রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতা আধ্যাত্মিকতার সেতুবন্ধন

আবদুল্লাহ জাহিদ
আবদুল্লাহ জাহিদ
29 November 2025, 05:41 AM

বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবিতার ভুবনে রেজাউদ্দিন স্টালিন একটি উজ্জ্বল ও গুরুত্বপূর্ণ নাম। বিগত চার দশকে তার কবিতা প্রেম, প্রতিবাদ, মানবিকতা ও আধ্যাত্মিকতার যে সেতুবন্ধন তৈরি করেছে, তা বাংলা কবিতাকে নতুনভাবে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপনের এক অনন্য প্রয়াস।

প্রচলিত ধারা ভেঙে নতুন চিন্তা, নতুন ভাষা, নতুন বাক্‌প্রতিমা এবং নতুন অভিজ্ঞতার নির্মাণ তিনি ঘটিয়েছেন। ফলে তিনি আজ বাংলাদেশের আধুনিক কাব্যচিন্তার বিশেষ নির্মাতা।

গ্রামীণ প্রকৃতি, মৌলিক মানবিক বোধ এবং মানুষের আর্থসামাজিক সংগ্রামের সঙ্গে তার প্রথম পরিচয়—যা পরবর্তী সময়ে তার কবিতার গভীরে বসতি গেড়ে থাকে।

পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা ও সাংবাদিকতা, সংস্কৃতি ও গণমাধ্যম জগতের সঙ্গে যুক্ত হওয়া তাকে আরও বহুমাত্রিক পাঠকবিশ্বে নিয়ে যায়। লেখালেখির মধ্য দিয়ে তিনি সামাজিক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছেন এবং তা কবিতায় রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন।

স্টালিনের কাব্যবোধ মূলত তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে—মানবিকতা, প্রতিবাদ ও সৌন্দর্যচেতনা। প্রেম কিংবা সামাজিক সংকট—যে বিষয়ই তিনি স্পর্শ করেন, সেখানে পাঠক অনুভব করেন মানবজীবনের অন্তর্গত ব্যথা, প্রত্যাশা, আশাবাদ ও আত্মসম্মান।

প্রথাবিরোধিতার সাহস ও কবিতার ভাষা

রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতা প্রচলিত রীতি ও আঙ্গিকের বাইরে। তিনি প্রথাবিরোধী হলেও তা নিছক প্রথা ভাঙার জন্য নয়, বরং নতুন মানবিক সত্য ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টির সন্ধানে। তার কবিতায় দেখা যায়—

  • ভাষার বিস্ময়কর নির্মাণ
  • শব্দের প্রতিস্পর্ধামূলক ঘনত্ব
  • পুরাণ ও দার্শনিক সত্যের সঙ্গতি
  • বাস্তবতা ও জাদুবাস্তবতার সমান্তরাল প্রবাহ

তিনি নিজের ভেতর প্রাচ্য-প্রতীচ্যের দুয়ার খুলে দিয়েছেন। এই সমন্বয় তাকে আন্তর্জাতিক পাঠকমহলেও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।

স্টিভেনসন বলেছিলেন, 'একজন লেখকের মোহিত করার ক্ষমতা ছাড়া বাকি সবই নিরর্থক।' স্টালিনের কবিতার প্রতিটি পংক্তি সেই মোহের জন্ম দেয়, পাঠকের মনে আলোড়ন তোলে, এমনকি অনুপ্রাণিত করে। তার কবিতা পড়লে মনে হয়, বাংলা ভাষা কতটা সংযত অথচ শক্তিশালী হতে পারে।

স্টালিনের কবিতায় প্রেম কখনো বাহ্যিক কাব্যরস নয়, এটি গভীর মানবিক দায়বোধের ভাষা। তার 'ভালোবাসা তুমি' কাব্যগ্রন্থে প্রেমকে তিনি যে সার্বজনীন কণ্ঠস্বর দিয়েছেন, তা পাঠককে নিজের ভেতরেও প্রেমের গভীর দরজা খুলে দিতে সাহায্য করে।

এখানেই তার কবিতা সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এক অস্ত্র।

'যুদ্ধ নয় শান্তি'—এই সংগ্রামী উচ্চারণ কেবল একটি বইয়ের নাম নয়; এটি তার কবিতাজীবনের এক নৈতিক অবস্থান। ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইউক্রেন কিংবা যুদ্ধবিদ্ধস্ত যেকোনো ভূখণ্ড—মানুষের দুঃখ, তার চোখের জল, তার নীরব আর্তি—সবই তার কবিতায় প্রতিফলিত হয়।

রেজাউদ্দিন স্টালিনের কাব্যদর্শনকে তিনটি মূল শব্দে ধরা যায়—প্রেম, প্রতিবাদ, প্রজ্ঞা।

  • প্রেম তার কাছে শুধু রোমান্টিক অনুভূতি নয়—নৈতিক চেতনা।
  • প্রতিবাদ তার কাছে শুধু রাজনৈতিক অবস্থান নয়—মানবিক ন্যায়বোধ।
  • প্রজ্ঞা তার কাছেই আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক নির্মাণ—যা তাকে অন্য আধুনিক কবিদের থেকে আলাদা করে।

তার বিখ্যাত পঙক্তি—

কেউ যদি দেয় বিশ্বজোড়া বাড়ি

আমিতো দেবো মাত্র দশহাত লজ্জা ঢাকা শাড়ি।

এই পঙক্তি কবির মানবিক দায়বোধকে চিরস্থায়ী করে রেখেছে। সমাজের দারিদ্র্য, নারীর নিরাপত্তা, আত্মসম্মান ও সামাজিক ন্যায়—সবকিছুর প্রতি কবির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ঝলসে ওঠে এখানে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলা কবিতা

বাংলা ভাষা আজও বিশ্বসাহিত্যের কেন্দ্রে যথাযথভাবে প্রবেশ করতে পারেনি—এ কথা সত্য। কিন্তু রেজাউদ্দিন স্টালিন তার কবিতা অনুবাদের মাধ্যমে যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, তা বাংলা কবিতাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে। তার যুদ্ধবিরোধী, শান্তিমগ্ন উচ্চারণ আন্তর্জাতিক পাঠকের মনেও দাগ কেটেছে।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ভাষার সৌন্দর্য এবং দার্শনিক গভীরতা—এসবই তার কবিতা পাঠের মাধ্যমে বিশ্ব জানতে পারছে।

একজন কবিকে শুভেচ্ছা জানানো নয়, এটি বাংলা কাব্যের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার প্রকাশ। তার কবিতা আমাদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে, চিন্তাকে তীক্ষ্ণ করেছে এবং মানবিকতাকে গভীর করেছে।