আলোকের এই ঝর্না-ধারায়: রবীন্দ্র নস্টালজিয়ার এক সন্ধ্যা
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেবল নস্টালজিয়ার কবি নন, তিনি বাংলার জীবন্ত স্পন্দন। তার কবিতা, গান ও গল্পের মধ্য দিয়েই প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই ভূখণ্ডের সৌন্দর্য, বৈপরীত্য ও ঐতিহ্যকে নতুনভাবে চিনে এসেছে। রবীন্দ্রসাহিত্য হলো স্মৃতি, কল্পনা আর নৈতিকতার এক সমৃদ্ধ ভুবন—যা আমাদের পরিচয় ও সংস্কৃতিকে শেকড়ের সঙ্গে বেঁধে রাখে, একইসঙ্গে নতুন সৃষ্টির অনুপ্রেরণা যোগায়। তাকে উদযাপন করা মানে সেই শেকড়ের সঙ্গেই গভীর সংযোগ স্থাপন করা—হোক তা নীরব আত্মমগ্নতায়, কিংবা সমবেত উৎসবের উচ্ছ্বাসে।
সুইডেন দূতাবাস ও এইচএসবিসি বাংলাদেশের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত 'আলোকের এই ঝর্না-ধারায়' শিরোনামে এক বিশেষ অনুষ্ঠানে সোমবার সন্ধ্যায় সেই মেলবন্ধন এক অনন্য মর্যাদা ও উচ্ছ্বাসে প্রাণ পেয়েছিল। শেরাটন ঢাকার গ্র্যান্ড বলরুমে আয়োজিত এই সন্ধ্যা রবীন্দ্রনাথকে কেবল 'বিশ্বকবি' হিসেবেই নয়, বরং নিত্যজীবনের দার্শনিক হিসেবে তুলে ধরেছিল, যার সৃষ্টিকর্ম প্রেম, বেদনা, আত্মপরিচয় আর প্রতিদিনের সাধারণ মুহূর্তগুলো নতুন করে ভাবতে শেখায়।
সংস্কৃতিকর্মী ও নাট্যপরিচালক ত্রপা মজুমদারের সাবলীল সঞ্চালনায় এই আয়োজন গাম্ভীর্যের বদলে শিল্পের স্বতঃস্ফূর্ততাকেই বেছে নিয়েছিল। কেবল শব্দের কথা নয়, সুর-কবিতা-আবৃত্তি আর নৃত্যের মূর্ছনাই হয়ে উঠেছিল অনুষ্ঠানের সবচেয়ে গভীর ভাষা।
প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী অদিতি মহসিন তার সহজাত প্রজ্ঞা এবং আবেগের গভীরতা দিয়ে মুহূর্তেই পুরো মঞ্চ নিজের করে নিলেন। 'আনন্দধারা বহিছে ভুবনে'-র অপার্থিব সুরধারা থেকে 'তুমি একটু কেবল বসতে দিও'-র সূক্ষ্ম, হৃদয়ছোঁয়া ভঙ্গিমা—প্রতিটি সুরই যেন দর্শককে নতুন করে স্পর্শ করল। গানগুলো কেবল পরিবেশিত হলো না, সবার সামনে যেন নতুন করে ধরা দিলো।
এরপর ডালিয়া আহমেদ তার গভীর, অনুরণিত আবৃত্তিতে মগ্ন করলেন সবাইকে। তার নির্মল উচ্চারণের সঙ্গে আধ্যাত্মিকতা ও সৌন্দর্য মিলেমিশে তৈরি করল এক অনন্য আবহ। তার উপস্থাপনায় ফুটে উঠল রবীন্দ্রচিন্তার সাহস, নিবেদন ও মানবিকতা—যা শ্রোতাদের কাছে তৈরি করেছিল অন্যরকম এক অনুভব এবং সেই অনুভবেই নিমগ্ন হলো পুরো অনুষ্ঠানস্থল।
অদিতি মহসিন গান শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতারা শুধু শ্রোতা হয়ে রইলেন না, তাদের ঠোঁট নিঃশব্দে উচ্চারণ করল পরিচিত লাইন, কেউ হালকা গুনগুন করে গেয়ে উঠলেন, কেউ দোলালেন মাথা, আবার কেউ মৃদু হাসলেন। এভাবে প্রতিটি পঙক্তিকে যেন নিজস্ব করে নিলেন সবাই। মুহূর্তেই পুরো হলজুড়ে স্মৃতি, আনন্দ আর গভীর সংযোগের এক যৌথ উন্মেষ তৈরি হলো। গ্র্যান্ড বলরুম নিছক একটি মঞ্চ রইল না; তা রূপ নিল এক প্রাণময় অংশগ্রহণে ভরা শ্রদ্ধাঞ্জলিতে।
'আকাশ ভরা সূর্য তারা', 'আলোকের এই ঝর্ণাধারায়'-সহ আরও কয়েকটি গানে ওয়ার্দা রিহাব ও তার নৃত্যদলের মোহময় পরিবেশনায় অনুষ্ঠানটি আরেক মাত্রা পেল। নৃত্যের সূক্ষ্ম ভঙ্গিমা আর নিখুঁত মূর্ছনা মিলিয়ে তারা গড়ে তুললেন এক গভীর ও ধ্যানমগ্ন আবহ।
