এক-তৃতীয়াংশ বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে

মো. মেহেদী হাসান
মো. মেহেদী হাসান
15 December 2025, 07:57 AM

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১৭টি বেসরকারি ব্যাংক তাদের খেলাপি ঋণ  ১০ শতাংশের নিচে রাখতে পেরেছে। অথচ দেশের অধিকাংশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের চাপে ভুগছে। সেই সময়ে এই ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের লাগাম টানতে পেরেছে।

এই ব্যাংকগুলো হলো, সিটি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক ও সিটিজেনস ব্যাংক।

বর্তমানে দেশে মোট ৫২টি স্থানীয় ব্যাংক রয়েছে এবং পুরো ব্যাংকিং খাতে গড় খেলাপি ঋণের হার ৩৬ শতাংশ।

খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, ঋণ বিতরণে সতর্কতা, সচেতনভাব ঝুঁকি মূল্যায়ন, বৈচিত্র্যময় ঋণ পোর্টফোলিও, কঠোর নজরদারি এবং সময়মতো ঋণ আদায় করতে পারায় এসব ব্যাংক খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে।

তারা আরও জানান, তাড়াহুড়ো না করে সুশাসন ও ভালো ব্যবস্থাপনার দিকে গুরুত্ব দিয়েছে বলে এটা সম্ভব হয়েছে।

এছাড়া, কিছু নতুন ব্যাংকের ঋণের পোর্টফোলিও তুলনামূলক ছোট ছিল, এ কারণে তাদের খেলাপির ঝুঁকি কম ছিল। বিপরীতে পুরনো অনেক ব্যাংক অতীতের বড় ঋণের বোঝা বহন করছে।

১৭টি ব্যাংকের মধ্যে তুলনামূলক নতুন সিটিজেনস ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে কম, মাত্র ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অন্যদিকে, এই তালিকায় যমুনা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি ৯ দশমিক ৬ শতাংশ (চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত)।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সিটি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক ও বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৫ শতাংশের নিচে রয়েছে।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে সিটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৪৩৯ লাখ টাকা, যা তাদের বিতরণ করা ঋণের ৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাশরুর আরেফিন বলেন, ২০২৪ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ছিল ৩ দশমিক ৬ শতাংশ, যা ব্যাংকিং খাতের গড় হারের তুলনায় অনেক কম।

তিনি বলেন, '২০২৫ সাল শেষে এটি আরও কমে ৩ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে আশা করছি।'

'এই উন্নতির পেছনে ব্যাংকটির শক্তিশালী ও শৃঙ্খলাবদ্ধ সুশাসন কাঠামো অবদান রেখেছে। আমাদের এখানে ঋণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত পেশাদারভাবে নেওয়া হয় এবং বোর্ডের কোনো হস্তক্ষেপ থাকে না। পাশাপাশি, ব্যবসায়িক কার্যক্রম ও ঋণঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ আলাদা দুটি দায়িত্ব হিসেবে পরিচালিত হয়,' বলেন তিনি।

তিনি মন্তব্য করেন, আমাদের বৈচিত্র্যময় ঋণ পোর্টফোলিও ঝুঁকির পরিমাণ কম রাখে, আর কার্যকর ক্রেডিট কন্ট্রোল সিস্টেম কঠোরভাবে নজরদারিতে সহায়তা করে।

তিনি আরও বলেন, সময়মতো ঋণ আদায়, প্রভিশনিং এবং শক্তিশালী মূলধন ও তারল্য ব্যবস্থাপনা সিটি ব্যাংকের সম্পদের মান আরও উন্নত করেছে। এসব কারণেই চ্যালেঞ্জিং ব্যাংকিং পরিবেশেও ব্যাংকটি টেকসইভাবে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে।

ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলি রেজা ইফতেখার বলেন, গত ৩৩ বছর ধরে আমাদের ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার প্রায় ৩ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে।

