশ কিছু আইন তৈরি করেছে। ২০১০ সালের গার্হস্থ্য সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন শারীরিক, মানসিক, যৌন ও আর্থিক সহিংসতাকে আইনের ভাষায় সংজ্ঞায়িত করায় যথার্থভাবেই একটি মাইলফলক ছিল। ২০১২ সালের পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন—যা ছিল প্রথম বিশেষায়িত আইন—সম্মতি ছাড়া ছবি বা ভিডিও ধারণ কিংবা ছড়িয়ে নারীদের লাঞ্ছিত করার বিরুদ্ধে কিছু প্রতিকারও দেয়।

কিন্তু মাঠের অভিজ্ঞতা অন্য গল্প বলে। বিভিন্ন গবেষণা দেখা যায়, এসব আইনের প্রয়োগ দুর্বল হওয়ায় সহিংসতাকে এখনো পারিবারিক বিষয় মনে করে উপেক্ষা করা হয়, প্রথম সারির দায়িত্বশীলরা যথাযথ প্রশিক্ষণ পাননি, আর জনসাধারণের সচেতনতা এখনো কম।

সবচেয়ে বিতর্কিত ছিল সাইবার নিরাপত্তা আইন। পুরনো আইসিটি আইনের মতোই ৫৭ ধারায় অপরাধের অস্পষ্ট সংজ্ঞা ও ক্ষমতা প্রয়োগের অতিরিক্ত বিস্তৃতির কারণে নির্যাতনের পথ খুলে দিয়েছিল। এরপর এলো ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন—যা আরও কড়া, আরও দমনমূলক। সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ও সাধারণ মানুষের অনেকেই অনলাইনে মত প্রকাশ করলেও স্বাধীনতা হরণের শিকার হয়েছেন।

চাপে পড়ে তৎকালীন সরকার জানায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তুলে দিয়ে সাইবার নিরাপত্তা আইন আনা হবে। কিন্তু পর্যালোচনায় দেখা গেল—একই ধারা, একই মনোভাব, একই নিয়ন্ত্রণ—শুধু নাম পাল্টেছে।

এরপর অন্তর্বর্তী সরকার আইনটি বাতিল করে সাইবার নিরাপত্তা অধ্যাদেশ জারি করেছে এবং ইন্টারনেটকে নাগরিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিকল্পনা জানিয়েছে। বিতর্কিত ধারাগুলো পুনর্বিবেচনার কথাও বলেছে।

পরিবর্তনের এই প্রচেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বড় শিক্ষা হলো—নিরাপত্তার নামে সাইবার আইন বহু বছর ধরে এমনভাবে প্রয়োগ হয়েছে যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

ডিজিটাল সহিংসতার শিকার নারী ও কন্যাশিশুদের জন্য সাইবার আইন পরিবর্তনের এই অভিজ্ঞতা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। একজন নারী যখন দেখেন যে মতবিরোধ বা সমালোচনার জন্য মানুষকে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে—তখন তিনি আর এই আইনে ন্যায়বিচারের আশা করেন না। যখন সুরক্ষার ভাষা হয়ে ওঠে নজরদারি আর নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার, তখন রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা ক্ষয় হতে থাকে।

ইউএনআইটিইর প্রচারাভিযান বাংলাদেশকে একটি নতুন পথ দেখাচ্ছে। এর লক্ষ্য—অনলাইন হেনস্তা, অপমান, ভয় দেখানো, গোপনীয়তা লঙ্ঘনের মতো ডিজিটাল সহিংসতা সরাসরি মোকাবিলা করা এবং নিরাপদ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়ভিত্তিক ভার্চুয়াল পরিবেশ তৈরি করা।

জাতিসংঘের ভাষায়, সরকার, প্রযুক্তি কোম্পানি ও সমাজকে ডিজিটাল সহিংসতা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

কিন্তু শুধু আইনের নাম বদলে নারী ও কন্যাদের জন্য নিরাপদ ডিজিটাল ভবিষ্যৎ তৈরি হবে না। প্রযুক্তি-সহায়ক লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতাকে আইনে স্পষ্ট সংজ্ঞায়ন করতে হবে।

