মমতার শহরে মেসিকে নিয়ে মহাকেলেঙ্কারি: দায়ী কে, প্রভাব কী?

By স্টার অনলাইন ডেস্ক
15 December 2025, 09:20 AM
UPDATED 15 December 2025, 15:55 PM

একদিনে দুটি ঘটনা। প্রথমটি ভারতের কলকাতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের। স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১১টা। অপরটি হায়দরাবাদের রাজীব গান্ধী আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের। সময় রাত সাড়ে ৮টা। দুটি ঘটনার মধ্যে প্রথমটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের নজর কেড়েছিল একটু বেশি।

গত ১৩ ডিসেম্বর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রথম ঘটনার ভিডিওগুলোয় দেখা যায়—কলকাতার মেসি ভক্তরা কাকভোরে এসে হাজির হোন স্টেডিয়াম চত্বরে। সাত সকালেই স্টেডিয়াম ভরে যায় কানায় কানায়। সবাই ধৈর্য ধরে, অধীর আগ্রহে বসে থাকেন বিশ্ব ফুটবলের মহারাজের মহা-আগমনের অপেক্ষায়।

মেসিভক্তদের অনেকে গণমাধ্যমকে জানালেন—তারা এসেছিলেন দূর দূরান্ত থেকে। অনেকে এসেছেন কাছে-দূরের রাজ্যগুলো থেকেও। কেউ আবার প্রায় ৩০ ঘণ্টা ট্রেন ভ্রমণ করে কলকাতায় এসেছেন শুধু মেসির মুখ দর্শনের জন্য।

কেউ কেউ বললেন—মাসের পর মাস টাকা জমিয়ে মেসিকে দেখার টিকিট কিনেছিলেন তারা। কেউ জানালেন, এক মাসের বেতনের পুরো টাকাটা মেসিকে দেখার জন্য খরচ করেছেন। কেউ জানালেন, দুই মাসের বেতনের টাকা দিয়ে টিকিট কেনার কথা। কেউ জানালেন, ইএমআই করে টিকিট কিনেছেন শুধু মেসিকে দেখার জন্যই।

আরও কত কত মানুষের কত শত অভিজ্ঞতা! সবই লিওনেল মেসিকে ঘিরে।

স্থানীয় সংবাদকর্মীদের ভাষ্য—যুবভারতীতে মেসি আসলেন সকাল সাড়ে ১১টার দিকে। গাড়ি থেকে নামার পরপরই তাকে ঘিরে ধরেন প্রভাবশালী, ক্ষমতাবান-ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও তাদের আত্মীয়-স্বজন এবং সাঙ্গপাঙ্গরা। গণমাধ্যমে কথা বলতে গিয়ে তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা ওই ব্যক্তিদের এক শব্দে বোঝাতে 'হ্যাংলা' ব্যবহার করেন।

messi_in_kolkata.jpg
ছবি: এএফপি

এক বিক্ষুব্ধ দর্শক গণমাধ্যমকে বলেন, 'হ্যাংলারা মেসিকে ঘিরে ধরেছিলেন। তারা তার সঙ্গে সেলফি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাদের কারণেই মেসিকে দেখতে পারিনি। তারাই সবকিছুর জন্য দায়ী।'

মেসিকে দেখার জন্য সেদিন প্রায় ৫০ হাজার ভক্ত যুবভারতীতে জড়ো হয়েছিলেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করেছেন। তারা সংবাদমাধ্যমগুলোকে জানান—মেসি মাঠে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাকে একদল মানুষ তাকে ঘিরে ফেলে। মেসির নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মীর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও ছিলেন সেখানে।

আরও জানান—দর্শকরা মাঠে দেখতে পেলেন একদল মানুষের মাথা। আর অনেকগুলো 'পরিচিত মুখ'। অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের 'মহাক্ষমতাধর' ব্যক্তিদের মুখচ্ছবি।

মেসিকে এক নজর দেখার দাবি নিয়ে গ্যালারিতে যখন চাপা উত্তেজনা তখনই তাকে নিয়ে ঝড়ের বেগে মাঠ ছাড়েন আয়োজকরা। সব মিলিয়ে বড়জোর ১৫ মিনিট।

এই দৃশ্য দেখে দর্শকের চাপা ক্ষোভ বিস্ফোরণের রূপ নেয়। 'প্রতারিত' হওয়ার ক্ষোভ নিয়ে তারা নেমে পড়েন মাঠে।

