আসামের ভক্তদের জন্য ভূরুঙ্গামারীতে বাড়ি তৈরি করেছিলেন মওলানা ভাসানী

এস দিলীপ রায়
এস দিলীপ রায়
18 November 2025, 05:07 AM
UPDATED 18 November 2025, 11:22 AM

ভারতের আসাম সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম কামাত আংগারিয়া। কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার প্রত্যন্ত এই গ্রামেই আসাম থেকে আসা ভক্তদের জন্য জমি কিনে বাড়ি ও দরবার হল নির্মাণ করেছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।

সম্প্রতি এই প্রতিবেদক কামাত আংগারিয়া গ্রামে যান। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামটির চার কিলোমিটার দূরত্বেই আসাম সীমান্তের অবস্থান। কামাত আংগারিয়া গ্রামটি বর্তমানে ভাসানীপাড়া নামে পরিচিত। 

১৯৪৮ সালে এই গ্রামে যান মওলানা ভাসানী। সহচর মুসা ফকিরের সহায়তায় গ্রামের বাসিন্দাদের কাছ থেকে ৩৫ বিঘা জমি কিনে নেন তিনি। কেনা জমির প্রায় ১২ বিঘা জমিতে তিনি গড়ে তোলেন বসতভিটা ও দরবার হল।

kurigram_maulana_vasani_home-02.jpg

মূলত আসাম থেকে আসা ভক্ত ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ ও রাজনৈতিক আলোচনার জন্যই এই বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন ভাসানী। সেই সময়ে গ্রামটিতে বিশুদ্ধ পানির অভাব ছিল। সুপেয় পানির অভাব পূরণ করতে নির্মিত দরবার হলের পাশে ভক্তদের নিয়ে পুকুর খনন করেন তিনি। 

১৯৪৯ সালে ভাসানীর দ্বিতীয় স্ত্রী হামিদা খানম ও  তিন সন্তান আবু বক্কর খান, আনোয়ারা খানম ও মনোয়ারা খানম এই গ্রামে বসবাস শুরু করেন। তার পরিবারের সদস্যরা এখনো সেখানেই বসবাস করছেন। ১৯৬৩ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান হামিদা খানম। 

মওলানা ভাসানী নিয়মিতই সেই বাড়িতে আসতেন। বাড়ির দরবার হলে বসে ভক্তদের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনায় অংশ নিতেন তিনি। এ ছাড়া এই বাড়িতে বসেই বিভিন্ন আন্দোলন, সংগ্রামের রূপরেখা তৈরি করেন ভাসানী। তাকে একনজর দেখতে আসামের বিভিন্ন অঞ্চল  থেকে হাজারো মানুষ এই বাড়িতে আসত। 

kurigram_maulana_vasani_home-04.jpg

পরে ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনের ফলে আসামের বহু ভূমিহীন পরিবার ভাসানীপাড়া গ্রামে এসে আশ্রয় নেয়। ভূরুঙ্গামারীর বাসিন্দাদের মধ্যে মানবিকতা, দূরদর্শিতা আর নেতৃত্বের গুণে মওলানা ভাসানী কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।

ভাসানীর এই বাড়িতে দেশ-বিদেশের বহু বরেণ্য ব্যক্তি এসেছেন। বাড়িটিতে তার ব্যবহৃত নানা আসবাবপত্র ও তৈজসপত্র থাকলেও যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে সেগুলো পড়ে আছে জরাজীর্ণ অবস্থায়। ঐতিহাসিক এই বাড়ি ইতিহাসের অন্যতম স্মারক হয়ে উঠলেও এখনো সেখানে গড়ে ওঠেনি কোনো জাদুঘর, পাঠাগার।

বর্তমানে এই বাড়িতে বসবাস করছেন ভাসানীর নাতি মনিরুজ্জামান খান ভাসানী (৪৮)। ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'দাদার প্রিয় এই বসতভিটা আমি বহু কষ্টে আগলে রেখেছি।  কিন্তু সামর্থ্যের অভাবে দাদার ব্যবহৃত জিনিসপত্র; বিশেষ করে খাট, চেয়ার— এগুলো ঠিকমতো সংরক্ষণ করতে পারছি না। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আমাদের বাড়িতে আসেন। খাট–চেয়ার ছুঁয়ে দেখেন, অনেকে চুম্বনও করেন। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে এগুলো নষ্ট হতে যাচ্ছে।' 

kurigram_maulana_vasani_home-03.jpg

গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা মোহর আলী (৭৮) বলেন, 'ভাসানী সাহেব ছিলেন দূরদর্শী মানুষ ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন নেতা। তিনি গ্রামে এলেই হাজার হাজার মানুষ ভিড় করতো। তার মুখের প্রতিটি কথা ছিল জীবনের জন্য উপদেশ।'

ভাসানীর সান্নিধ্য পাওয়া গ্রামবাসী নিজাম উদ্দিন (৮০) বলেন, 'আমি কাছে থেকে মওলানা ভাসানীকে দেখেছিলাম। তিনি ছিলেন দূরদর্শী মানুষ। তার সংস্পর্শে যিনিই এসেছেন, তিনিই তার ভক্ত হয়েছেন। আজও মওলানা ভাসানীর কথাগুলো উপদেশের মতো মনে হয়, যা আমাদের জীবনের জন্য এক মহান আদর্শ।'

গ্রামে বেড়াতে আসা দর্শনার্থী, ভক্ত ও স্থানীয় গ্রামবাসীরা বলেন, ভাসানীপাড়ার ভাসানীর এই ঐতিহাসিক বাড়ি, দরবার হল, পুকুর ও তার ব্যবহৃত সব আসবাবপত্র ইতিহাসের স্মারক। ঐতিহাসিক এই বাড়িটিতে ভাসানীর নামে কমপ্লেক্স, জাদুঘর ও পাঠাগার নির্মাণ করলে নতুন প্রজন্ম তার জীবনদর্শন, রাজনৈতিক সংগ্রাম ও নেতৃত্বগুণ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হবে।