জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বন্ধ কারখানাগুলো এখনো খোলেনি

রেফায়েত উল্লাহ মীরধা
রেফায়েত উল্লাহ মীরধা

জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর কেটে গেছে এক বছরেরও বেশি সময়। ওই সময় ও এর পরবর্তী অস্থিরতায় বন্ধ হয়ে যাওয়া বহু শিল্পকারখানাই এখনো উৎপাদনে ফিরতে পারেনি।

অর্থের সংকট, বীমার টাকা পেতে দেরি আর ব্যাংকের কঠিন শর্তের কারণে এসব কারখানা এখনো চালু করা যায়নি। ফলে এখনও দশ হাজার শ্রমিক বেকার অবস্থায় আছেন।

বন্ধ হয়ে যাওয়া অনেক কারখানাই ছিল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীর মালিকানাধীন, যেমন—বেক্সিমকো গ্রুপ, গাজী গ্রুপ এবং বেঙ্গল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, 'গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানের পর প্রায় দুই লাখ গার্মেন্ট শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে মাত্র ৫০ হাজার জন নতুন কাজে যোগ দিতে পেরেছেন, কারণ এখনো অনেক কারখানা খোলেনি।'

উদাহরণ হিসেবে তিনি জানান, গাজীপুরের কাশিমপুরে বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে একসময় ৩৫ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। এখন সেখানে মোট কর্মীর মাত্র ১৫ শতাংশ রয়েছে। পার্কের ১৫টি ইউনিটই বন্ধ। মালিক বেতন দিতে না পারায় এবং অভ্যুত্থানে সহিংসতা উসকে দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে কার্যক্রম স্থবির হয়ে গেছে।

বেক্সিমকোর টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট বিভাগের মানবসম্পদ প্রধান খালিদ শাহরিয়ার বলেন, 'বেক্সিমকোর অনেক কর্মীর অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি হচ্ছে না, কারণ তারা এই প্রতিষ্ঠানের সাবেক কর্মী ছিলেন। যারা এখনো বেকার, তারা অপেক্ষা করছেন। বেক্সিমকো আবার চালু হলে তারা যোগ দেবেন।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা কারখানা চালু করতে চেষ্টা করছি, কিন্তু ব্যাংকগুলো এখন শতভাগ নগদ মার্জিন ছাড়া এলসি খুলছে না। আর আমাদের বর্তমান আর্থিক অবস্থায় এটা সম্ভব নয়।'

ফলে একসময় বছরে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক উৎপাদন করা যন্ত্রপাতিগুলো এখন অচল অবস্থায় পড়ে আছে।

সরকার বেক্সিমকো পার্কের কারখানাগুলো আবার চালুর উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। এ বিষয়ে শ্রম ও শিল্প খাতের পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য গঠিত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা আজ।

শ্রম মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বৈঠকে শ্রম অধিদপ্তরের প্রাথমিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা হবে। সেখানে বিএইচআইএস অ্যাপারেলস লিমিটেড, সিজনস ড্রেসেস লিমিটেড এবং প্যারাডাইস কেবলস লিমিটেডের শ্রমিক ও কর্মচারীদের বেতনসংক্রান্ত বিষয় উল্লেখ রয়েছে।

এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত কারখানাগুলোর জন্য সরকার অনুমোদিত সুদবিহীন ঋণ সুবিধার অগ্রগতি নিয়েও আলোচনা হবে।

খালিদ শাহরিয়ার বলেন, 'সরকার যদি সুবিধা দেয় এবং আয় থেকে ঋণ পরিশোধের সুযোগ দিতে পারে, তাহলে বেক্সিমকো গ্রুপ সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন শুরু করতে পারবে।'

তবে বেক্সিমকোই একমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান নয়। গাজী গ্রুপের রূপগঞ্জের টায়ার ও পাইপ কারখানা গণঅভ্যুথ্থানের পর আগুন ও ভাঙচুরে ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে প্রতিষ্ঠানটি দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষতির মুখে পড়ে।

গাজী গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম বলেন, 'আগে যেখানে ১ হাজার ৮০০ শ্রমিক কাজ করতেন, এখন সেখানে মাত্র ১৫০ জন কর্মরত।'

তারপরও তিনি আশা প্রকাশ করেন, আগামী পাঁচ থেকে ছয় মাসের মধ্যে বন্ধ কারখানাগুলোকে আবার চালু করা সম্ভব হবে। তারা ব্যাংকের সঙ্গে ঋণ পুনঃতফসিল নিয়ে আলোচনা করছেন।

অন্যদিকে বেঙ্গল গ্রুপের দুটি প্লাস্টিক কারখানা গত বছরের আগস্টে আগুনে সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। এতে প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৮০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। ওই ইউনিটগুলোতে একসময় ১ হাজার ২০০ শ্রমিক কাজ করতেন।

গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান মো. জসিম উদ্দিন বলেন, 'উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কোম্পানি কার্যত দেউলিয়া অবস্থায় পৌঁছেছে। গ্রুপটির কয়েকটি ইউনিট বর্তমানে তাদের সম্পূর্ণ উৎপাদন ক্ষমতার অর্ধেক (৫০ শতাংশ) ব্যবহার করে কাজ করছে।'

তিনি অভিযোগ করেন, ব্যাংকগুলো পুনরায় চালুর জন্য সহযোগিতা করছে না এবং বীমা কোম্পানিগুলোর ক্ষতিপূরণ দিতেও দেরি হচ্ছে।

জসিম উদ্দিন বলেন, কারখানাগুলো আবার চালুর সহায়তা চেয়ে তিনি সরকারের উপদেষ্টা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। তবে প্রক্রিয়াটিতে এখনো দেরি হচ্ছে।

শ্রম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, 'কোনো কোম্পানি আমার কাছে আবার চালুর অনুরোধ নিয়ে আসেনি। কেউ এলে আমি বিষয়টি দেখব।'

শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় প্রায় ১০০টি কারখানা আগুন ও ভাঙচুরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এগুলোর মধ্যে মূলত পোশাক কারখানাই বেশি। অনেক মালিক কারাগারে বা পালিয়ে গেছেন। ফলে এসব কারখানা আইনি ও আর্থিক জটিলতায় আটকে আছে।

বিকেএমইএর মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত মালিক ও ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা একাধিকবার সরকারের উপদেষ্টা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তারা চাইছেন কারখানাগুলো আবার চালুর ব্যবস্থা করা হোক। কিন্তু এখনো তেমন অগ্রগতি হয়নি।

তিনি আরও জানান, বিষয়টি আজকে শ্রম মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে আলোচিত হবে।