ইউএন ওমেন এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা সাইবারস্টকিং, ছবি ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেল, অনুমতি ছাড়া ঘনিষ্ঠ ছবি বা ভিডিও ছড়ানো, এআই দিয়ে তৈরি ডিপফেকসহ সব ধরনের অনলাইন হয়রানিকে প্রযুক্তি-সহায়ক লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন, যার প্রভাব বাস্তব জীবনেও পড়ে।

অনেক দেশ এরই মধ্যে স্পষ্ট আইনগত পথ তৈরি করেছে। যুক্তরাজ্য ২০১৫ সালেই 'রিভেঞ্জ পর্ণ'কে অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে; আদালত নিয়মিত কারাদণ্ড দিয়েছে। ২০২৩ সালে ডিপফেকও আইনগতভাবে অপরাধ হিসেবে যোগ করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়াও অনুমতি ছাড়া নারীর ছবি তোলা, অন্তরঙ্গ ছবি বা ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া এবং এসব ব্যবহার করে হুমকি দেওয়াকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করছে এবং এর জন্য মোটা অংকের জরিমানার পাশাপাশি কারাদণ্ড দিচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়াও ডিজিটাল যৌন অপরাধে বিশেষায়িত আদালত চালু করে কঠোর শাস্তি দিচ্ছে।

এই দেশগুলো কঠোর হতে পারছে কারণ অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট, অনিয়মের সুযোগ কম।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সমস্যাটি এখানেই। গোপনে তোলা ছবি বা ভিডিও ছড়ানোর মতো অপরাধ এখনো সাইবার নিরাপত্তা আইন কিংবা পর্নোগ্রাফি আইনে বিচার করা হয়। কিন্তু কোনো আইনে 'ইমেজ-বেইজড অ্যাবিউজ' নামে পৃথক অপরাধ নেই। ডিপফেক ও এআই দিয়ে তৈরি ডিপফেকের বিষয়টি কোনো আইনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই। ফলে মামলা চলে মানহানি, অশ্লীলতা বা তথ্য বিকৃতির মতো সাধারণ ধারায়—যা আসল ক্ষতির প্রকৃত প্রকৃতি বোঝায় না।

এগুলো উদাহরণ মাত্র।

তার ওপর, কেবল অপরাধীকে শাস্তি দিলেই সুরক্ষা নিশ্চিত হয় না।

ভুক্তভোগীর দরকার—

  • নিরাপদ অভিযোগ জানানোর পথ
  • সহজ ও বোধগম্য হটলাইন
  • পুলিশ ও প্রসিকিউটরদের ডিজিটাল প্রমাণে প্রশিক্ষণ
  • ভিকটিম-ব্লেমিং বন্ধ করা
  • নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কনটেন্ট সরানোর বাধ্যবাধকতা

এগুলো ছাড়া আইন কেবল কাগুজে হয়েই থাকবে।

ভবিষ্যতে সাইবার আইন মানবাধিকার-ভিত্তিক হতে হবে। সেখানে ইচ্ছা হলেই গ্রেপ্তার ও নজরদারি রোধে সুরক্ষা রাখতে হবে, অহিংস মত প্রকাশকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা বন্ধ করতে হবে।

কারাদণ্ড হওয়া উচিত কেবল গুরুতর অপরাধে—বিশ্বাসযোগ্য হুমকি, ব্ল্যাকমেল, শিশু যৌন নির্যাতন, দীর্ঘমেয়াদি স্টকিং ইত্যাদি।

প্রতিরোধ পক্ষে এই প্রশ্নটি তোলার কোনো সুযোগই নেই যে বাংলাদেশে ডিজিটাল সহিংসতা আছে কি না। এ দেশের নারী, কন্যাশিশু, তারকা, সাধারণ মানুষ অনলাইনে বছরের পর বছর ধরে এই দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করছেন।

তবে, যে প্রশ্নটি তোলার সুযোগ আছে তা হলো—আমরা কী ধরনের সাইবার স্পেস চাই? ইউএনআইটিই যে ভবিষ্যতের কথা বলছে সেখানে একজন কিশোরী আতঙ্ক ছাড়াই ফেক ছবি নিয়ে রিপোর্ট করতে পারবে, একজন নারী বিনাসংকচে তার হয়রানির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে, আর সমালোচকরা সত্য বলতে কোনো আইনের ভয়ে ভীত হবে না।

বাংলাদেশ কোন পথ বেছে নেবে—এই প্রতিরোধ পক্ষে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।