আবেগী ও বুদ্ধিদীপ্ত আলাপের ভ্রমণ

By সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ
16 September 2025, 08:35 AM

রবীন্দ্র-নজরুলকে আমরা পাইনি। কিন্তু, যাদের জীবদ্দশায় পেয়েছি তাদের কি জিজ্ঞাসা করা যায়? কবির মুখোমুখি হয়ে কবিকে বোঝা যায়? আমার প্রিয় কবি কবীর সুমনের ভাষায়—কে বেশি পাগল, কবি না কবিতা—এই প্রশ্নের কি উত্তর হয়? ব্যাপারটা ভাবাটাই মনে হয় সাহসের, ভূত দেখার মতো ভয়ের। যাদুকরের কাছ থেকে যাদুর রহস্য খোঁজার মতো প্রায় নিষিদ্ধ ব্যাপার।

কবি শিমুল সালাহউদ্দিন সেই কাজটিই করেছেন। নবতিপর নীরেন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বাংলা ভাষার বাঘা বাঘা কবিদের সঙ্গে শিমুল এই কৌশল খাটিয়েছেন। পাড়ার ছোটভাই সুলভ আবদারের মতো করে, প্রবল বিনয়ে, আবার একইসঙ্গে বিপুল অনুসন্ধিৎসা ও প্রগলভতা নিয়ে কঠিন কঠিন বিষয়ে সহজে প্রশ্ন করেছেন।

এর ফলে, কবি শিমুল সালাহ্উদ্দিনের যে ব্যক্তি মানুষের বৈশিষ্ট্য, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বলাই যায়, শিমুলের এই গুণটা না থাকলে আসলে এমন একটা বই হয়ই না।

একদিকে লেগে থাকার বিপুল নিষ্ঠা, অন্যদিকে সাক্ষাৎকারের বিষয় নিয়ে বিশদ জ্ঞান, খোঁজখাজ ও পড়াশোনা। এসব দিয়ে তিনি কবিতার জগতের মহিরূহদের ইগো, কিংবা বিপুল ছায়া এড়িয়ে শিকড়ে যেতে পেরেছেন, সেই যাত্রায় আমাদের নিয়ে গেছেন।

কবিতার রাগী মাস্টারমশাই নামে যাকে চিনতাম, সেই নীরেন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করলাম আদুরে, আড্ডাবাজ এক বুড়া দাদু হিসেবে। আদরের নাতির সামনে মেলে ধরলেন নিজেকে। বড্ড আবেগের সঙ্গে জানালেন, কবিতাই আমার মাতৃভাষা। অপকটে বললেন, গদ্য লেখা তিনি ভালোবাসেন না। মনে হয় কবিতা থেকে সময় চুরি করে এগুলো লিখছেন। বারবার বললেন, তার আসলে তেমন একটা কল্পনাশক্তি নেই। তিনি যা লেখেন, সবই বাস্তবের পর্যবেক্ষণ থেকে।

শিমুল তাকে ও আমাদেরকে মনে করিয়ে দেন যে, সেই পর্যবেক্ষণটা কতো গভীর, আর এর ভাষা কতো জোরালো। ভিটগেনস্টাইন যেমনটা বলতেন, তোমার ভাষা যদি তোমার দুনিয়া প্রকাশ করতে না পারে, তাহলে তুমি আসলে দুনিয়া বোঝোইনি। উলঙ্গ রাজা আর অমলকান্তিদের দুনিয়াটা বুঝতে ও বুঝাতে নীরেন্দ্রনাথের সমস্যা হয়নি।

তিনি এও বুঝেছেন, রবীন্দ্রনাথের প্রতি শত বিদ্বেষকারী আসলে তাকেই অনুকরণ করেছেন আর জীবনানন্দকে অনুকরণ করা অসম্ভব। কারণ, তিনি কোনো 'স্কুল অব থট'র সুযোগ রাখেননি। এতো কিছুর পরেও নীরেন্দ্রনাথের কবিতা কিন্তু মেথোডলজিকে অতিক্রম করার বায়বীয় আবেগ দেখায়নি। তিনি কবিতার 'থিম' আর 'কি-ওয়ার্ড' নিয়ে সচেতন থাকতেন। এর গুরুত্ব বুঝতেন।

নীরেন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রাঞ্জল আড্ডায় শিমুলের বইয়ের সুর ঠিক হয়ে যায়। শিমুল বাংলা কবিতার প্রচলিত ইতিহাস লিখতে চলেছেন। বাংলা কবিতার সবচেয়ে উত্তাল রাজনীতি, প্রেম আর বিপ্লবের সময়টাকে ধরতে চেয়েছেন গবেষকের মতো নিষ্ঠায় আর ভক্তের মতো মুগ্ধতায়।

শিমুল সাক্ষাৎকারকে বাঁধাধরা প্রশ্নের ফাঁদে আটকে, ফাঁকিবাজি করে এটাকে এঁদো পুকুর বানাননি। বরং তার বহমান ধারা এটাকে নদীর মতো করে দিয়েছে। যে জিনিসটা পাওয়া যায় আহমদ রফিকের সঙ্গে আলাপে।

খেদের সঙ্গে তিনি বলেন, দুর্ভাগ্য যে তিনি ভাষাসৈনিক হিসেবে যতোটা পরিচিত ততোটা পরিচিত হননি কবি হিসেবে। অথচ তিনি কবিতা লিখেছেন দশকের পর দশক। আহমদ রফিকের মাধ্যমে শিমুল আমাদের সেই দুর্দান্ত যাত্রায় নিয়ে যান। একেবারে '৫২ থেকে সাম্প্রতিক কালের রাজনীতি, গণআন্দোলন, সংগ্রামের অকপট ইতিহাস পাওয়া যায়। এই লেখাটা শুধু কবি নয়, রাজনীতি আর ইতিহাস বুঝতে চাওয়াদের জন্য দুর্দান্ত আকর।

