জলবায়ু অর্থায়নেই নতুন ঋণফাঁদ, ‘উচ্চ ঝুঁকির’ তালিকায় বাংলাদেশ

পিনাকী রায়
পিনাকী রায়
11 November 2025, 10:36 AM

প্যারিস চুক্তিতে জলবায়ু ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার দশ বছর কেটে গেছে। এখন বিশ্বনেতারা ব্রাজিলের বেলেম শহরে কপ৩০ সম্মেলনে মিলিত হয়েছেন। কিন্তু আলোচনার এই সময়ে স্পষ্ট হচ্ছে—পৃথিবীতে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম দায়ী দেশগুলোর একটি বাংলাদেশই আজ সবচেয়ে গভীর জলবায়ু-ঋণের ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে।

ঢাকাভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ সম্প্রতি প্রকাশ করেছে প্রথম ক্লাইমেট ডেট রিস্ক ইনডেক্স বা জলবায়ু ঋণঝুঁকি সূচক। এতে বাংলাদেশকে রাখা হয়েছে "উচ্চ ঝুঁকির ঋণফাঁদ" বিভাগে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের স্কোর ১০০-এর মধ্যে ৬৫ দশমিক ৩৭। ২০৩১ সালের মধ্যে তা সামান্য বেড়ে ৬৫ দশমিক ৬৩ হতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

৫৫টি দেশের ঋণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তৈরি করা হয়েছে প্রতিবেদনটি। এতে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থায়ন এখন একধরনের আর্থিক বোঝায় পরিণত হয়েছে। এটি কোপেনহেগেন ও প্যারিস চুক্তির অনুদানভিত্তিক, ন্যায়নিষ্ঠ অঙ্গীকার থেকে অনেক দূরে সরে গেছে।

চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান বলেন, বাংলাদেশ কপ৩০-এ অংশ নিচ্ছে বিশ্বের অন্যতম ভারী জলবায়ু-ঋণের বোঝা নিয়ে। এটি অতিরিক্ত ঋণ নেওয়ার ফল নয়। বরং বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থায়নব্যবস্থাই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে টিকে থাকার জন্য ঋণের দায়ে জর্জরিত করছে।'

বাংলাদেশের নাগরিকদের ওপর আর্থিক বোঝা অত্যন্ত অসম। গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০০২ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জলবায়ু-সম্পর্কিত ঋণের ফলে বাংলাদেশের মাথাপিছু ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭৯ দশমিক ৬১ ডলার। এটি স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) গড় ২৩ দশমিক ১২ ডলারের চেয়ে প্রায় সাড়ে তিনগুণ বেশি।

দেশটি এখন প্রতি টন কার্বন নিঃসরণের বিপরীতে ২৯ দশমিক ৫২ ডলার করে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে, যা এলডিসি গড় ৩০ দশমিক ৪৯ ডলরের চেয়ে সামান্য কম।

সবমিলিয়ে হিসাবে দেখা যায়, বাংলাদেশ প্রতি ১ ডলার অনুদানের বিপরীতে ২ দশমিক ৭০ ডলার ঋণ পাচ্ছে। এর ফলে দেশটি সবচেয়ে বেশি জলবায়ু-ঋণ ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর একটি হয়ে উঠেছে। এলডিসি দেশগুলোর ক্ষেত্রে গড়ে ৭০ শতাংশের বেশি জলবায়ু অর্থায়ন ঋণ আকারে আসে।

জাকির হোসেন খান বলেন, 'কপ৩০-এ বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে আহ্বান জানাবে—ঋণ নয়, ন্যায়বিচার চাই। শতভাগ অনুদানভিত্তিক অভিযোজন অর্থায়নই এখন সময়ের দাবি। এটা দয়া নয়, নৈতিক দাবি।' তিনি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের এক পরামর্শের উদ্ধৃতি দিয়ে এ মন্তব্য করেন।

২০০৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জলবায়ু-সম্পর্কিত ঋণের পরিমাণ উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে।

গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে বাংলাদেশ নিয়েছে ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু–সম্পর্কিত ঋণ। এতে দেশের অভিযোজন ও সহনশীলতা গড়ে তুলতে বাহ্যিক অর্থের ওপর নির্ভরতা আরও বেড়েছে।

জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলনের (ইউএনসিটিএডি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর বৈদেশিক ঋণ পরিষেবার ব্যয় দ্রুত বেড়েছে। ২০২০ সালে যেখানে ব্যয় ছিল ৩১ বিলিয়ন ডলার, ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ বিলিয়ন ডলারে। জলবায়ু-সম্পর্কিত ঋণ তাদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতার চেয়ে অনেক দ্রুত বাড়ছে। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশসহ এলডিসিগুলো অনুদানের চেয়ে অনেক বেশি জলবায়ু-ঋণ পেয়েছে।

ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশ ২০২২ সালে প্রণয়ন করে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (এনএপি)। এই পরিকল্পনায় পানিসম্পদ, কৃষি ও নগর সহনশীলতাসহ আটটি খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। সেখানে মোট ১১৩টি উচ্চ-অগ্রাধিকারমূলক পদক্ষেপ নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন, ২০২৩ থেকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মোট ২৩০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে, অর্থাৎ বছরে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার।

কিন্তু অতীতের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এখানে বিশাল অর্থায়ন ঘাটতি রয়েছে।

২০০২ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ অভিযোজন খাতে মাত্র ১ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার তহবিল পেয়েছে, যা মোট চাহিদার ১ শতাংশেরও কম।

একইভাবে, জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এনডিসি) অনুযায়ী, প্রশমন কার্যক্রমের জন্য বাংলাদেশকে বছরে ৩ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। কিন্তু ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বরাদ্দ ছিল মাত্র ৩৬০ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, প্রয়োজনের মাত্র ১১ শতাংশ অর্থই পাওয়া গেছে।

ভুল হিসাবের অভিযোগ

প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, ২০০২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে প্রায় ৮৮০ মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ মোট জলবায়ু তহবিলের প্রায় ১৯ শতাংশ প্রকল্প ভুলভাবে জলবায়ু অর্থায়ন হিসেবে দেখানো হয়েছে।

এই প্রকল্পগুলোর ঋণ–অনুদান অনুপাত ২৮ দশমিক ৮। এর ফলে জাতীয় ঋণ অপ্রয়োজনে বেড়ে যাচ্ছে এবং প্রকৃত সহনশীলতা কর্মসূচির অর্থ অন্যখাতে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

প্রতিবেদনটি সতর্ক করে বলেছে, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য ঘোষিত ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থায়ন লক্ষ্যমাত্রা যদি ন্যায় ও সমতার নীতি মেনে না চলে, তাহলে প্রতিটি ঘূর্ণিঝড় শুধু প্রাণহানিই ঘটাবে না, বরং বাড়িয়ে দেবে ঋণের নতুন এক লাইন।

বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রতি বছর গড়ে ১ বিলিয়ন ডলার অর্থনৈতিক ক্ষতি ভোগ করে ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের কারণে। ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন ও চরম আবহাওয়ার প্রভাবে কৃষিখাতের জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।

জাকির হোসেন খান বলেন, 'কপ৩০–এ এই চক্রের অবসান ঘটাতে হবে। অর্থায়নকে ন্যায্যতা, সহনশীলতা ও টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।'