তারপর যা ঘটে তা দেখেছে বিশ্ববাসী। যুবভারতী পরিণত হয় 'রণক্ষেত্রে'। সাজানো-গোছানো স্টেডিয়ামটি লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। ক্ষুব্ধ দর্শকরা গ্যালারির চেয়ার ভেঙে মাঠে ছুড়তে থাকেন। সেগুলোর আঘাতে আহত হন নিরাপত্তাকর্মীসহ অনেকে।

এতেও ক্ষান্ত হননি বিক্ষুব্ধ জনতা। তারা নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে ঢুকে পড়েন মাঠের ভেতর। হাতের কাছে যা পান তাই ভেঙে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা। টিকিটের ক্ষতিপূরণ হবে ভেবে কেউ কেউ নিয়ে যান স্টেডিয়ামের জিনিসপত্র।

স্থানীয় আনন্দবাজারের শিরোনাম হয়—'বিশ্বমঞ্চে কলকাতার মাথা হেঁট!' দ্য সিটি অব জয় হিসেবে খ্যাত এই শহরটি যে বড় অনুষ্ঠান আয়োজনে 'ব্যর্থ' সে কথাও জানিয়ে দেওয়া হয় শিরোনামেই।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়—শুধু মেসি নয়, তার সফরসঙ্গী লুইস সুয়ারেজ ও রদ্রিগো ডি'পলকেও দেখতে পাননি দর্শকরা।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাঠে পৌঁছানোর আগেই জানতে পারলেন সেখানকার হট্টগোলের সংবাদ। মাঝপথেই ফিরে যান তিনি। নিরাপদ জায়গায় বসে সমাজমাধ্যমে পোস্ট দিয়ে মেসির কাছে 'ক্ষমা' চান মমতা।

এবার দৃষ্টি ফেরানো যাক হায়দরাবাদের দিকে।

একই দিন। স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ৮টা।

কোটি ভক্তের প্রাণপুরুষ মেসিকে দেখা গেল হায়দরাবাদের রাজীব গান্ধী আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে। শুধু তাই নয়, তাকে ফুটবল খেলতে দেখা গেল আলফা প্রজন্মের এক শিশুর সঙ্গেও।

সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেল, সেখানে প্রায় ৫৫ হাজার দর্শক সমবেত হয়েছিলেন। টেলিভিশনের ধারাভাষ্যে এত সুন্দর আয়োজনের পাশাপাশি সঠিকভাবে সবার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার জন্য আয়োজকদের বারবার ধন্যবাদ জানানো হয়।

yuba_bharati_0.jpg
ছবি: এএফপি

দায়ী কে?

অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছে 'শতদ্রু দত্ত ইনিশিয়েটিভ'। আয়োজক প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার শতদ্রু দত্ত পেশায় একজন স্পোর্টস প্রমোটার ও ইভেন্ট অর্গানাইজার। এর আগে তিনি ফুটবল কিংবদন্তি পেলে ও ম্যারাডোনাসহ ক্রীড়াজগতের অনেক মহারথীকে ভারতে এনেছিলেন।

১৯৯৪ বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল দলকেও তিনি ভারতে নিয়ে এসেছিলেন। তার আয়োজনে মেসির ভারত সফর ভারতের ইতিহাসে মাইলফলক হতে চলেছিল।

কিন্তু,  মেসির সফরকে ঘিরে ঘটে যাওয়া 'মহাকেলেঙ্কারি'র পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনার দিনই শতদ্রুকে কলকাতা বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

১৪ ডিসেম্বর আদালতে শতদ্রু দত্ত আইনজীবীর মাধ্যমে জানালেন—মাঠে কী হয়েছে, সেই দায় তার নয়। তিনি সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করেননি। তবে তার জামিন আবেদন খারিজ হয়েছে। তাকে পাঠানো হয়েছে ১৪ দিনের পুলিশি হেফাজতে।

শতদ্রু দত্ত গ্রেপ্তার হওয়ায় ধরে নেওয়া যেতে পারে তিনিই মূল আসামি বা দায়ী ব্যক্তি। কিন্তু, দর্শকদের অনেকের অভিযোগ—যখন কোনো অপরাধে ক্ষমতাসীনরা জড়িত থাকেন তখন প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আর তখনই 'বলির পাঁঠা' বানানো হয় কোনো একজনকে।

'যারা মেসির আশপাশে ঘুরঘুর করছিলেন তাদের ক্ষমতা অনেক'—এমন কথা বলেও অনেকে ক্ষোভ ঝেড়েছেন। 'প্রকৃত অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে'—বলেও আক্ষেপ করেছেন অনেকে।

কেউ কেউ বলেছেন—'মুখ্যমন্ত্রীর কাছের মানুষদেরকেই তো মেসির পাশে দেখা গেল!'

