জিমি হেন্ড্রিক্স: আগুন-ছোঁয়া গিটার জাদুকর
জিমি হেন্ড্রিক্সকে নিয়ে লিখতে শুরু করলে প্রথমেই যে শব্দগুলো মাথায় আসে—অদ্ভুত, বিস্ময়কর, আর সম্পূর্ণ ভিন্ন ও অনন্য। তিনি ছিলেন এমন একজন ইলেকট্রিক গিটারিস্ট, যার সুর ইলেকট্রিক টর্নেডোর মতো এসে পুরো সাইকেডেলিক রকের ভাষা পাল্টে দিয়েছিল। সিয়াটলে জন্ম নেওয়া এই মানুষটা গিটার বাজাতেন এমনভাবে, যেন প্রতিটি নোটের ভেতর দিয়ে আলো বের হচ্ছে—একদিকে কোমল, অন্যদিকে অগ্নিগর্ভ। ঐতিহ্য, পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর ব্যক্তিগত পাগলামি—সব মিলিয়ে তিনি বানিয়েছিলেন এক নিজস্ব সাউন্ড।
হেন্ড্রিক্সকে শুধু রহস্যময় বলা কম হয়ে যায়—তিনি ছিলেন যেন চলমান এক ধাঁধা। বাস্তব জীবনে নরম, বিনয়ী, নিজের প্রতিভা নিয়ে বাড়তি কথা বলতেন না। কিন্তু গিটার হাতে নিলেই তিনি পুরোপুরি বদলে যেতেন—হঠাৎই যেন মঞ্চে নেমে আসা এক আগুন-সত্তা। তার বাজনা শুধু শোনার জিনিস ছিল না, দেখারও। তিনি রক, ব্লুজ, আরঅ্যান্ডবি, ফোক—সব কিছুকে এমনভাবে মিশিয়ে দিতেন, যেন এগুলো বহুদিন ধরেই একসঙ্গে থাকার জন্য অপেক্ষা করছিল। মাত্র কয়েক বছরের ক্যারিয়ার হওয়ায় তার রহস্য আর আকর্ষণ আরও বেড়ে গেছে—যেন স্বল্প সময়ের জন্য পৃথিবীতে নেমে আসা কোনো জ্যোতিঃসত্তা আমাদের ছুঁয়ে দিয়ে ফিরে গেছে নিজের গ্রহে।
একটাই কথা—জিমি হেন্ড্রিক্স গিটার বাজাতেন জাদুর মতো।
গিটারকে নতুনভাবে চিনিয়েছেন
হেন্ড্রিক্স শুধু ভালো বাজাতেন না—তিনি যন্ত্রটাকেই বদলে দিয়েছেন। ইলেকট্রিক গিটার, পেডাল, অ্যামপ্লিফায়ারের যে আধুনিক রূপ আজ আমরা দেখি, তার শুরুটা অনেকটাই তার হাতেই।
তিনি শব্দকে ভয় পেতেন না—বরং শব্দেই তার শক্তি। খুব জোরে, খুব বিকৃত করে, খুব উন্মাদনা নিয়ে বাজানোর মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন নিজের ভাষা। ফাজ পেডালকে তিনি এমনভাবে ব্যবহার করেছিলেন যে আজও 'পার্পল হেজ'-এর প্রথম দগদগে নোট শুনলেই শরীর ঝাঁকিয়ে ওঠে। সেই ফাজ-টোনই ধীরে ধীরে রকের পরিচয় হয়ে দাঁড়ায়।
উডস্টকে তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল মার্শাল স্ট্যাকগুলো এখন কিংবদন্তি। পেডাল, অ্যাম্পের বিকৃতি আর তার হাত—তিন মিলিয়ে যেন মঞ্চে জন্ম নিত এক বৈদ্যুতিক ঝড়।
সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার—বামহাতি হয়েও তিনি প্রায়ই ডানহাতির গিটার উল্টো করে বাজাতেন। তার বদলে নিজের মতো করে তার জোড়া লাগাতেন। এতে তার সাউন্ড আরও আলাদা হয়ে উঠত—যেন গিটারটার প্রতিটি অংশ তার ইচ্ছামতো বেঁকে যেত।
পুরোনো গানের নতুন জীবন
হেন্ড্রিক্স শুধু যন্ত্র নিয়েই কারিকরি করেননি—তিনি বদলে দিয়েছিলেন রক সংগীতের মেজাজ এবং আত্মা। তার হাত ধরে পুরোনো ব্লুজ ও ফোকের সরল গন্ধও পেয়েছিল সম্পূর্ণ নতুন রূপ।
