চলে গেলেন আমাদের শৈশবের গল্পকার

By সাদিকা তাবাসসুম
16 October 2025, 06:31 AM

অক্টোবরের পড়ন্ত বিকেলটায় হঠাৎ একটা প্রজন্ম যেনো শোকে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। অসংখ্য পাঠক হৃদয়ে একসঙ্গে হাহাকারের দামামা বেজে উঠল একটা মনখারাপি সংবাদে— রকিব হাসান আর নেই। অগণিত মানু্ষের মুখের ওপর যেন হঠাৎ করেই কেউ শৈশবের দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল।

আমাদের কাছে তিনি ছিলেন বিমূর্ত। তার মুখ আমরা কখনো তেমন কোনো খবরের কাগজ, ম্যাগাজিনের পাতায়, বা বইয়ের ফ্ল্যাপে দেখিনি, কোনো সাক্ষাৎকারে কণ্ঠও শুনিনি, তবু মনে হতো তিনি আমাদের খুব কাছেরই কেউ। কারণ আমাদের জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে তাঁর সৃষ্টি ছিল আমাদের চারপাশে—আমাদের পড়ার টেবিলে, বুকশেল্ফে, স্কুলের ব্যাগে, মাথার বালিশের পাশে। 

তার সৃষ্ট কিশোর পাশা, মুসা আমান আর রবিন মিলফোর্ড আমাদের কাছে ছিল জীবন্ত, ঠিক যেন পাশের বাসার বন্ধুর মতন। তিনি সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত 'তিন গোয়েন্দা' নামক কিশোর গোয়েন্দা কাহিনীর স্রষ্টা, তবে সিরিজটি মূলত লেখক রবার্ট আর্থারের 'থ্রি ইনভেস্টিগেটরস' থেকে অনুপ্রাণিত।  তার লেখা তিন গোয়েন্দা সিরিজটি প্রথম আলো জরিপে বাংলাদেশের কিশোরদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাঠযোগ্য সিরিজ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল।

রকিব হাসান— এই নাম উচ্চারণ করলেই যেন খুলে যায় স্মৃতি আর কল্পনার এক জগত। হ্যাল্লো কিশোর বন্ধুরা বলে সেই ডাক, সেবা প্রকাশনীর পাতলা নিউজপ্রিন্টে ছাপা ক্ষুদ্র অক্ষর, কাঁথামুড়ি দিয়ে টর্চলাইটের আলোয় রাত জেগে বাবা মা-কে ফাঁকি দিয়ে তিন গোয়েন্দার একের পর এক ভলিউম পড়ে শেষ করা রাতগুলো—সব স্মৃতি যেন এক ঝলকে মনের পর্দায় ফিরে আসে। 

রকিব হাসানের কলমে গড়া এই চরিত্রগুলো এতটাই প্রাণবন্ত ছিল যে আমরা ভুলে যেতাম, তারা আসলে কাগজে লেখা কিছু নাম মাত্র। তিন গোয়েন্দার রহস্যে ডুবে গিয়ে আমরা বেঁচে থাকতাম এক কাল্পনিক বাস্তবতায়, যেখানে ভয় জয় করা যায়, যেখানে সত্য জয়ী হয়, আর বন্ধুত্বই সবচেয়ে বড় শক্তি। তিন গোয়েন্দার পাতায় আমরা প্রথম রহস্য চিনেছি, প্রথম বুদ্ধিদীপ্ততার মূল্য শিখেছি, আর বন্ধুত্বের মানে বুঝেছি।

সেই সময়টায় মোবাইল ফোন ছিল না, সোশ্যাল মিডিয়ার ঝলমলে বিভ্রমও না। বিকেলের পর বইয়ের দোকানে যেতাম, পরের ভলিউম বেরিয়েছে কি না, তা দেখতে। টিফিনের টাকা জমিয়ে কিনতাম নতুন ভলিউম, বন্ধুদের সঙ্গে অদলবদল করে পড়তাম। 

রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দার একেকটা গল্প ছিল একেকটা নতুন জগতের সন্ধান। সমুদ্র, জঙ্গল, পাহাড়, দুর্গ, মোবাইলহোম, পাশা স্যালভেজ ইয়ার্ড, হেডকোয়ার্টার, কথা বলা মমি, টেরর ক্যাসল, ভূত থেকে ভূতে, রোলস রয়েস, হ্যানসন, বোরিস, রাশেদ চাচা, মেরিচাচি, শুটকি টেরি, ফগর‍্যাম্পারকট— সবই যেন চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠত। এই চরিত্র, এই ঘটনাগুলো নিয়েই কেটেছে আমাদের শৈশব আর কৈশোরের অনেকটা সময়। যখন আমরা বন্ধুত্বে বিশ্বাস করতে শিখছিলাম, তখন পাশে ছিল কিশোরের দৃঢ়তা। যখন ভয় পেতাম, তখন পাশে ছিল মুসার আচমকা সাহস। যখন মনোযোগ হারাতাম, তখন রবিনের শান্ত বুদ্ধিদীপ্ত মুখটা চোখে ভাসত।

তিন গোয়েন্দা ছাড়াও রকিব হাসানের সাহিত্যকীর্তি অনেক বিস্তৃত। রকিব হাসান কেবল তিন গোয়েন্দারই ১৬০টি বই লিখেছেন, এ ছাড়া কমপক্ষে ৩০টি বই অনুবাদ করেছেন। মূলত মূল নামে লেখালেখি করলেও তিনি জাফর চৌধুরী ছদ্মনামে সেবা প্রকাশনীর 'রোমহর্ষক' সিরিজ লিখেছেন। এ ছাড়া আবু সাঈদ ছদ্মনামে তিনি লিখেছেন 'গোয়েন্দা রাজু' সিরিজ। জুল ভার্নের বইগুলো অনুবাদ করেছেন শামসুদ্দীন নওয়াব ছদ্মনামে। তার লেখা প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ সালে ছদ্মনামে। 

স্বনামে প্রথম প্রকাশিত বইটি ছিল অনুবাদগ্রস্থ— 'ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা'। এরপর তিনি অনুবাদ করেছেন এরিক ফন দানিকেন, ফার্লে মোয়াট, জেরাল্ড ডুরেল-এর মত বিখ্যাত লেখকদের অনেক ক্লাসিক বই। এ ছাড়া অনুবাদ করেছেন মহাক্লাসিক 'অ্যারাবিয়ান নাইটস' এবং এডগার রাইস বারোজের 'টারজান' সিরিজ। বড়দের উপযোগী রহস্য উপন্যাসও তার জনপ্রিয়তার অংশ। 

সব মিলিয়ে রকিব হাসান কিশোরদের জন্য রহস্য, অ্যাডভেঞ্চার ও সায়েন্স ফিকশনের এক বিশাল ভান্ডার সৃষ্টি করেছেন। 'রোমহর্ষক' সিরিজে রেজা ও সুজা দুই ভাইয়ের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, যেটি থেকে অনেক গল্প ভিন্ন নামে 'তিন গোয়েন্দা' সিরিজে স্থান পেয়েছে।

বাংলাদেশের পাঠকজগতে ওয়েস্টার্ন ঘরানার গল্প জনপ্রিয় করার পেছনে তিনিই অন্যতম পথপ্রদর্শক। 'ব্ল্যাক হিলসের ডাকাত', 'ক্যাকটাস ক্যানিয়নের আতঙ্ক' কিংবা 'ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্ট' –এর রোমাঞ্চ আমাদের মতো কিশোরদের একেবারে নতুন এক সাহিত্যের দুনিয়ায় নিয়ে গিয়েছিল। তার অনুবাদ ছিল কেবল ভাষান্তর নয়, বরং সাংস্কৃতিক রূপান্তর—যেখানে বিদেশি মরুভূমি, গরুর পাল, ঘোড়ার খুরে উরানো ধুলো, বন্দুকের শব্দ আর ন্যায়ের জন্য লড়াই - সবকিছুই হয়ে উঠত আমাদের চেনা পরিমণ্ডলের অংশ। 

রকিব হাসান ছিলেন সেই লেখক, যিনি অনুবাদের ভেতর দিয়ে এক নতুন পাঠকপ্রজন্ম তৈরি করেছিলেন। রহস্য, ইতিহাস, থ্রিলার, কিশোরসাহিত্য— সব ক্ষেত্রেই তার অবদান অমলিন। তিনি অনুবাদ করেছেন নানা ধরনের বিদেশি সাহিত্য। পাঠক বুঝতেই পারতেন না গল্পটা দূরদেশের— এটা যেন আমাদেরই শহর, আমাদেরই জীবনের অংশ।