যেমনটা পাওয়া যায় আরেক রফিক, রফিক আজাদের সঙ্গে শিমুলের বিস্তৃত আলোচনায়। গভীর, ছড়ানো কিন্তু আন্তরিক আলোচনা। রাজনীতি, সামাজিক রূপান্তরসহ সাহিত্য, জীবনধারা নিয়ে গুরু-শিষ্য তড়তড় করে এগিয়েছেন। আর কবিতা তো ছিলই।

অন্যদিকে তৃতীয় রফিক, মোহাম্মদ রফিকের আলোচনাটায় পাওয়া গেছে প্রচুর একান্ত ব্যক্তিগত ছোঁয়া, দারুণ আবেগ। সঙ্গে উঠে এসেছে তার পড়াশোনা, প্রাপ্তি আর হতাশা নিয়ে আলাপ, কবিতা নিয়ে নিজস্ব বিশ্বাসের পরম্পরা।

সৈয়দ হক অবশ্য এ স্থলে বিপরীত। তিনি শুরুতেই বলে নেন, শৈশবের কথা বলার ধৈর্য কিংবা ইচ্ছা কোনোটিই তার নেই। কবিকে কাছে নিও না দুঃখ পাবে—বলা কবি অবশ্য এমনটা হবেন, তা আঁচ করাই যায়।

কিন্তু, ড্যাশিং ও স্মার্ট সৈয়দের সঙ্গে শিমুল যেন মাটি ছেড়ে একেবারে শহুরে কায়দায় চেপে ধরেছিলেন। ফলে তিনিও খোলাসা করেন অনেক কিছুই। শেষতক এই সাক্ষাৎকারটা খুবই জরুরি ও প্রাঞ্জল হয়ে উঠে।

জরুরির কথা বললে অরুণাভ সরকার আর মৃদুল দাশগুপ্তের সঙ্গে আড্ডা দুটির কথা বলতে হয়। দুজনই সম্ভবত বাকিদের মতো এতো লাইমলাইট পাননি। কিন্তু অরুণাভের জীবন সংগ্রাম আমরা—শহুরে শিক্ষিতরা—বেশ মেলাতে পারি। শহুরে মধ্যবিত্ত কবির প্রবল হতাশা আর জীবনের সঙ্গে প্রবল যুদ্ধের ছবি উঠে আসে।

আরেক ধরনের যুদ্ধ উঠে আসে আব্দুল মান্নান সৈয়দের সঙ্গে আড্ডায়। কবিদের মধ্যে তিনি সম্ভবত মননের দিক দিয়ে ইউরোপীয়, অস্তিত্ববাদী। তার পুরো আড্ডাটা তাই যেন অনেকটাই মেলাংকলি, ধূসর। হুট করে অন্য লেখাগুলো পড়তে পড়তে এটি পড়ার সময় পাঠক একটা ধাক্কা খাবেন। এই স্থলে বলে রাখি, সম্ভবত পুরো বইয়ে এই অধ্যায়টার প্রতি আমার একটা বাড়তি পক্ষপাত থাকবে। হয়তো নিজের সঙ্গে অনেকটাই সংযোগ করা যায় বলে।

সমালোচনাটা শেষের জন্যই জমিয়ে রেখেছিলাম। শিমুলের সঙ্গে আল মাহমুদের সাক্ষাৎকারটা সম্ভবত তার জীবনের শেষ সাক্ষাৎকার। কিন্তু, বাংলা ভাষার অন্যতম শক্তিমান কবি, শিমুলের বয়ানেই তার প্রিয়তম কবির প্রতি তিনি সুবিচার করতে পারেননি।

মাহমুদের কবিতা আর রাজনীতি ও প্রগতিশীল পাড়া থেকে যে পরিমাণ আঘাত তিনি পেয়েছেন, সেগুলো নিয়ে শিমুল কবিকে যথেষ্ট উন্মুক্ত করতে পারেননি বলেই প্রতীয়মান হয়। কবির সে সময়ের বার্ধক্যজনিত অসুস্থতাও এর একটা কারণ হয়ে থাকতে পারে।

যেমনটা তিনি পারেননি জয় গোস্বামী বা সুবোধ সরকারের বেলাতেও। হয়তো তারা ভারতীয় বলে একটা জড়তা শিমুলের ছিল। আগের কিছু অধ্যায়ে যে গভীরে যাওয়ার প্রয়াস, তা পাওয়া যায়নি এই দুই আলাপে।

ফরহাদ মজহারের সঙ্গেও তিনি আরও গভীরে যাবেন বলে আশা ছিল। হয়তো ফরহাদ ভাইয়ের পাণ্ডিত্য সেখানে বাঁধা হয়েছে। তবে ফরহাদ ভাইয়ের সে সময় পর্যন্ত প্রকাশিত প্রত্যেকটা কবিতার বই নিয়ে ঐতিহাসিক আলাপই শিমুল করেছেন।

তবে মানতেই হয়, শিমুলের এই বইটা খুবই দারুণ ও জরুরি। ইন্টারভিউ কীভাবে নিতে হয় তা তিনি জানেন, সেগুলো কীভাবে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে হয় তা বোঝেন। কবিতা না বোঝা আমিও বেশ একটা সুন্দর যাত্রা পেলাম। কে জানে, এই সাক্ষাৎকারের বইটা পড়লে প্লেটোও হয়তো তার আদর্শ রাষ্ট্র থেকে কবিদের বিতাড়িত করার চিন্তাটা বাদ দিয়ে দিতেন।

লেখক ও সাংবাদিক