সাধারণ বিমায় একচেটিয়া রিইনস্যুরেন্সের নিয়ম বাতিলের প্রস্তাব সরকারের
সরকারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি) ২০১৯ সালের বিমা করপোরেশন আইন থেকে একটি ধারা বাতিলের প্রস্তাব দিয়েছে। ওই ধারা অনুযায়ী, নন-লাইফ (জীবনবিমা নয় এমন) বিমা কোম্পানিগুলোকে তাদের রিইনস্যুরেন্সের অন্তত অর্ধেক বাধ্যতামূলকভাবে রাষ্ট্রীয় সাধারণ বীমা করপোরেশনের রিইনস্যুরেন্সের করতে হয়।
রিইনস্যুরেন্স হলো একটি বিমা কোম্পানির অন্য একটি বিমা কোম্পানির কাছ থেকে পলিসি কেনা। এর মাধ্যমে প্রাথমিক বিমা কোম্পানি বড় ধরনের দাবির ঝুঁকি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায়, একটি বিমা কোম্পানি তার ঝুঁকির অংশবিশেষ অন্য একটি বিমা কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করে, যাকে 'পুর্নবিমাকারী' বলা হয়।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) বলছে, এই বাধ্যতামূলক নিয়মের কারণে বিদেশি উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়নে বাধা তৈরি হয়। কারণ সাধারণ বীমা করপোরেশনের আন্তর্জাতিক মানের ক্রেডিট রেটিং অনেক সময় থাকে না। অথচ অনেক দাতা সংস্থা বা ফান্ডিং এজেন্সিগুলো বাধ্যতামূলকভাবে এই রেটিং চেয়ে থাকে।
আইডিআরএ-এর মিডিয়া ও যোগাযোগ পরামর্শক সাইফুন্নাহার সুমি বলেন, 'বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে আন্তর্জাতিক অর্থায়নের ক্ষেত্রে অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়ই শর্ত আরোপ করে যে, বিমা গ্রহণ করতে হবে এমন কোনো বিমা কোম্পানি থেকে, যার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ক্রেডিট রেটিং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নির্ধারিত নির্দিষ্ট মানের ক্রেডিট রেটিং আছে। তবে সাধারণ বীমা করপোরেশনের প্রায়ই সেই মানের ক্রেডিট রেটিং না থাকায় অর্থায়ন বাধাগ্রস্ত হয় এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এই অসুবিধা দূর করার করতে এই সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে।'
তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন, রিইনস্যুরেন্সকে আসলে বিমা কোম্পানিগুলোর জন্য বিমা হিসেবে দেখা হয়। কারণ এর মাধ্যমে বিমা কোম্পানিগুলো বড় ঝুঁকি ভাগাভাগি করতে পারে, যেন বড় ধরনের বিমা দাবি (যেমন কারখানায় অগ্নিকাণ্ড বা পণ্য পরিবহনে ক্ষতি) মেটাতে তাদের একা পুরো বোঝা বহন করতে না হয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোনো পোশাক কারখানার মালিক তার কারখানা বেসরকারি বিমা কোম্পানির মাধ্যমে বিমা করাতে পারেন। কিন্তু যদি সেই বিমা কোম্পানি মনে করে, কারখানাটিতে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বেশি এবং সম্ভাব্য ক্ষতির টাকা একা বহন করা কঠিন হবে, তাহলে তারা সেই ঝুঁকির একটা অংশ রিইনস্যুরেন্সের মাধ্যমে অন্য কোনো কোম্পানির কাছে স্থানান্তর করতে পারে।
তবে বর্তমান আইনে বলা আছে, এ ধরনের রিইস্যুরেন্সের অন্তত ৫০ শতাংশ অবশ্যই রাষ্ট্রায়ত্ত নন-লাইফ বিমা প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা করপোরেশনকে দিতে হবে, আর বাকি অংশ স্থানীয় বা বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে করা যাবে।
নতুন প্রস্তাবিত সংশোধনীতে এই '৫০ শতাংশ বাধ্যতামূলক' নিয়মটি বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
জানা গেছে, সাধারণ বীমা করপোরেশনের অনেক রিইনস্যুরেন্সের দাবি নিষ্পত্তি না করায় অনেক দিন ধরেই বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলো তাদের প্রতি বিরক্ত বিরক্ত। বর্তমানে তারা ২০২০ সালের দাবি নিষ্পতিতে কাজ করছে। ফলে অনেক গ্রাহক সময়মতো ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না।
সাইফুন্নাহার সুমি বলেন, প্রস্তাবিত সংশোধনীর লক্ষ্যই হলো নিষ্পত্তি না হওয়া দাবিসহ অন্যান্য সমস্যার সমাধান করা।
বিমা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই পরিবর্তন বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং দাবি নিষ্পত্তি দ্রুত ও সহজ হবে। এতে গ্রাহকরা উপকৃত হবেন।
তবে সাধারণ বীমা করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হারুন-অর-রশিদ মনে করেন, এই উদ্যোগ রাষ্ট্রীয় বিমা সংস্থাকে দুর্বল করবে এবং বাজারে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে।
তার ভাষ্য, 'যদি সাধারণ বীমা করপোরেশনের ভূমিকা কমে যায়, তাহলে তাদের আয় কমবে এবং বিমা খাতে বিশৃঙ্খলা বাড়বে। বর্তমানে সাধারণ বীমা রিইনস্যুরেন্সের দাবির অর্থ দিতে ব্যর্থ হলে সরকার তা পরিশোধ করে। কিন্তু কোনো বেসরকারি কোম্পানি ব্যর্থ হলে, সেই অর্থ কে দেবে?'
