ঢোলের তালে বেঁচে থাকা শৈলেন্দ্রদের গল্প

মিন্টু দেশোয়ারা
মিন্টু দেশোয়ারা
24 September 2025, 08:35 AM
UPDATED 25 September 2025, 10:24 AM

শৈলেন্দ্র চন্দ্র দাস একজন ঢোলের কারিগর। বয়স তার ৭৯ বছর। শৈলেন্দ্রের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঢোল তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তার দোকানে গ্রামীণ বাদ্যযন্ত্রের সমাহার। যার বেশিরভাগ বানানো হয়েছে গরু ও ছাগলের চামড়া দিয়ে। পাশাপাশি তৈরি করেন খোল, তবলা, হারমোনিয়ামসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র।

শৈলেন্দ্র চন্দ্র দাস দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আগে বাবা, মা ও দাদার সঙ্গে কাজ করতাম। এত বেশি কাজ থাকত যে, পাঁচ-ছয় জন মিলেও শেষ করতে পারতাম না। আর এখন বছরে দুই থেকে তিন মাস কাজ থাকে। এতে আর পেট চলে না।'

dhol3.jpg
তবলা, ডুগি। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা

শৈলেন্দ্রের ভাষ্য, 'আগে রাস্তা দিয়ে হাঁটলেই লোকে আমাদের চিনত, ডাকত। এছাড়া প্রায় সবার ঘরে বিভিন্ন রকমের বাদ্যযন্ত্র ছিল। শ্রীমঙ্গল থেকে রাজঘাট পর্যন্ত হেঁটে গেলে হাজার থেকে পনের শ টাকা আয় করা যেত। মানুষের ঘরে ঘরে ঢোল মাদল ছিল। আর এখন তিন গ্রাম মিলে একটি ঢোল পাওয়া মুশকিল।'

'আগে ঢোল ছানি (ছাউনি) বাবদ একশ টাকা নিলেও পুষিয়ে যেত। অনেক মানুষ কাজ করাত। তা দিয়েই আমাদের পুষে যেত। কিন্তু এখন ঢোল ছানি বাবদ দুই হাজার টাকা নিলেও পোষায় না। এখন মানুষের আগ্রহ কমে গেছে। তবু জীবনের পুরো সময় এই কাজের সঙ্গে আছি। তাই পেশার প্রতি মায়া জন্মেছে, শেষ বয়সে ছেড়ে যেতে চাইছি না,' বলেন তিনি।

তিনি জানান, আমার দুই ছেলে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে এখন একজন সেলুনে কাজ করেন, আরেকজন রাজমিস্ত্রি।

dhol5.jpg
খোলের কাজ করছেন কারিগর আশুতোষ ঋষি। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা

শৈলেন্দ্রের পাশেই বসা ছিলেন আরেক কারিগর আশুতোষ ঋষি। তিনিও এখনো বাপ-দাদার পেশায় ধরে রেখেছেন।

তিনি বলেন, 'বাজার মন্দা, কাজ নেই। আমরা সরকারি কোনো সহযোগিতা পাই না। যদি কোনো সহযোগিতা পাই, তাহলে আবারও প্রাণ ফিরে পাবে এই শিল্প।'

আশুতোষ জানান, পূজা ঢাকঢোলের কদর বাড়ে। আমরা এখনো বাপ-দাদাদের পেশা ধরে রেখেছি। আগে অনেক কাজ ছিল। আর এখন প্রযুক্তির আধুনিকতায় বছরের দুই থেকে তিন মাস কাজ থাকে। তাই জীবিকার তাগিদে অনেকে এই পেশা ছেড়ে নতুন পেশা বেছে নিয়েছেন।

এদিকে শ্রীমঙ্গল উপজেলায় শহরে চলেছে কাপড় কেনার ধুম। তবে নতুনবাজারের একটি গলির দিয়ে ঢুকে দেখা গেল, সেখানে কোনো ব্যস্ততা নেই। দক্ষিণ পাশের সারি ধরা দোকানের একটিতে বিভিন্ন আকার ও রঙের অনেকগুলো ঢোল ওপর-নিচ করে সাজিয়ে রাখা। তার এক পাশে বসে সুতা দিয়ে ঢোল বাঁধাইয়ের কাজ করছিলেন দুই থেকে তিনজন কারিগর।

dhol2.jpg
এখনো টিকে কাছে কয়েকটি বাদ্যযন্ত্রের দোকান। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা

দুর্গা পূজাসহ বিভিন্ন উৎসবে ঝিমিয়ে পড়া ঋষিপাড়ার কারিগররা যেন কিছুটা প্রাণ ফিরে পান। তবে, তারা সঠিক মজুরি পান না।

অথচ এক সময় এ শিল্পের চাহিদা ছিল জেলাব্যাপী। জেলা ছাড়াও পাশের বিভিন্ন জেলা থেকে এখানে বাদ্যযন্ত্র কেনা ও মেরামতের জন্য ভিড় জমত। আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের আবির্ভাবে ভাটা পড়ে এ শিল্পে।

এখনো বানানো বাদ্যযন্ত্রগুলো নিম ও আম গাছের তৈরি। ঢাকঢোল, তবলা, খোলসহ নানা ধরনের দেশি বাদ্যযন্ত্র। গুণগত মান ও আকার হিসেবে এসব বাদ্যযন্ত্রের দর নির্ধারণ হয়। ঢাকঢোল বিক্রি হয় ৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। তবলা ৩ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা।

dhol4.jpg
ঢোলের কাজ করছেন একজন কারিগর। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা

তিনি বলেন, 'এখানে আগে আরও দোকান ছিল। কিন্তু এখন মাত্র তিনটি দোকান টিকে আছে। কালের বিবর্তনে হুমকির মুখে তাদের এ পুরনো পেশা। বছরে মাত্র দু-তিন মাস কাজ থাকে, বাকি নয়-দশ মাস কর্মহীন বসে থাকতে হয়।'

জানতে চাইলে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. সোয়েব হোসেন চৌধুরী বলেন, 'আমরা আমাদের হায়ার অথরিটিকে পাঠিয়েছি। পাশাপাশি আমরা তাদের খোঁজখবর রাখছি।'