লাসলো ক্রাসনাহোরাকাই ও আমাদের পাঠ
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের চূড়ান্ত ঘোষণার আগে সব দেশের সাহিত্যমহলেই কম বেশি জল্পনাকল্পনা চলে, কার ভাগ্যে পুরস্কার যোগ হতে যাচ্ছে। এদেশেরও সাহিত্য পত্রপত্রিকায়ও ছোটখাটো তালিকাও প্রকাশ করা হয়। বিশেষ কয়েকজনকে ঘিরে ঘন হয়ে আসতে থাকে- যেমন বাংলাদেশের অনুমানকারীরা হারুকি মুরাকামির নাম করেন। কারো কারো নামে বাজিও নাকি ধরা হয়। কিন্তু প্রায়ক্ষেত্রে দেখা যায়, সবাইকে হতচকিত করে দিয়ে নোবেল কমিটি এমন কারো নাম ঘোষণা করেন, যার কথা কেউ স্বপ্নে বা দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি। এমন কি যাকে দেওয়া হলো তিনি অব্দি বিস্মিত।
বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ায় প্রিয় কোনো কোনো লেখকের নোবেল না পাওয়ায় তার ভক্ত পাঠকরা মুষড়েও পড়েন কয়েকদিনের জন্য। আরও চমকপ্রদ বিষয় হলো, অল্প কদিনের ভেতরে অনেকেই ভুলে যান কে পেলেন এ বছর নোবেল, এটা তখন আরও বেশি ঘটে, যখন একেবারেই অচেনা অজানা কাউকে পুরস্কারটি দেওয়া হয়। হ্যাঁ নোবেল পাওয়ার কারণে বিভিন্ন ভাষার মতো বাংলায় ওই লেখকের বইয়ের অনুবাদও পড়ার আগ্রহও দেখা দেয়। কিছু বই অনূদিতও হয়। তারপর একটু একটু করে ওই লেখক ও তার বই হারিয়ে যেতে থাকে। এলফ্রিদে ইয়েলিনেক বা হার্তা মুলার বা হাং কাং-এর নোবেল প্রাপ্তিতেও তেমন চমক ছিল। ছিল রুশ সাভেৎলানা আলেক্সিয়েভিচের নোবেল প্রাপ্তিতেও। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, কেবল নারীদের কথা বলা হচ্ছে কেন! নারীদের আরও বেশি করে নোবেল দেওয়া দরকার বলেও মনে হয় যদিও। যাই হোক, চমক ছিল সংগীত শিল্পী বব ডিলানের বেলায়ও। আবদুররাজাক গুরনাহর কথা তার নোবেল পাওয়ার আগে তেমন কেউ ভাবেনও নি।
২০২৫ সালে সাহিত্যে যাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলো, সে হাঙ্গেরির লাসলো ক্রাসনাহোরাকাই। ২০১৪ সাল থেকেই তার নাম বাঙালি সিরিয়াস পাঠক মহলে সামান্য হলেও ছড়িয়েছিল। বিশেষ করে লেখক-কবি মাসরুর আরেফিন যখন ২০১৪ সালের দিকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে লাসলো ক্রাসনাহোরাকাইয়ের নাম তুলে ধরেন; ২০১৫ সালে লাসলোর দ্যা ওয়ার্ল্ড গৌজ অন বুকার পুরস্কার পাওয়ার পর অনেকেই আরেকবার সচকিত হন। এরপর থেকে প্রায় প্রতি বছরই কেউ না কেউ এমন সম্ভাব্য তালিকায় লাসলোর নাম যোগ করে আসছেন। ২০১৯ সালে দিকেও বেশ জোরালো ভাবে বলা হয়েছিল লাসলোর নাম। এবার প্রায় অনেকেই খুব জোরের সঙ্গে লাসলোকে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় রেখেছিলেন এবং শেষ অব্দি লাসলো সেটি অর্জনও করলেন।