আর এই সবকিছুর পেছনে ছিল তার অদ্ভুত নিষ্ঠা ও সেবা প্রকাশনীর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক। সেবা প্রকাশনীর সেই স্বর্ণযুগের স্তম্ভগুলোর একজন ছিলেন তিনি। কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে মিলে তিনি তৈরি করেছিলেন এক পাঠসংস্কৃতি, যা বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েদের হাতে বইয়ের নেশা তুলে দিয়েছিল। সংবাদপত্রের কাগজে ছাপা ছোট ছোট অক্ষরের সেসব বই ছিল সস্তা, সহজলভ্য— কিন্তু তাতে লুকায়িত ছিল এক অমূল্য জগৎ। সেই জগতের অন্যতম নির্মাতা ছিলেন রকিব হাসান।

রকিব হাসানের মৃত্যু আমাদের নব্বই দশকের প্রজন্মের জন্য যেন নস্টালজিয়ার ঝাঁপি খুলে দিয়েছে। নব্বইয়ের দশকের স্মৃতি সবকিছু একসঙ্গে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। নব্বইয়ের দশকের মানুষরা এখন প্রাপ্তবয়স্ক, সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় এবং নিত্য জীবনযুদ্ধের সৈনিক। তারাও শৈশবের প্রিয় লেখকের প্রয়াণের সংবাদ শুনে মুহূর্তে অতীতে ফিরে গিয়েছে। এ যেন আশ্চর্য জাদুকরী কাণ্ড।

নব্বইয়ের দশকের নস্টালজিয়া কেবল ব্যক্তিগত আনন্দ-দুঃখ নয়, এটি একটি সামষ্টিক অভিজ্ঞতা। কারণ, তখন মানুষ একই সময় একই সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বেড়ে উঠেছিল। তখনকার বই, গান, সিনেমা— সবই সীমিত কনটেন্টে বিভাজিত ছিল। তাই নব্বইয়ের প্রজন্ম সহজেই যৌথ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আবেগভরা নস্টালজিয়া অনুভব করতে পারে। সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা, নব উদারতাবাদী নীতি, বিশ্বায়নের চাপ— সব মিলে নব্বই দশকের সেই স্বপ্নগুলোকে এখন তালাবদ্ধ করে রাখে।

বর্তমান দিনের প্রযুক্তি ও কনটেন্ট কেমন যেনো তারাহুরোর। আমরা অবিরাম কন্টেন্ট ভোগ করি, আমাদের মনোযোগ কমে গেছে, বিনোদন ও আবেগ ভাগাভাগি এখন একান্ত ব্যক্তিগত। বোরড বা টায়ার্ড হওয়ার সুযোগ নেই, সৃষ্টিশীলতার জন্য প্রয়োজন যে সময় ও সুযোগ, প্রযুক্তি ও সামাজিক মাধ্যম আমাদের তা ছিনিয়ে নিচ্ছে। রকিব হাসানের মৃত্যু যেন নব্বই দশককে সিলগালা করে কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে দেয়, এ যেনো এক 'যেতে নাহি দেব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়' অনুভূতি। প্রযুক্তি, বিশ্বায়ন, এবং আধুনিক কনজ্যুমারিজম আমাদের সমষ্টিগত স্মৃতি ও আবেগকে বিলীন করে দিয়েছে। এই বিচ্ছিন্নতা, হারানো শৈশবের স্মৃতি—সবকিছু মিলিয়ে রকিব হাসানের প্রতি শোককে আরও গভীর করে।

নব্বইয়ের দশকের সামষ্টিকতা আর বিস্ময় এখন হারিয়ে গেছে, কিন্তু রকিব হাসানের গল্প, তিন গোয়েন্দা, আমাদের সেই সময়ের জাদুকরী শীতল পরশকে বয়ে নিয়ে আসে। এই জাদু যিনি সৃষ্টি করেতে পারেন, তিনি নিঃসন্দেহে এক জাদুকর। শব্দের জাদুতে তিনি আমাদের নিয়ে গেছেন এমন এক দুনিয়ায়, যেখানে কল্পনা আর বাস্তব একাকার। আজ সেই জাদুকর নেই। বুকের ভেতরটা কেমন খালি হয়ে আসে।