'বাজার আরও প্রতিযোগিতামূলক হবে'
একটি খ্যাতনামা নন-লাইফ বিমা কোম্পানির প্রধান নির্বাহী জানান, যদি সাধারণ বীমা করপোরেশনে রিইনস্যুরেন্স করার আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকে, তাহলে বাজার আরও বড় ও প্রতিযোগিতামূলক হবে।
এ ধরনের পরিবর্তনের ফলে দেশের বিমা কোম্পানিগুলো রিইনস্যুরেন্স নিয়ে ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। দরকার হলে তারা বিকল্প বেছে নিতে পারবে।
তার ভাষ্য, 'এই পরিবর্তন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রিইনস্যুরেন্স ব্যবসা ধরে রাখতে এবং নতুন ব্যবসা আকৃষ্ট করতে সাহায্য করবে।'
তিনি আরও বলেন, 'সাধারণ বীমা করপোরেশনের সঙ্গে ঐচ্ছিক রিইনস্যুরেন্সের সুযোগ তৈরি হলে তারা আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সেবা ও ব্যবসায়িক মান উন্নত করতে উদ্বুদ্ধ হবে।'
তবে তিনি সতর্ক করেছেন, দেশের সব বিমা কোম্পানির আন্তর্জাতিক রিইনস্যুরেন্স বাজারে প্রবেশের জন্য দরকারি যোগাযোগ নেই, ফলে সবাই সমানভাবে সুযোগ পাবে না।
'যেসব কোম্পানির আন্তর্জাতিক যোগাযোগ আছে তারা এটিকে বিদেশি রিইনস্যুরারদের সঙ্গে অংশীদারিত্ব আরও মজবুত করার সুযোগ হিসেবে দেখতে পারে,' বলেন তিনি।
বাংলাদেশ জেনারেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানি পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ সাইফুদ্দিন চৌধুরী সংশোধনের প্রস্তাবকে স্বাগত জানান।
তিনি বলেন, '২০১৪ সাল থেকে সাধারণ বীমা করপোরেশন আমার রিইনস্যুরেন্সের কোনো দাবির অর্থ ফেরত দেয়নি। বারবার চেষ্টা করেও কোনো অর্থ পাইনি, এমনিক সাধারণ বীমা এই সমস্যা সমাধানে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি।'
'অন্যদিকে আমি বিদেশি রিইনস্যুরেন্স কোম্পানির সঙ্গেও কাজ করেছি। তারা দাবি করা অর্থ ফেরত দিয়েছে এবং আমরা গ্রাহকদের সময়মতো যথাযথ ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করেছি,' বলেন তিনি।
আহমেদ সাইফুদ্দিন চৌধুরী বলেন, 'এসব অদক্ষতা বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা যদি এ ধরনের বাধার মুখোমুখি হন, তাহলে কেন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে? এসব পরিস্থিতি আমাদের সুনাম নষ্ট করছে।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও ইনস্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক হাসিনা শেখও এই প্রস্তাবের পক্ষে মত দিয়ে বলেন, 'সাধারণ বীমা করপোরেশনের সক্ষমতা সীমিত। ঝুঁকির একটি বড় অংশের জন্য কেবল তাদের ওপর নির্ভর করা আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়।'
তিনি আরও বলেন, 'বাজারে কিছু কোম্পানি ভালো কাজ করে এবং তাদের সক্ষমতা থাকলে তারা নিজেদের রিইনস্যুরেন্সের সুযোগ থাকা উচিত।'
তিনি মনে করেন, বেসরকারি খাতকেও সুযোগ দেওয়া উচিত। সব কোম্পানির সক্ষমতা নেই, কিন্তু যাদের আছে তারা করবে।
একই বিভাগের অন্য অধ্যাপক মো. মাইন উদ্দিন ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতির সুপারিশ করেন।
তার ভাষ্য, 'বাধ্যতামূলক নিয়ম সম্পূর্ণভাবে তুলে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। অন্তত কিছু অংশ বাধ্যতামূলক থাকা উচিত।'