এইচএসবিসির প্রধান নির্বাহী মাহবুব উর রহমান রবীন্দ্রনাথের চিরকালীন নৈতিক শক্তির কথা উল্লেখ করে বলেন, 'আমরা এই মুহূর্তটিকে কিংবা আপনাদের উপস্থিতিকে কখনোই সাধারণভাবে দেখি না। আপনারা এখানে এসেছেন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সংগীত এবং রবীন্দ্রনাথের প্রতি আপনাদের গভীর অনুরাগ থেকে। আজ আমরা আমাদের ইতিহাসকে শ্রদ্ধা জানাই এবং বিশ্বকবির সেই উত্তরাধিকারকে সম্মান করি, যার দৃষ্টি ও দর্শন বাংলার আত্মাকে গড়ে তুলেছে। আজকের জটিল অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে তার আদর্শ এখনো ভীষণ প্রাসঙ্গিক। তার আদর্শ আমাদের নৈতিক দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করে এবং সাহস, সততা ও সৃজনশীলতার দাবি রাখে। রবীন্দ্রনাথ এমন এক জাতির স্বপ্ন দেখেছিল যেখানে সবাই হবে নির্ভীক এবং দেশপ্রেম হবে আত্মদর্শন ও আন্তঃসাংস্কৃতিক বিনিময়ে সমৃদ্ধ। এই সন্ধ্যায় অদিতি মহসিনের সুরের শিল্প, ডালিয়া আহমেদের আবৃত্তি কিংবা ওয়ার্দা রিহাবের মধ্য দিয়ে আমরা যে সর্বজনীনতাকে উদযাপন করছি, তা আজও আমাদের পথ দেখায়, অনুপ্রাণিত করে—যা সর্বদা প্রাসঙ্গিক।'
বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইডেনের রাষ্ট্রদূত নিকোলাস উইকস রবীন্দ্রনাথের আন্তর্জাতিক আবেদন ও তার গড়ে তোলা আন্তঃসাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনের কথা তুলে ধরে বলেন, 'তার কবিতা ও দর্শন সময়, ভৌগোলিক সীমানা সবকিছু অতিক্রম করে নতুন চিন্তা, অনুধাবন ও নতুন পথ খুঁজে পাওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়। রবীন্দ্রনাথকে উদযাপন করার অর্থ সুইডেন ও বাংলাদেশের অংশীদারত্বকেও উদযাপন করা—জ্ঞান, উদ্ভাবন ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে যেই যাত্রা পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে বিকশিত হয়েছে।'
দর্শকদের জন্য এটি কোনো সাধারণ অনুষ্ঠান ছিল না; বরং ছিল এক মিলনমেলা। একসঙ্গে সবাই যেভাবে সুর মেলাচ্ছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিলো শিল্পীরা গাওয়ার আগেই পুরো হলঘর যেন সেটি মনে করার চেষ্টা করছে। কোরাস আর চেনা হাসিতে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি যেন নতুনভাবে ফিরে এলো সবার মাঝে।
'আলোকের এই ঝর্না-ধারায়' রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকে কেবল প্রদর্শনীর বস্তু করে রাখেনি—তাকে মুক্ত হতে দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের শব্দগুলোকে স্বাধীনভাবে চারিদিকে বিচরণ করেছে। কারো ওপর শান্তভাবে প্রভাব ফেলেছে, কাউকে অস্থিরতায় ছুঁয়ে গিয়েছে, কারো মনকে নাড়িয়ে দিয়েছে। আশার প্রদীপ জ্বালাতে শুরু করেছে এমন একটি দেশের জন্য এই রবীন্দ্র সন্ধ্যা ছিল আশ্বস্ত হাতের মতো নির্ভরতা, আলোর কোমলতা আর নীরবতায় দৃঢ়।
সেই আশার আলোয়, রবীন্দ্রনাথ কোনো দূরের প্রতীক ছিলেন না, ছিলেন এক পরিচিত জীবন্ত স্পন্দন। এই আয়োজন সবাইকে স্মরণ করিয়েছে—যখন শিল্পকে একসঙ্গে অনুভব করা হয়, তখন তা হয়ে ওঠে এক পরম নির্ভর আশ্রয়। এমন এক স্থান, যেখানে বারবার ফিরে আসা যায়। যেটি মানুষের কাছে নিজস্ব উষ্ণতা নিয়ে ফিরে আসে।
অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম