ছেঁড়া জিন্স: দ্রোহ থেকে ফ্যাশনে

আখিউজ্জামান মেনন
আখিউজ্জামান মেনন
28 March 2023, 06:45 AM
UPDATED 28 March 2023, 15:28 PM

ঊনবিংশ শতাব্দীতে শ্রমিক শ্রেণির মানুষেরা ডেনিম জিন্সের ব্যবহার শুরু করে। তারপর থেকে ডেনিম জিন্স সময়ের দীর্ঘ পরিক্রমায় বারবার বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য এক উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বিগত দেড় শ বছর ধরে ডেনিম জিন্স টিকে আছে প্রবলভাবে। ব্যবহৃত হয়েছে সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে দ্রোহের প্রতীক হিসেবে। অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েছে ফ্যাশনের।  

আমেরিকায় যখন শিল্পায়নের স্রোত জাগে, নগরায়নের ঢেউ ওঠে, গ্রামের মানুষেরা তখন বড় বড় শহরে ভিড় করে। তারা শুনতে পায় শহরে একের পর এক কারখানা বসছে। সেখানে গেলেই জুটবে নিশ্চিত চাকরি। তাই তারা ভিড় করে শহরে শহরে। 

চাকরি তাদের ঠিকই জোটে, তবে সেই চাকরি শরীরের ঘাম নিংড়ে নেয়, অস্থি মজ্জায় কাজের চাপ অনুভূত হয়। কাজের চাপ আরও দৃশ্যমান হয় সুতির প্যান্টে। জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া দৃশ্যমান হয়। মাস শেষে বেতন মেলে ঠিকই, তবে তা যৎসামান্য, নতুন পোশাক কেনার সামর্থ্য হয় না।

capture.jpg

এমন প্রেক্ষাপটে তাদের মাঝে প্রচলন ঘটেছিল নতুন এক প্রকারের ডেনিম জিন্সের ব্যবহার। ১৮৭৩ সালে লেভি স্ট্রস এবং জ্যাকব ডেভিস নতুন এক ধরনের জিন্সের প্যাটেন্ট নেয়। তাদের প্যাটেন্ট নেওয়া জিন্স তৈরি হয়েছিল বেশ শক্ত কিন্তু আরামদায়ক ডেনিমে এবং তাদের নকশার ডেনিম জিন্সে সংযুক্ত ছিল তামার রিভেট আর চামড়ার ট্যাগ। ডেনিম জিন্সের এমন বাহার তখনকার সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এবং অন্যান্য জিন্সের থেকে ডেনিম জিন্সের আকর্ষণীয় ভিন্নতা সবার চোখে পড়ে যেত অতি সহজে। 

নিজদের ডেনিম জিন্সে স্ট্রসদের তামার রিভেট সংযুক্ত করায়, তাদের ডেনিম জিন্স অনেক বেশি টেকসই ছিল। যে কারণে বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রমিকদের মাঝে তাদের জিন্স বেশ জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৮০ সালে স্ট্রস ও ডেভিসের প্যাটেন্ট মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে অনেকগুলো ব্র‍্যান্ড তাদের অনুকরণ করে জনপ্রিয় সব জিন্সের নিজেদের সংস্করণ তৈরি করতে শুরু করে। 

তখন পর্যন্ত জিন্সে ছেঁড়া থাকার বিষয়টা ফ্যাশনে রূপান্তরিত হয়নি। ছেঁড়া-ফাটা যা দেখা যেত তা পূর্বেকার আলোচনায় আসা শ্রমিকদের পরিধেয় কাপড়ে অধিক শ্রমসাধ্য কাজে নিযুক্ত হওয়ার চিহ্ন। তখনকার সময়ে কোন ব্যক্তির পরিধেয় জিন্সে ছেঁড়া থাকা মানে সেই ব্যক্তি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিবেচিত হতো শ্রমিক শ্রেণির অন্তর্গত হিসেবে।

ডেনিম এবং নীল জিন্স ফ্যাশন হিসেবে জনপ্রিয় হতে শুরু করে ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে।

দশক দুটিতে ওয়েস্টার্ন চলচ্চিত্র 'কাউবয় জীবনকে' দেখছে রোমান্টিক লেন্স দিয়ে। জন ওয়েইনের মতো তুমুল জনপ্রিয় অভিনেতা সেই জীবনকে ফুটিয়ে তুলছে। ওয়েইনদের মতো অভিনেতাদের পরহিত ডেনিম পোশাক বারবার করে উঠে আসছে রূপালি পর্দায়। যা হলিউডের স্বর্ণযুগের ওই দুই দশকে ডেনিম ও নীল জিন্সকে জনপ্রিয় করতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। 

চলচ্চিত্র জিন্স জনপ্রিয় করতে যেমন ভূমিকা রেখেছিল, তেমনি আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর 'রেবেল উইদাউট ও কজ'-এর মতো ছবিতে জিন্সের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টিতেও ভূমিকা ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী দশকও হয়ে উঠেছিল বেশ রক্ষণশীল। জিন্সের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছিল উশৃংখলতা ও উগ্রতাকে। 

জিন্সের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব ১৯৬০-এর দশকেও চলমান থাকে। জিন্সসহ অন্যান্য বহু বিষয়ের প্রতি তৎকালীন মূলধারার সমাজ নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করতো। যা সে সময়কার তরুণ প্রজন্ম মানতে রাজি হয়নি। 

মূলধারার সমাজের রক্ষণশীল মনোভাবের প্রতি তরুণদের দীর্ঘদিনের পুষে রাখা ক্ষোভ থেকে তৎকালীন সময়ে জন্ম নেয় দ্রোহের এক আন্দোলন। হিপ্পি আন্দোলন। 

হিপ্পি আন্দোলনে অংশ নিয়ে তরুণ প্রজন্ম মূল স্রোতের কোপানলে দগ্ধ সব উপাদানকে আলিঙ্গন করে নিতে থাকে। তার মধ্যে বড় উপাদান ছিল জিন্স। 

আন্দোলনের মূল লক্ষ্য প্রতিষ্ঠাবাদ ও শ্রেণি নিষ্পেষণের বিরোধিতা, তাই তারা শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়। বেছে নেয় ঐতিহাসিকভাবে শ্রমিকদের পোশাক জিন্সকে। বিনির্মাণ ভাবনায় উজ্জীবিত তরুণদের অনেককে এ সময়ে দেখা গেছে নিজেদের জিন্সে ছবি, খণ্ড কাপড়ও জুড়ে দিতে।

তবে ফ্যাশন দাবি হিসেবে ছেঁড়া জিন্স তখনো প্রতিষ্ঠা পায়নি। ১৯৭৩ সালে ডিজাইনার ভিভিয়েন ওয়েস্টউড এবং ম্যালকম ম্যাকলারেন লন্ডনে লেট ইট রক নামের দোকান একটা চালু করে। যেখানে মূলস্রোত যাকে ফ্যাশন হিসেবে মানতে চাচ্ছিল না, সে সবকে জায়গা করে দিচ্ছিল। পোশাকে দেখা যাচ্ছিল ইচ্ছাকৃত ছেঁড়ার, স্লোগান, দাগ, সেফটি পিনের উপস্থিতি। 

লেট ইট রক দোকানের আদলে আরও বহু দোকানে, স্থানে, ব্যক্তির ফ্যাশন চেতনায় ব্যাপকহারে নৈরাজ্যের প্রতীক হিসাবে বিবেচিত ধারণা সমূহের সংযোগ ঘটছিল পুরো ৭০-এর দশকজুড়ে।

এই দশকেই দ্রোহ, প্রথাবিরোধীতার প্রতীক হিসেবে পোশাকে ছেঁড়া-ফাটা, চেরা, ছিদ্রের উপস্থিতি স্বকীয়তা অর্জন করে। যেই স্বকীয়তা ভিন্ন মাত্রা, গতি ও জনপ্রিয়তা পায় যখন সংগীতের পাংক রক আন্দোলন তাকে আলিঙ্গন করে নেয়। ছেঁড়া জিন্স তখন হয়ে ওঠে প্রথা ও কর্তৃত্ব বিরোধীতার সমার্থক শব্দ। 

১৯৮০-এর দশকে দেখা যায় বিলাসিতাকে পুঁজি করে গড়ে ওঠা বিভিন্ন ব্র‍্যান্ড তাদের ফ্যাশনের অংশ হিসেবে ছেঁড়া জিন্সকে গ্রহণ করে নিয়েছে। বিখ্যাত সব ডিজাইনার ছেঁড়া, স্টোন ওয়াশ, এসিড ওয়াশ জিন্স বানাতে শুরু করে। 

পরবর্তী দশগুলোতে ফ্যাশনে নানা মাত্রা যোগ হলে ছেঁড়া জিন্স একক আধিপত্য হারায়। তবে আবির্ভাবের পর থেকে এযাবৎ পর্যন্ত সব সময়ই দ্রোহের, চাপিয়ে দেওয়া প্রথা, রীতি বিরুদ্ধ প্রতীক হিসাবে ছেঁড়া জিন্স বিবেচিত হয়েছে। 

তথ্যসূত্র: এমটিএসইউসাইডলাইন, মেকারসভ্যালি.নেট