'হে জো'—অনেকেই ভুল করে তার নিজের গান মনে করেন। কিন্তু তিনি আসলে পুরোনো ব্লুজ গানটি এমনভাবে সাজিয়েছিলেন যে সেটা পুরোপুরি তার হয়ে যায়। একইভাবে 'অল অ্যালং দ্য ওয়াচটাওয়ার'—মূলত ডিলানের গান, কিন্তু আজও অধিকাংশ মানুষ হেন্ড্রিক্সের সংস্করণকে চূড়ান্ত বলে মনে করেন।
নিজস্ব গানগুলোর কথা বললে 'ভুডু চাইল্ড' তার ব্লুজ-প্রভাবিত বিকৃত টোনের সেরা পরিচয়। আর 'লিটল উইং' হলো কোমলতা আর জাদুর এক অনন্য মিশেল—রিদম আর লিডের মাঝের সীমাটি তিনি যেভাবে ঘুচে দিয়েছিলেন তা যেন গিটারের জন্য নতুন এক ব্যাকরণ।
অনেকে মনে করেন তার লিড বাজানোই তাকে 'গিটার গড' বানিয়েছে। কিন্তু সংগীতবোদ্ধারা বলেন, তার রিদম বাজানোই আরও আশ্চর্যজনক। কারণ তিনি কর্ড বাজানোর মাঝেও ছোট ছোট লিড, অলংকরণ, ট্রায়াড—সবকিছু এমনভাবে জুড়ে দিতেন যে গিটার যেন নিজেরই গল্প বলতে শুরু করত।
পারফরম্যান্স: মঞ্চে ওঠা মানেই ঝড় শুরু
মঞ্চে তিনি ছিলেন একদম অন্য মানুষ। তার আত্মবিশ্বাস, দুঃসাহস আর নির্ভীকতা তাকে বানিয়েছিল এমন একজন পারফর্মার, যাকে দেখলে চোখ সরানো যায় না।
উডস্টকের পারফরম্যান্স আজও ইতিহাসে জায়গা নিয়ে আছে। বিশেষ করে 'স্টার স্প্যাংলড ব্যানার'—যেখানে তিনি গিটারে যুদ্ধবিমানের সাইরেন, মেশিনগানের শব্দ তুলেছিলেন ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদ জানাতে—এটি আজও সংগীতের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক অনুষঙ্গগুলোর একটি।
'মেশিন গান'–এর লাইভ পরিবেশনা শুনলে মনে হয় যুদ্ধের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি—মিউটেড নোট, স্ট্রিং-রেক, দ্রুত লিড—সব মিলিয়ে নিখুঁত ভয়ের আবহ। মাউইয়ের 'ভুডু চাইল' তো প্রায় অতিলৌকিক—যেন অন্য গ্রহের কেউ মঞ্চে নেমে এসেছে।
প্রভাব রয়ে গেছে আজও
জিমি হেন্ড্রিক্স শুধু একজন 'সেরা গিটারিস্ট' ছিলেন না—তিনি ছিলেন পথপ্রদর্শক। তার হাত ধরে আধুনিক রকের দরজা খুলেছিল।
জন মেয়ার, স্টিভি রে ভন, জো সাত্রিয়ানি, এরিক ক্ল্যাপটন—এমনকি বিটলসদের জর্জ হ্যারিসন পর্যন্ত সবাই তার বাজনা থেকে কিছু না কিছু শিখেছেন। ফেন্ডার স্ট্র্যাটোকাস্টার—আজকের রকের সবচেয়ে আইকনিক গিটার—তার একটা বড় অংশের খ্যাতি এসেছে হেন্ড্রিক্সের কারণে। উল্টো করে বাজানো সেই স্ট্র্যাটো আজও তার প্রতীক।
১৯৬৫ সালের পর যে-ই গিটার হাতে তুলেছে—চোখ বুজে বলা যায়, তার বাজানোতে কোথাও না কোথাও হেন্ড্রিক্স আছেন।
হেন্ড্রিক্স চলে গেছেন অল্প বয়সে—এটাই সবচেয়ে বড় আফসোস। তিনি বেঁচে থাকলে রক সংগীত কতদূর এগোত, কেউ জানে না। তবুও তিনি যে সময়টা ছিলেন, সেই সময়ই যথেষ্ট ছিল পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার জন্য।
জিমি হেন্ড্রিক্স ছিলেন যাদুকর, বিপ্লবী, আর একান্ত নিজের মতো একজন শিল্পী। তার রেখে যাওয়া পথ ধরে আজও অগণিত গিটারবাদক এগোচ্ছে—আর তার প্রতিটি নোটে এখনো লুকিয়ে আছে এক অন্য জগতের সুর।