যে মানুষটি আমাদের কিশোর বয়সে সাহস শিখিয়েছেন, জীবনের প্রথম উত্তেজনা চিনিয়েছেন, যার চোখে আমরা দুনিয়ার একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছি বইয়ের পাতায়— আজ তাকে বিদায় জানাতে গিয়ে মনে হয়—আমরা 'নাইন্টিজ কিড'রা আসলেই বড় হয়ে গিয়েছি। আমরা যারা নব্বই দশকের সন্তান, যারা বইয়ের ঘ্রাণে বড় হয়েছি, তারা এখন এমন এক সময়ে বাস করছি, যখন শৈশবের সব চেনা মুখ একে একে হারিয়ে যাচ্ছে। যেন আমাদের নিজেদের ছোটবেলাটাও ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যাচ্ছে তাদের সঙ্গে। আজ রকিব হাসানের মৃত্যুসংবাদ শুনে মনে হলো—এইবার হয়তো সত্যিই বড় হয়ে গিয়েছি আমরা।

রকিব হাসান কি সত্যিই চলে গেলেন? না, তিনি সিংহাসনে আরোহণ করে রাজার ন্যায় থেকে গেলেন একটি গোটা প্রজন্মের হৃদয়ে। যারা একসময় স্কুল শেষে তিন গোয়েন্দা নিয়ে বসত, টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে নতুন বই কিনত, পড়ার বইয়ের নিচে লুকিয়ে তিন গোয়েন্দা পড়তো— তাদের স্মৃতিতে তিনি চিরজীবী। এখন সেই প্রজন্ম বাবা-মা হয়েছে, আর তাদের সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছে সেই একই তিন গোয়েন্দা। যখন নতুন প্রজন্ম সেই বইয়ের পাতায় ডুব দেবে, যখন তারা উচ্চারণ করবে  'কিশোর পাশা'; যখন কেউ হেসে বলবে 'খাইসে!', তখনও কোথাও রয়ে যাবেন রকিব হাসান।

তার সৃষ্টি তাকে অমর করেছে। বাংলা অক্ষরে চিরকাল জ্বলজ্বল করবে তিনটি নাম—তিন গোয়েন্দা, সেবা প্রকাশনী, আর তার নিচে স্বর্ণাক্ষরে—রকিব হাসান।

আমরা জানি, নতুন প্রজন্ম হয়তো এই অনুভূতি পুরোটা বুঝবে না। কারণ এটা কেবল শুধু বই পড়ার অভিজ্ঞতা নয়— এটা হলো আমাদের বেড়ে ওঠার স্মৃতি, ছোট্ট মনগুলোর বড় বড় স্বপ্ন দেখার হাতেখড়ি। তিন গোয়েন্দা আমাদের শিখিয়েছে যুক্তি, সাহস, আর বন্ধুত্বের মানে। শিখিয়েছে— সবচেয়ে জটিল রহস্যেরও সমাধান আছে, যদি আমরা হাল না ছাড়ি। এই শিক্ষা, এই আনন্দ, এই উত্তেজনা— সবকিছুর পেছনে ছিলেন এক নিঃশব্দ মানুষ, যিনি নিজের নামের আড়ালে সৃষ্টি করেছেন প্রজন্মের পর প্রজন্মের কল্পনার জগৎ।

আজ সব মনে পড়লে অদ্ভুত এক কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে মন। প্রিয় রকিব হাসান— আপনি আমাদের দেখিয়েছিলেন, শব্দ দিয়েও কীভাবে তৈরি করা যায় স্বপ্নের জগত। ধন্যবাদ, রকিব হাসান স্যার—আমাদের ছোটবেলাকে এত উজ্জ্বল করে তোলার জন্য, আমাদের কল্পনার রাজ্যকে এমন বিশাল অবমুক্ত করে দেওয়ার জন্য।

রকিব হাসান আর নেই—এই ছোট্ট বাক্যটা আসলে মিথ্যে। তিনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন—আমাদের পাঠকমনের প্রতিটি পৃষ্ঠায়। প্রতিবার যখনই কেউ কোনো পুরোনো তিন গোয়েন্দার প্রচ্ছদে আঙুল রাখবে, যখনই কেউ নতুন প্রজন্মকে উনার বই হাতে তুলে দিয়ে বলবে— 'এই বইটা পড়ো', ততবারই রকিব হাসান আবার ফিরে আসবেন— অক্ষরে, কল্পনায়, ভালোবাসায়।

বিদায়, আমাদের গল্পের মানুষ। আপনার শব্দের আলো নিভে যাবে না কোনোদিন।

সাদিকা তাবাসসুম, পাঠক ও গুণমুগ্ধ