১৯৯৯ সালে গুন্টার গ্রাসের নোবেল পাওয়ার পর, ২০০১ সালে ভি.এস. নাইপল যখন পেলেন, তখন তারা সম্ভাব্য হিসেবে বেশ গণ্যমান্যই ছিলেন। এঁদের দুজনের কথা বলতে হচ্ছে এজন্য যে তারা দুজনেই বাঙালি পাঠকমহলে মোটেও অপরিচিত ছিলেন না। এর পর জে. এম. কোয়েৎজি, হ্যারাল্ড পিন্টার, ওরহান পামুক, মারিও ভার্গাস ইয়োসা অব্দি বাঙালি পাঠকের জানা শোনার ভেতরে নোবেল সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্তরা ছিলেন। সেটিও ২০১১তে টমাস ট্রান্সট্রোমার অব্দি।
বলতে গেলে এদের পর এবং প্রায় ১৪ বছর এমন একজন লেখক নোবেল পেয়েছেন যার লেখা কেবল সমকালের চরায় আটকে চিরকালে জন্য হারিয়ে যাওয়ার জন্য নয়। কিন্তু বাঙালি পাঠকেরা গ্রাস, নাইপল, ইয়োসার নাম ও লেখার সঙ্গে যেমনটা পরিচিত ছিলেন লাসলোর সাহিত্যের সঙ্গে তো দূরের কথা, নামের সঙ্গেই একেবারেই পরিচিত নন। যেমন, পিটার হ্যান্ডকে, কাজুও ইশিগুরো বা বব ডিলানের নামের সঙ্গে কমবেশি সিরিয়াস পাঠকদের পরিচয় ছিল। কিন্তু লাসলো যে অর্থে কঠিন জটিল সূক্ষ্ম গভীরগামী রচনাশৈলীর অধিকারী এবং তার রচনা যে পরিমাণ ঝুঁকিবহুল পাঠ ও মনোযোগ দাবি করে, বলতে গেলে গ্রাসের পর তেমন কাউকে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
নোবেল কমিটি তাকে এ পুরস্কার দেওয়ার কারণ হিসেবে ঘোষণাপত্র বা সাইটেশানে উল্লেখ করেন, ''সেই অনুপম, মুগ্ধকর ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সাহিত্যসম্ভারের জন্য তিনি পুরস্কৃত হলেন, যে সাহিত্য মহাপ্রলয়ের মাঝেও প্রকৃত শিল্পের জয়গান গায়; শিল্পের চিরজাগ্রত মহাশক্তির মহিমা বর্ণনা করে।'' মজার বিষয়, কমিটির এই ঘোষণাপত্রে বলা কথাগুলো ঘুরে ফিরে কমবেশি একই কথাই জানিয়ে দিয়ে আসছে বিগত অনেক বছর ধরে।
লাসলো ক্রাসনাহোরাকাই মূলত ঔপন্যাসিক হিসেবেই গণ্য হয়ে আসছেন। তার উপন্যাসের সংখ্যা খুব বেশি নয়। স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫), দ্যা মিলানকোলি অব রেজিটেন্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯), ড্রেসাট্রাকশন অ্যান্ড সরো বিনিথ দ্যা হ্যাভেন (২০০৪), সিবো দেয়ার বিলো (২০০৮), ব্যারন ওয়েনকহেমস হোমকামিং (২০১৬) এবং ২০২৪ সালে মূল হাঙ্গেরীয় ভাষায় প্রকাশিত যে উপন্যাসটি সেটির নাম জসেমলে ওডাভান। (উল্লেখ্য এখানে সালগুলো মূল ভাষায় বইটি যেসময় প্রকাশিত হয়েছিল, সে অনুযায়ী দেওয়া) এছাড়াও তার বেশ কিছু নভেলা, ছোটগল্প এবং প্রবন্ধের বই উপন্যাসগুলোর প্রকাশকালের ভেতরে প্রকাশিত হয়েছে। এর ভেতরে ২০০৯ সালে প্রকাশিত নভেলা 'দ্যা লাস্ট উলফ' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বলতেই হয় ২০১৩ সালে প্রকাশিত তার ছোটগল্পের সংকলন 'দ্য ওয়ার্ল্ড গৌজ অন'-এর জন্য তিনি বুকার পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন। এছাড়াও ১৯৮৭ সাল থেকে ২০২৪ সাল অব্দি একের পর এক পুরস্কার ও সম্মাননায় তিনি ভূষিত হয়ে আসছিলেন। আরও একটি দিক হলো চলচ্চিত্রে চিত্রনাট্যকার হিসেবে তার ভূমিকা দারুণ উল্লেখযোগ্য। চলচ্চিত্রকার বেল তারের নাম তার নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে।
