‘আবার এসো দখিন হাওয়ায়’
নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনে ধানমন্ডির দখিন হাওয়ায় তার সঙ্গে সাক্ষাতের স্মৃতি এখনও জীবন্ত। সেই এক বিকেলে লেখকের কথায় ফুটে উঠেছিল লেখালেখি, জীবন ও পাঠকপ্রেম বিষয়ে তার গভীর উপলব্ধি।
বাংলা কথাসাহিত্যের নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদ। ১৯৭২ সালে 'নন্দিত নরকে' ও 'শঙ্খনীল কারাগার' প্রকাশের পর থেকেই পাঠক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেন তিনি। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন কথার যাদুকর।
১৩ নভেম্বর লেখকের জন্মদিন। বহুবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছে—কখনো দখিন হাওয়ায়, কখনো নুহাশপল্লীতে, আবার একবার মুন্সিগঞ্জের জাপান বাড়িতে। সেসব স্মৃতির ভেতর থেকে দখিন হাওয়ায় তার জন্মদিনের এক বিকেলের কথা আজও মনে পড়ে।
সেদিন দখিন হাওয়ায় পৌঁছে ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই চোখে পড়ে সাজানো-গোছানো কক্ষটি। কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী বসে ছিলেন। বাসায় অতিথির আনাগোনা চলছে—কেউ ভেতরে যাচ্ছেন, কেউ আবার ড্রয়িংরুমে এসে বসছেন। আমি লেখকের অপেক্ষায়।
অল্প কিছুক্ষণ পর তিনি ড্রয়িংরুমে ঢুকলেন। আমার কাছে মুহূর্তটি স্বপ্নের মতো। তার সব বই আমার পড়া; একুশে বইমেলায় তার বই কিনতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও কখনো ক্লান্ত লাগেনি। প্রিয় লেখককে সামনাসামনি দেখে মনটাই ভরে গেল।
বসেই হুমায়ূন আহমেদ সরাসরি বললেন, কী জানতে চাও বলো?
জিজ্ঞাসা করলাম, জন্মদিনে কোনো লেখা লিখেছেন কী?
তিনি বললেন, লেখকের কাজই লেখালেখি করা। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও যেমন ধান ভানে, আমার অবস্থাও তাই। আজ সকালে বাচ্চাদের জন্য ছোট একটা গল্প লিখেছি। ওদের অভিযোগ আমি তাদের জন্য কম লিখি।
মিষ্টি এল। তিনি বললেন, মিষ্টি খাও। খেতে খেতে গল্প করি।
নতুন বইও এল। প্রতিজনকে একটি করে বই উপহার দিলেন। এর মধ্যেই কেউ ফুল নিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে আসছেন, তিনি আবার আমাদের সঙ্গে গল্প চালিয়ে যাচ্ছেন।
আমি প্রশ্ন করলাম, লেখালেখি নিয়ে কতটা তৃপ্ত তিনি।
হুমায়ূন আহমেদ বললেন, তৃপ্ত তো বটেই। তৃপ্তি না থাকলে লেখালেখি করা যেত না। তবে অতৃপ্তিও লাগে। যার সবকিছুতে অতৃপ্তি, তার লেখালেখি হবে না। আর যার সবকিছুতে তৃপ্তি, তারও হবে না। আমার তৃপ্তি যেমন আছে, অতৃপ্তিও আছে।
জন্মদিন নিয়ে অভিমত জানতে চাইলে বললেন, আমি মনে করি জন্মদিন পারিবারিকভাবে করা উচিত, যেখানে আত্মীয়স্বজন থাকবে। কিন্তু এখন আমার জন্মদিন হাতছাড়া হয়ে গেছে। কী হচ্ছে, কী হবে, কিছুই জানি না। প্রকাশকরা কখন কেক নিয়ে আসবে জানি না। বিকেলে নুহাশপল্লীতে কী হবে, তাও জানি না। যাতে আনন্দ পাই তাই সবকিছু রহস্য রাখা হয়। বলা যায়, জন্মদিন আমার হাত ছাড়া।
ফের প্রশ্ন করলাম, ৬০তম জন্মদিনে এসে জীবন সম্পর্কে তার উপলব্ধি কী।
বললেন, জীবন সম্পর্কে আগেও বুঝতে পারিনি, এখনো বুঝতে পারি না।
এরই মধ্যে একবার উঠে তিনি ভেতরে যান এবং দ্রুত ফিরে এসে বললেন, 'আর কিছু জানতে চাও? দ্রুত শেষ করতে হবে।'
জিজ্ঞেস করলাম—জন্মদিনে তার লেখা নিয়ে একক বইমেলা হচ্ছে; এ বিষয়ে তার মন্তব্য কী।
তিনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, 'আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান লেখক। বহু পাঠকের কাছে নিজের লেখা পৌঁছাতে পেরেছি—যা অনেক ক্ষমতাবান লেখকও পারেন না। মানুষের কাছে পৌঁছানো না গেলে লেখাটা অর্থহীন। এজন্য আমি সৌভাগ্যবান।
এক সাংবাদিক বললেন, তার লেখায় মদ্যপানকারীদের জীবন বারবার উঠে আসে।
তিনি হাসলেন আর বললেন, আমি তো বিজ্ঞানের ছাত্র। বিজ্ঞান পড়লে এক্সপেরিমেন্ট ছাড়া কিছু করা যায় না। আমি জন্মেছি মধ্যবিত্ত পরিবারে, তাই সেই সমাজকে ভালো করে জানি। আমি কল্পনা করে লেখার মানুষ নই। আমি যা দেখি, তাই লিখি।
আরেক দফা চা এলো। চা খেতে খেতে বললেন, আমি মধ্যবিত্ত নিয়ে লিখছি না উচ্চবিত্ত নিয়ে, এটা বড় বিষয় না। শেক্সপিয়ার আজীবন রাজা-বাদশাদের নিয়ে লিখেছেন। কোনো সমস্যা হয়েছে তার? সবকিছু নির্ভর করে লেখকের সক্ষমতার ওপর।
এর কিছুক্ষণ পর কয়েকজন প্রকাশক এলেন। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, আজ এ পর্যন্তই থাকুক। পরে এসো। জন্মদিন ছাড়াও এসো।
বিদায়ের আগে কিছু ছবি তুলতে চাইলে তিনি রাজি হলেন। ছবি তুলে বের হয়ে এলাম। ঠিক তখনই তিনি খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আবার এসো দখিন হাওয়ায়।