তিনি বলেন, 'গ্রাহককে ঋণ দেওয়ার সময় আমরা অত্যন্ত সতর্কভাবে যাচাই-বাছাই করি। পাশাপাশি, ঋণ বিতরণের পরও নিয়মিত ও কঠোর নজরদারি রাখা হয়। এ কারণেই আমাদের খেলাপি ঋণের হার কম থাকে।'

তিনি জানান, ঋণ আদায়ে ব্যাংকটিতে একটি বড় টিম কাজ করে। একটি টিম ১ থেকে ৩০ দিন বিলম্বিত ঋণ দেখভাল করে। বিলম্বের সময়সীমা এর বেশি হলে অন্য টিম দায়িত্ব নেয়।

তিনি আরও বলেন, 'প্রতিটি টিম স্বাধীনভাবে কাজ করে এবং আমাদের একটি আলাদা আইনি টিমও রয়েছে। এভাবেই আমরা আমাদের ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করি।'

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রাইম ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ৩২ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে এবং খেলাপির হার ৪ দশমিক ১ শতাংশ।

প্রাইম ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হাসান ও. রশিদ বলেন, 'ঋণ অনুমোদনের সময় সব ঋণ প্রস্তাব ও আর্থিক সক্ষমতা কঠোরভাবে যাচাই করা হয়। ঋণ বিতরণের পর ঋণগ্রহীতার ব্যবসা ও ঋণের পারফরম্যান্স নজরদারি করা হয়।'

'যেসব খাতে খেলাপি ঋণের হার বেশি, সেসব খাত আমরা এড়িয়ে চলি এবং আদায় কার্যক্রমে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিই,' বলেন তিনি।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্র্যাক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৪০১ কোটি টাকা, যা তাদের বিতরণ করা ঋণের ৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ।

ব্যাংকটির বোর্ডে মোট আটজন পরিচালক রয়েছেন। তাদের মধ্যে সাতজনই স্বাধীন পরিচালক। বোর্ডে অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও অন্যান্য অভিজ্ঞ পেশাজীবীরাও অন্তর্ভুক্ত আছেন। এতে ব্র্যাক ব্যাংক একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেছে।

ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তারেক রেফাত উল্লাহ খান বলেন, 'ব্র্যাক ব্যাংকের মালিকপক্ষ ব্যবস্থাপনায় কোনো হস্তক্ষেপ করে না। বোর্ড নীতিমালা প্রণয়ন করে, আর ব্যবস্থাপনা দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করে।'

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ব্র্যাক ব্যাংক ঋণ আদায়ে রিকভারি বিভাগকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়, যা অনেক ব্যাংকে তুলনামূলকভাবে দুর্বল।

তিনি বলেন, 'এই বিভাগে আমরা অভিজ্ঞ পেশাজীবী নিয়োগ দিই, কারণ আদায় কার্যক্রম আমাদের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার। পাশাপাশি, সমস্যাগ্রস্ত ঋণগ্রহীতাদের ব্যবসা চালু রাখার সুযোগ দিই, যা ঋণ আদায়ে সহায়ক হয়।'

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা, যা তাদের বিতরণ করা ঋণের ৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ব্যাংকটি যথাযথ সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা কারও সুপারিশ বা নির্দেশে কাজ করিনি। এমনকি বোর্ডও ব্যবস্থাপনার কাজে কোনো প্রভাব খাটায় না। এ কারণেই আমরা খেলাপি ঋণ কম রাখতে পেরেছি।'

তিনি বলেন, 'কোনো ধরনের প্রভাব বা চাপের মুখে আমরা ঋণ অনুমোদন দিইনি। প্রতিটি বিভাগ আলাদাভাবে নথিপত্র পর্যালোচনা করে ঋণ অনুমোদন করা হয়। ব্যাংকের বোর্ড ও ব্যবস্থাপনা কোনো ধরনের স্বার্থের সংঘাত মেনে নেয় না।'