লাসলো ক্রাসনাহোরাকাইয়ের লেখা হাঙ্গেরির সমাজ ও রাজনীতি ও ব্যক্তি জীবনের পাঠ। কিন্তু তা কেবল হাঙ্গেরির মানুষের কথা হয়েই থেকে যায় না। তার সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে, বিশ্লেষণাত্মক প্রবণতার গদ্য যে-জটিলাবর্তে তিনি বিন্যাস করেন তা যেন তার শত শত শতকের মর্মবেদনা। লাসলোর বাবা গিয়ের্গে ক্রাসনাহোরাকাই ছিলেন ইহুদি। লাসলোর ১১ বছর পর্যন্ত এ পরিচয় তার কাছে গোপন রাখেন তার বাবা। মা জুলিয়া পালিনিস্কা সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রশাসনে কাজ করতেন। মায়ের বংশ এসেছিল হাঙ্গেরির ট্রান্সিলভানিয়ার থেকে। ১৯৫৪ সালের ৫ জানুয়ারি দক্ষিণ পূর্বাংশের বেকেস কাউন্টির গিউলা শহরে জন্ম হয় লাসলোর।
বর্তমান একাত্তর বছর বয়সী লাসলো জীবন ও সাহিত্যে ইউরোপীয় মনমেজাজের প্রতিনিধিত্ব করলেও তিনি দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপ এবং মধ্য আফ্রিকার মানুষের জীবনভাষ্য তুলে এনে এক বৈশ্বিকচেতনার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এই বৈশ্বিকতার পেছনে আমরা দেখতে পাই দুজন লেখকের ভূমিকা বিশেষভাবে জড়িয়ে আছে। একজন হলে জার্মান-চেক ফ্রাঞ্জ কাফকা অন্যজন হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যালকম লরি। কাফকার 'দ্যা ক্যাসেল' আর লরির 'আন্ডার দ্যা ভলকানো'- উপন্যাস দুটোকে তিনি কোনো কোনো সময় ধর্মগ্রন্থের মতো পাঠ করেছেন। আবার তার গভীরতলে বার বার ডাক পড়ছে ফিওদর দস্তয়েভস্কির। সেই সঙ্গে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টমাস পিঞ্চনের লেখার মতো হাঙ্গেরির ইতিহাসের সমান্তরালে নিজের রচনাকে হাজির করেছেন। দুটো বিশ্বযুদ্ধই কেবল নয়, তার লেখার প্রতিটি শব্দরেখা ধরে অস্ট্রোহাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের ইতিহাসের ভাঙচুর আর রক্তক্ষরণের স্রোত বয়ে চলে।
লাসলোর রচনারীতিতে কমার ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা খরচ করেন মাত্র একটি বাক্যের জন্য। 'দ্যা লাস্ট উলফ' নভেলাটি যেমন। এটি মাত্র একটি বাক্যে সম্পন্ন, একটানা লেখা। শ্বাসফেলার কোনো সুযোগ না দিয়ে পাঠককে একনিষ্ঠ মনোযোগের জন্য কামড়ে ধরে তার এ লেখা। কোনোভাবেই অর্ধমনস্কতাকে প্রশ্রয় দেন না। সুগভীর মগ্নতা ছাড়া তাঁর লেখার গতিপথে বার বার পাঠকে পিছলে পড়তে হবে, সোজা বাংলা আছাড়া খেতে হবে। তার এই রচনাভঙ্গির সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের কমলকুমার মজুমদারের লেখার কিছু মিল আছে। যদি কমলকুমারের মতো দুর্বোধ্যতা তার শব্দে বা বাক্যের ততটা নেই। অদ্ভুত এক সরলতা ভঙ্গিকে জটিলতায় বিন্যাস করেছেন নাকি জটিলতাকে সরলতা দিয়ে চূর্ণ করে দিয়েছেন- লাসলোর লেখা তেমন ধরনের দ্বিধাও তৈরি করে।
