১৯৫৫ সালে শিক্ষামন্ত্রীর সেই উদ্বোধনী ভাষণ
১৯৫৪ সালের নির্বাচনের জন্য আবুল মনসুর আহমদের প্রণীত যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা ইশতেহারের ১৬ নম্বর দফা ছিল 'বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা, উন্নয়ন, প্রচার এবং প্রসারের জন্য একটি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করা হবে'। এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই পরবর্তীকালে বর্ধমান হাউসকে বাংলা একাডেমিতে পরিণত করা হয়। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ভূমিধস বিজয় ও সরকার গঠনের পর প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমি।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সুসংহত গবেষণা, অনুশীলন ও বিকাশের জন্য প্রতিষ্ঠিত সেই জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি, আজ পালন করছে তাদের গৌরবময় পথচলার ৭০ বছর। ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর যাত্রা শুরুর পর থেকে একাডেমি ভাষা সংগ্রামের চেতনা, দেশজ কৃষ্টি ও সমকালীন সৃজনধারাকে ভিত্তি করে বাঙালির মননচর্চার প্রধান অঙ্গন হয়ে ওঠে।
একাডেমির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার ও শিক্ষামন্ত্রী আশরাফ উদ্দীন আহমদ চৌধুরী। প্রস্তুতিমূলক কমিটিতে সক্রিয়ভাবে যুক্তভাবে ছিলেন ড. কাজী মোতাহার হোসেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. এনামুল হকসহ প্রমুখ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা, যাদের পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় একাডেমি। একাডেমির প্রথম সভাপতি ছিলেন মওলানা আকরাম খান এবং বিশেষ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সাহিত্যিক মোহম্মদ বরকতুল্লাহ।
সেদিন আশরাফ উদ্দীন আহমদ চৌধুরী অসাধারণ একটি বক্তৃতা করেন। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, পূর্ববঙ্গের নিজস্ব ও সত্যকার ভাষাকে লেখ্য ভাষার মানদণ্ডে নিয়ে আসা উচিত। সে সময়ের আরবি-ফার্সি মিশ্রিত, বাংলা-ইংরেজি মিশ্রিত এবং বাংলা-সংস্কৃত মিশ্রিত তথাকথিত সাধু ভাষার সংঘাত থেকে পূর্ব বাংলার উপযোগী একটি সত্যকার বাংলা ভাষা উদ্ধার করার পক্ষে মত দেন।
যা পরবর্তীতে একাডেমি পরিচালনায় ভূমিকা রাখে। ভাষণটি নেওয়া হয়েছে বাংলা একাডেমির ৪০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী স্মারকগ্রন্থে।
আশরাফ উদ্দীন আহমদ চৌধুরীর ভাষণ:
বন্ধুগণ!
আজাদীর আলোড়নে যে জাতীয় জাগরণের সূত্রপাত হইয়াছে, তাহার পূর্ণ বিকাশ জাতীয় ভাষা ছাড়া সম্ভব নহে। আমাদের এই জাতীয় ভাষা কি হইবে, তাহা লইয়াও কোনও বিতর্কের অবকাশ নাই।
শিশু মাতৃক্রোড় হইতে যে-ভাষা আয়ত্ত করিয়া আসিয়াছে, সে-ভাষাই তাহার নিকট সহজবোধ্য এবং ইহাই তাহার জাতীয় ভাষা। কিন্তু, বিভিন্ন ভাষায় পুষ্ট একাধিক অঞ্চলবিশিষ্ট পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা কি হইবে, এই লইয়া রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে মতভেদ চলিয়াছিল-আজ তাহারও অবসান হইতে চলিয়াছে। অদূর ভবিষ্যতে আমাদের আঞ্চলিক জাতীয় ভাষা বাংলা, রাষ্ট্র-ভাষার মর্যাদা লাভ করিবে এই ইঙ্গিত আজ প্রত্যক্ষ। সুতরাং বাংলা-ভাষার প্রতি আমাদের সজাগ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিবার সময় আসিয়াছে।
মুসলমান বাদশাহদের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিপোষিত বাংলা-ভাষা আজ উপেক্ষিত-অবহেলিত। ফারসী ও ইংরেজী পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতি লাভ করায় ও প্রতিপালিত হওয়ায় বাংলা-ভাষা তাহার যোগ্য মর্যাদা হইতে অনেকখানি বঞ্চিত হইয়াছে সত্য, কিন্তু তবু ব্যাপকভাবে জাতির প্রাণে ইহার স্পন্দন, প্রভাব ও প্রসার আজও অক্ষুন্ন।
কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী সংস্কৃত, ফারসী ও ইংরেজীর সংঘাতে এই ভাষার রূপ কিছুটা বিকল ও পরিমার্জিত হইয়াছে এবং হওয়াই স্বাভাবিক। বাংলা-ভাষায় অনেক বিদেশী শব্দ প্রবেশ করিয়াছে। ইহাদের কতক বাংলা-ভাষায় বেমালুম হজম হইয়া গিয়াছে যথা: আজাদী, কোর্ট, ওকিল, মোখতার, মুনসেফ, ক্লাশ, ষ্টেশন। আবার কতক শ্রুতিকঠোর, কিন্তু অভ্যাস ও প্রয়োজনের খাতিরে শিক্ষিত-সমাজ-কর্তৃক তাহা ব্যবহৃত হইতেছে; ইহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ আমাদের এই বাঙলা-একাডেমী নাম। ইহার মধ্য হইতেই আজ সত্যিকার আজাদ বাংলা-ভাষাকে স্বকীয় ও সুষ্ঠুরূপে প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে। এই প্রতিশ্রুতি লইয়াই আজ বাঙলা-একাডেমী আরম্ভ করা হইল।
এ প্রসঙ্গে ইহা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এই একাডেমীর পরিকল্পনার কথা 'যুক্তফ্রন্ট-দল' মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গেই আমার স্নেহাস্পদ ভ্রাতা মাননীয় সৈয়দ আজিজুল হক সাধারণ্যে প্রকাশ করেন। আজ তাহাই প্রত্যক্ষভাবে আমি আপনাদের সম্মুখে পেশ করিতেছি।
বাঙলা-একাডেমীর কার্যাবলীর কোনও তালিকা দেওয়া এইক্ষণে সম্ভবপর নহে। তবে এতটুকু বলা প্রয়োজন যে, ইহার প্রধান উদ্দেশ্য হইবে জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠা। জাতীয় তথা পাকিস্তানী ঐতিহ্যের অধিকাংশ পুস্তক-আরবী, ফারসী ও উর্দু ভাষায় লিপিবদ্ধ রহিয়াছে।
ইহাদের সুষ্ঠু অনুবাদ ও অনুশীলন বাঙলা একাডেমীর অবশ্য তালিকাভুক্ত হইবে। এজন্য হয়ত আমাদের উর্দু, আরবী ও ফারসী বিভাগও আরম্ভ করিতে হইবে।
দ্বিতীয়তঃ পূর্ব-বাংলার সত্যকার ভাষাকে লেখ্য ভাষার পর্যায়ে উন্নীত করিতে হইবে। আজ আরবী-ফারসী-মিশ্রিত, বাংলা-ইংরেজী-মিশ্রিত, বাংলা ও সংস্কৃত-মিশ্রিত তথাকথিত সাধু বাংলা-ভাষার সংঘাত হইতে পূর্ব-বাংলার উপযোগী সত্যকার বাংলা-ভাষা উদ্ধার করিতে হইবে।
তৃতীয়তঃ বাংলা-ভাষায় অপরিচিত বৈদেশিক ভাষার শব্দাবলী, বিশেষতঃ নিত্য-নৈমিত্তিক বৈজ্ঞানিক শব্দাবলীর পরিভাষা খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে। কেহ কেহ বলেন যে, বৈজ্ঞানিক পরিভাষা উদ্ভাবন করার চেয়ে পাশ্চাত্য শব্দ যথাস্থানে রাখিয়া দেওয়াই ভাল-কারণ পাঠার্থীর জন্য দুইই হইবে সমান দুর্বোধ্য। এ-সম্বন্ধে বিতর্কের অবকাশ রহিয়াছে। Electric Current (ইলেকট্রিক কারেন্ট) সচরাচর ব্যবহৃত হইলেও বিদ্যুৎ-প্রবাহ আমাদের নিকট কষ্ট-সাধ্য নহে, আবার অদ্ভুজানের চেয়ে অক্সিজেন অধিক পরিচিত। কিন্তু, আমি বলিব যে, বিদেশী শব্দ যদি বাংলা পরিভাষার চেয়ে সহজ আয়ত্তশীল হয়, তবে উহাকেও পরিভাষারূপে গ্রহণ করিতে কোনও আপত্তি থাকিতে পারে না; বস্তুতঃ এলজ্যাবরা এখনও আবদুল জব্বারের নাম ধারণ করিয়া রহিয়াছে। ইহাতে গ্রীক গণিতের মর্যাদা লাঘব হয় নাই। এখনও "বুঝাপড়া", শব্দটির চাইতে "সমঝোতা" শব্দটি অধিক ব্যবহৃত হইতে চলিয়াছে।
সুতরাং, বিদেশী শব্দ বাংলা-ভাষার তালিকাভুক্ত করিতে কোনও আপত্তি থাকিতে পারে না। কিন্তু, তাই বলিয়া সহজ-পন্থা হজ-পন্থা হিসাবে সকল বিদেশী শব্দই বাংলা তালিকাভুক্ত করিলে বাংলা-ভাষা বিকৃত হইবে-বরং পরিভাষা প্রসঙ্গে হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করাই হইবে সহজ।
এই কয়টি কথা বলিয়া আমি দেশের সুধী, পণ্ডিত ও সাহিত্যিক সমাজকে বাঙলা-একাডেমীর সহিত সক্রিয় সহযোগিতা করিতে আগাইয়া আসিবার জন্য আহ্বান করিতেছি।
উল্লেখ্য আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী (১৮৯৪-১৯৭৬) বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার রাজনীতিবিদ যিনি তৎকালীন ইস্ট বেঙ্গল আইনসভার সদস্য, অবিভক্ত পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ও বেংগল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার'স কলেজিয়ে স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে রাজশাহী কলেজ থেকে স্নাতক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯১৯ সালে আইন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। তার স্ত্রী রাজিয়া খাতুন চৌধুরাণী সাহিত্যিক ও কবি ছিলেন।