হারিয়ে যাওয়া শীতের পিঠাপুলির দিনগুলো
আগেকার মতোন কুয়াশাঘেরা নভেম্বর না এলেও, 'নভেম্বর রেইন' দিয়ে শীত-শীত আমেজ শুরু হয়েছে। ইশকুলবেলার মতোন উলের সোয়েটার পরে, বাড়ির বড়দের টিনের ওয়েল কনটেইনার বা নব্বই দশকের পমেডের প্রচলন এখন শুধু আমাদের আড্ডাতেই শোনা যাবে। আড্ডা দিতে দিতে হয়তো পুঁজিবাদের এই বাজার থেকে নভেম্বরের পিঠা কিনে খাওয়া হবে। যেগুলো এক সময় ঘরে আয়োজন করে বানানো ছিল আমাদের শীতকালের অংশ। সে সময় শীত মানেই ছিল খেজুরের গুঁড় আর ধোঁয়া ওঠা মিষ্টি ঘ্রাণের নানান পিঠাপুলি।
ছোটবেলায় শীত এলেই আমরা মুখিয়ে থাকতাম পিঠা বানানোর দিনের জন্য। আগের দিন থেকেই মা চাল ধুয়ে শুকিয়ে বেঁটে রাখতেন। এখনকার মতোন চাইলেই চালের গুঁড়ো বাজারে অত সহজে মিলত না। নানু বাড়ি থেকে আসতো 'স্বাস্থ্যকর' এবং 'নির্ভেজাল' গুঁড়। ভাঁপা, পাটিসাপটা, চিতই, নারিকেল-পাটালি ভরা দুধপিঠা—সবকিছু মিলিয়ে যেন ছিল বাসায় এক উৎসব। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম।
আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল খেজুরের গুঁড় দেওয়া ভাপা পিঠা। মা যখন গরম গরম পিঠা সাজিয়ে রাখতেন, তখন যেন মনে হতো শীতের সকালের সমস্ত সুখ সেখানে মুড়ে আছে। সেই গরম পিঠার সঙ্গে যে আনন্দ, চাল বাঁটা থেকে শুরু করে চুলার পাশে দাঁড়িয়ে, কত পরিশ্রম করে অবশেষে সেই কষ্টসাধ্য পিঠার স্বাদ নেওয়া, তা আজকের ফাস্টফুডে কোথায়!
পিঠা তখন শুধু খাবার নয়, প্রতিবেশীদের সঙ্গে যোগাযোগের একটা উৎসও ছিল। শো-কেসে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা অনেক শখের বাটিতে সাজিয়ে, সেই পিঠা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল আমার। আজ ফ্ল্যাট-বাড়িতে সেই পুরোনো ভাড়া বাড়িগুলোর রীতিনীতি আর নেই। আমাদের আমুদে শীতকালীন বিকেলগুলোতে এখন বড্ড ব্যস্ততা। শহরের ব্যস্ত জীবনে সেই পিঠাপুলির দিনগুলো যে হারিয়ে গেছে, তা আর রাখঢাকের নেই।
এখনকার শিশুরা জানে না পিঠা বানানোর আনন্দ কেমন, পাটালি গুড়, আতপ চাল ভিজিয়ে রেখে, চিনির দানার মতোন মিহি করে, কিংবা পাকন পিঠায় সবাই গোল হয়ে বসে নকশা করবার কী আমেজ! আজকের প্রজন্ম পিঠাপুলি চেনে অনলাইনের নানান পেজের মাধ্যমে। তাও ভালো। জানি না, আমরা যেমনটা বাংলা বইয়ে গদ্য পড়তাম এই পিঠার আমেজ নিয়ে, তেমনটা এখনকার পাঠ্যবইয়ে আর আছে কি না! আমাদের সময় এই সামান্য খাবারগুলোই আমাদের ঘর, পরিবার, শৈশব—সব কিছুকে একসঙ্গে বেঁধে রাখত।
কাজের চাপ, সময়ের অভাব—সব মিলিয়ে উৎসবগুলোও সংকুচিত হয়ে গেছে। কার এখন এত সময় আছে, সময় নিয়ে দাঁড়িয়ে পিঠা বানাবে! তবু, যখন শীতের বিকেল-সন্ধ্যায় রাস্তার পাশে ভাপা পিঠার দোকান দেখি, অন্তত ভালো লাগে যে পুরোপুরি রেস্তোরাঁ আর দেশ-বিদেশের কুইজিনের ভিড়ে উনুনে, ভাপে বানানো পিঠা হারিয়ে যায়নি।
শীত তো প্রতি বছরই আসে, কিন্তু আগের মতো অবশ্যই না। এখন বার্ষিক পরীক্ষা নেই, ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার তাড়া নেই। সব থেকে বড় কথা শীত আর কুয়াশাই নেই এই শহরে। এখন শীত মানেই অফিসের ব্যস্ত সকাল, গরম কফির কাপ আর ক্যালেন্ডারে ডেডলাইন। রান্নাঘরে মাটির চুলা নেই, আছে মাইক্রোওয়েভ ওভেন। সময় বাঁচে ঠিকই, কিন্তু সেই ঘ্রাণটা আর পাওয়া যায় না। পিঠা এখন বাজারে তৈরি হয় প্যাকেটের মধ্যে বন্দি, ফ্রিজে রাখা 'ইনস্ট্যান্ট' খাবার হিসেবে। কিন্তু সেই খাবারে নেই মায়ের হাতের উষ্ণতা, নেই দাদির গল্পের সুর
তারপরেও অক্টোবরের শেষ থেকে সেই হারিয়ে যাওয়া দিনের পিঠার সুবাস, যা শুধু ঘ্রাণ নয়, আমার শৈশব, আমার ঘর, আমার মানুষগুলোর স্মৃতি বয়ে নিয়ে আসে। আর আমি যেন এখনো শুনতে পাই সেই ডাক, 'পিঠা হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি না খেলে পরে পাবি না'!