দৃষ্টান্ত হিসেবে তার 'দ্যা লাস্ট উলফ' বা 'শেষ নেকড়ে'র শুরুটা দেখে নেওয়া যেতে পারে: ''ওই তো তিনি ওখানে, হাসছিলেন, কিন্তু চেষ্টা করছেন আরও বেশি উদ্দামভাবে হাসতে, তিনি আগে থেকেই একটি প্রশ্নে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছেন, আদৌ অর্থহীনতার সমস্ত ভারের সঙ্গে অসম্মানের ভারের কোন তফাতটা আছে, যেটা নিয়ে আসলে তিনি হাসছিলেন, কারণ বিষয়টি ছিল, অনন্য, সমস্ত কিছুর শুরু হয় একটি সামগ্রিকতা থেকে যা সবখানেই ছিল, এবং আরও বেশি যেটা হয়, যদি সত্যিই এটা সর্বত্র দরকার হয়, সূচনা হয় সবখান থেকে, যথেষ্ট কঠিন হতো সিদ্ধান্ত নেওয়া এটা কীসের জন্য, শুরু হয়েছে কী থেকে, এবং যেকোনোভাবেই এটা মনখুলে হাসার ব্যাপার হয়ে উঠত না, কারণ অর্থহীনতা এবং অসম্মান সেরকমই জিনিস যা তাকে অবিরামভাবে দমিয়ে রেখেছে, এবং তিনি কিছুর করছিলেন না, একটা তুচ্ছ জিনিস পর্যন্ত করেননি তিনি, স্রেফ গড্ডালিকাপ্রবাহে ভেসেছেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছেন স্প্রাচওয়ানে তার প্রথম গ্লাস স্ট্রেনবার্গটা একপাশে রেখে, যেসময়টাতে তার চারপাশে সবকিছু আসলেই অর্থহীনতায় ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছিল..''
এই ধরনটি, পাঠক লক্ষ করবেন, এতে পর্যবেক্ষণের সঙ্গে মিশেছে দার্শনিকতা (তিনি আগে থেকেই একটি প্রশ্নে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছেন, আদৌ অর্থহীনতার সমস্ত ভারের সঙ্গে অসম্মানের ভারের কোন তফাত আছে, যেটা নিয়ে আসলে তিনি হাসছিলেন) এবং তা উন্নীত হচ্ছে এক অপরূপ কাব্যিকতায়(স্রেফ গড্ডালিকাপ্রবাহে ভেসেছেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছেন স্প্রাচওয়ানে তার প্রথম গ্লাস স্ট্রেনবার্গটা একপাশে রেখে, যেসময়টাতে তার চারপাশে সবকিছু আসলেই অর্থহীনতায় ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছিল)। এভাবে পাঠককে তিনি একটা আবহের মধ্যে টেনে আনেন। নিজের জগতে টেনে আনেন, যে জগৎ বুনন ও বয়ান একান্ত লাসলো ক্রাসনাহোরাকাইয়ের জগৎ।
আমাদের সেই পাঠকদের খুব বেশি ভড়কে দিতে পারবেন না হোরাকাই, যে-পাঠকরা কমলকুমার মজুমদার বা অমিয়ভূষণ মজুমদার বা দেবেশ রায় বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা শহীদুল জহিরের পড়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। ফলে লাসলো ক্রাসনাহোরাকাই হাঙ্গেরীয় লেখক হলেও বাঙালি বা বাংলাভাষী লেখকের দূরবর্তী কেউ আর হয়ে থাকেন না। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ লেখকের মতো তিনি বাংলা আধুনিক কথাসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখকদেরই পাশে আরেকজন হিসেবে হাজির হন মাত্র।