এখনো ৬০ শতাংশ তথ্য কাগুজে পদ্ধতিতে সংগ্রহ করে বিবিএস

জাগরণ চাকমা
জাগরণ চাকমা
20 October 2025, 03:57 AM
UPDATED 20 October 2025, 10:08 AM

বিশ্বজুড়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সরকারি পরিসংখ্যান তৈরির ধরন পাল্টে দিচ্ছে। অথচ তখনও রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যান সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রায় ৬০ শতাংশ তথ্য পুরনো কাগজভিত্তিক পদ্ধতিতে সংগ্রহ করছে।

বিবিএসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মতে, এই ম্যানুয়াল ডেটা সংগ্রহের ওপর নির্ভরতা সংস্থাটির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।

তথ্যের যথার্থতা নিয়ে উদ্বেগ ছাড়াও এই পুরনো পদ্ধতির আরও কয়েকটি জটিলতা আছে। যেমন, কাগজভিত্তিক পদ্ধতিতে কৃষি উৎপাদন সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশে বিলম্ব হয়, যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বেকারত্ব কমাতে দ্রুত নীতিগত ব্যবস্থা নিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এছাড়া রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগ থেকে যায়।

আওয়ামী সরকারের পতনের পর অর্থনীতিবিদের তৈরি 'হোয়াইট পেপার অন দ্য স্টেট অব দ্য বাংলাদেশ ইকোনমি' প্রতিবেদনে দেশের তথ্যব্যবস্থাকে 'অত্যন্ত অস্পষ্ট' হিসেবে অভিহিত করা হয়। প্রতিবেদনে তথ্যব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করার আহ্বান জানানো হয়।

ওই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার পরিসংখ্যান সংস্থাটিকে আধুনিকায়নের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি সংস্কার উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই উদ্যোগগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই সুফল দেখা যাবে।'

এদিকে এই প্রেক্ষাপটে আজ বিশ্ব পরিসংখ্যান দিবস পালন করছে বাংলাদেশ।

কাগজভিত্তিক পদ্ধতি থেকে ডিজিটাল সিস্টেমে আসার এই ধীরগতির জন্য বাজেট সীমাবদ্ধতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ধীর গতিকে দায়ী করেন নিয়ে সংস্থাটির মহাপরিচালক।

তিনি জানান, পরিসংখ্যান ব্যুরো কিছু জরিপে কম্পিউটার-অ্যাসিস্টড পারসোনাল ইন্টারভিউজ (সিএপিআই) পদ্ধতি ব্যবহার শুরু করেছে। ট্যাবের মাধ্যমে এটি পরিচালিত হচ্ছে। তবে এখনো সারাদেশে সম্প্রসারিত হয়নি।

তিনি যোগ করেন, 'আমরা বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। এর মাধ্যমে ধীরে ধীরে সব প্রধান জরিপকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আনা হবে।'

মহাপরিচালক আরও বলেন, মাঠ জরিপের ওপর নির্ভরতা কমাতে ও অন্যান্য সংস্থা থেকে পাওয়া প্রশাসনিক তথ্য আরও কার্যকরভাবে ব্যবহারের লক্ষ্যে একটি 'বিগ ডেটা প্ল্যাটফর্ম' তৈরির পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।

তবে তিনি স্বীকার করেন, বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থার মধ্যে ডেটা-শেয়ারিং ও আন্তঃসংযোগের মান এখনো উন্নত হয়নি।

তার ভাষ্য, 'যদি আমরা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অন্যান্য খাত থেকে প্রশাসনিক তথ্য পেতাম, তাহলে এত জরিপ পুনরাবৃত্তি করার প্রয়োজন হতো না।'

অন্যদিকে পরিসংখ্যান সংস্থার স্বাধীনতা ও তথ্যের গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমানের নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে সরকার।

রহমান জানান, কমিটি ইতোমধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। যেখানে পরিসংখ্যান ব্যুরোকে আরও গতিশীল ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে।

তিনি আরও জানান, পরিসংখ্যান ব্যুরো ইতোমধ্যে ছয়টি পরিসংখ্যান শাখার জন্য বহু-পক্ষীয় বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে, যেন স্বচ্ছতা বাড়ে।
তিনি বলেন, 'নতুন পদ্ধতি চালু হলে জরিপের ফলাফল প্রকাশে আর মন্ত্রীর অনুমোদন লাগবে না।'

পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাবেক মহাপরিচালক মোহাম্মদ আবুল ওয়াজেদ তথ্য প্রকাশে চলমান বিলম্ব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে কৃষি খাতের তথ্য নিয়ে।

তিনি বলেন, সব পরিসংখ্যানগত প্রকাশনার জন্য একটি নির্দিষ্ট প্রকাশনা সূচি থাকা উচিত।

মোহাম্মদ আবুল ওয়াজেদ বলেন, 'হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভের মতো জটিল জরিপের তথ্য যদি তিন মাসের মধ্যে প্রকাশ করা যায়, তাহলে কৃষি তথ্যের ক্ষেত্রেও একই সময়সীমা মেনে চলা উচিত।'

তিনি আরও উল্লেখ করেন, পরিসংখ্যান ব্যুরো বর্তমানে জনবল ঘাটতির গুরুতর সমস্যায় ভুগছে, সংস্থার মোট পদগুলোর মাত্র অর্ধেক পূরণ আছে। এই জনবল সংকট পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে ফেলে এবং তথ্যের অখণ্ডতা নষ্ট করে।

তিনি বলেন, 'বিশ্বাসযোগ্য পরিসংখ্যানই সুশাসনের মেরুদণ্ড। সময়মতো ও নির্ভরযোগ্য তথ্য ছাড়া নীতিগত ব্যর্থতা ঠেকানো কঠিন।'

জানতে চাইলে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, জাতীয় তথ্যকে সত্যিকার অর্থে নির্ভরযোগ্য করতে হলে ক্ষুদ্র নীতিগত পরিবর্তনের বাইরে গিয়ে কাঠামোগত সংস্কার আনতে হবে।

'হোয়াইট পেপার' কমিটির অর্থনীতিবিদদের একজন হিসেবে তিনি বলেন, 'পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রয়োজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো আইনি ও কার্যকর স্বায়ত্তশাসন। এই ধরনের স্বাধীনতা সংস্থাটিকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে রক্ষা করবে এবং স্বচ্ছতার মাধ্যমে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে।'

তিনি আরও যোগ করেন, কেবল স্বায়ত্তশাসনই যথেষ্ট নয়, পরিসংখ্যান ব্যুরোর নির্ভরযোগ্য তথ্য সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, দক্ষতা ও সম্পদ থাকতে হবে।

তিনি আরও একটি একীভূত জাতীয় তথ্য কৌশল (ন্যাশনাল ডেটা স্ট্রাটেজি) গঠনের আহ্বান জানান, যা রিয়েল-টাইম ডিজিটাল সিস্টেমে পরিসংখ্যান ব্যুরোকে সব মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করবে।

তিনি বলেন, 'এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তথ্যের পুনরাবৃত্তি এড়াবে, সামঞ্জস্য নিশ্চিত করবে, এবং সরকারি সংস্থাগুলোকে একই ধরনের তথ্য সরবরাহের সক্ষমতা তৈরি করবে।'

এছাড়া তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে একটি উচ্চপর্যায়ের ডেটা গভর্ন্যান্স কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব দেন, যা তথ্যের মান নির্ধারণ করবে ও অসামঞ্জস্য সমাধান করবে।

তিনি বলেন, 'রিয়েল-টাইম তথ্যপ্রবাহ কেবল সফটওয়্যারের বিষয় নয়, এটি নেতৃত্ব ও জবাবদিহিতার বিষয়ও।'