গণমাধ্যমে দর্শকরা বারবার বলছিলেন যে মেসি-ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে তাদের সঙ্গে 'প্রতারণা' করা হয়েছে। তাদের কষ্টার্জিত টাকা বিফলে গেছে। অনেকে বলছেন, টিকিটের দাম 'পাঁচ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা'। কেউ কেউ নাকি আরও বেশি টাকায় টিকিট কিনেছিলেন, একটু কাছে থেকে মেসিকে দেখার জন্য।

টিকিট নিয়ে কালোবাজারির অভিযোগও ছিল বিস্তর।

ভোটবাক্সে প্রভাব?

কথা ছিল—মেসি আসবেন। মাঠ মাতাবেন। তাকে বাঙালি পোশাক পরানো হবে। থাকবে বাঙালি খাবারের আয়োজন। মেসির সঙ্গে থাকবেন বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খানও। সেই হিসাবে টিকিটের দাম অনেকের কাছে ছিল 'ধরা-ছোঁয়া'র বাইরে। তবুও অনেকে অনেক কষ্টে টাকা জমিয়ে টিকিট কিনেছিলেন মেসি বিজ্ঞাপনে 'বশীভূত' হয়ে।

গরিবের সেই টাকা গেল ধনীর পকেটে। গরিব মেসিভক্তরা 'প্রতারিত' বোধ করলেন। তাদের ক্ষোভ উগড়ে দিলেন যুবভারতীর মাঠে।

তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে পশ্চিমবঙ্গের তথা ভারতীয় বাঙালিদের অভিভাবক ভাবেন। তার দল গত ১৪ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায়। সেই হিসাবে কলকাতাকে 'মমতার শহর'ও বলেন কেউ কেউ। রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেকে মমতাকে মনে করেন কলকাতা মহানগরের অভিভাবক।

তার শহরে যখন লিওনেল মেসির মতো মহাতারকাকে নিয়ে এমন মহাকেলেঙ্কারি ঘটে যায়, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তা ফলাও করে প্রচারিত হয়, তখন এর প্রভাব আগামীতে ভোটের বাক্সে পড়বে বলে আওয়াজ তুলেছেন মমতাবিরোধীরা।

এক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের প্রশ্ন—বাঙালির অস্মিতা বা অহংকার নিয়ে যে নেত্রী এত কথা বলেন তার শহরে তারই আত্মীয়স্বজনদের হাতে যখন বাংলা অপমানিত হলো তখন তিনি কেন ঘটনাস্থলে না গিয়ে, সমস্যার সমাধান না করে উল্টো ফিরে গেলেন?

তার মতে, যারা মেসিকে দেখার জন্য টিকিট কিনে 'প্রতারিত' হয়েছেন তারা যদি আগামী বিধানসভা নির্বাচনে দিদির কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

অপর একজন মনে করেন, আগামী ভোটের মাঠে অনেকেই তৃণমূল প্রার্থীদের দেখে 'মেসিকে নিয়ে লোক ঠেকানো'র প্রসঙ্গটি তুলতে পারেন। এমন হলে নতুন করে হট্টগোল বাধার আশঙ্কা থাকবে। দিন শেষে তা তৃণমূলকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে বিশ্বাস করেন তিনি।

এ ছাড়াও, মমতাবিরোধীদের অনেকে ইতোমধ্যে বলতে শুরু করেছেন—দিদির শহরে, দিদির শাসনামলে, দিদির অনুগতদের দ্বারা হাজারো মানুষ প্রতারিত হয়েছেন। তারা এখন বড় সমাবেশের আয়োজন করতে ভয় পাবে। ভোটের বছরে তা বিরোধী প্রার্থীদের পালে বাড়তি হাওয়া যোগাতে পারে বলে মন্তব্য অনেকের।