৯ মাসে গত বছরের মুনাফা ছাড়াল ৬ ব্যাংক
যদি প্রশ্ন করা হয়, চলতি বছর কেমন ব্যবসা হলো? হয়তো অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংকের উত্তর হবে, টিকে থাকতে রীতিমতো লড়াই করতে হয়েছে! কারণ হিসেবে উঠে আসবে—বছরব্যাপী আর্থিক অস্থিরতা, ঋণ দেওয়া-নেওয়ার প্রবণতা কমে যাওয়া এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি।
তবে ছয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংক এই ট্রেন্ড ভেঙে দিয়েছে। ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে এই ছয় ব্যাংকের মুনাফা ইতোমধ্যে গত বছরের মোট আয়কে ছাড়িয়ে গেছে।
ব্যাংকগুলো জানিয়েছে, মূলত ট্রেজারি বিল ও বন্ড থেকে পাওয়া মুনাফার কারণে তাদের আয় বেড়েছে।
অনেকের কাছে ব্যাপারটি বিস্ময়কর মনে হতে পারে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে শরিয়াভিত্তিক ইসলামী ব্যাংক সর্বোচ্চ মুনাফা বৃদ্ধির রেকর্ড ধরে রেখেছিল। তবে এবার সেই ধারা ভেঙে দিয়েছে এই ছয় ব্যাংক।
ব্যাংকগুলো হলো—ব্র্যাক ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক এবং ঢাকা ব্যাংক।
এছাড়া ইস্টার্ন ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক ও সিটি ব্যাংকও এ বছরের নয় মাসে ভালো মুনাফা করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে এই ব্যাংকগুলোকে টেকসই ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
এদিকে ইসলামী ব্যাংক গত নয় মাসে মুনাফার দিক থেকে ইতিবাচক অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছে। ব্যাংকটি নয় মাসে ৯৯ কোটি টাকা মুনাফা করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১০৮ কোটি টাকা।
যদিও ট্রেজারি বিল ও বন্ড থেকে পাওয়া রিটার্ন বা সুদ আয় ছয় ব্যাংকের মুনাফা বাড়াতে সহায়তা করেছে, তবে বিতরণ করা ঋণ থেকে তাদের সুদ আয় কমেছে। ঋণের সুদ মূলত ব্যাংকিং ব্যবসার আয়ের প্রধান উৎস।
সব মিলিয়ে এই ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ থেকে ৭ হাজার ৪১১ কোটি টাকা আয় করেছে। এই আয়ের বেশিরভাগই ট্রেজারি বন্ড থেকে এসেছে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৭০ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে তাদের নিট সুদ আয় ৩৩ শতাংশ কমে ২ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) অধ্যাপক শাহ মো. আহসান হাবিব বলেন, 'ব্যাংকিং বাজারের প্রতিযোগিতা অত্যন্ত অসম, তাই মুনাফায় ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায়।'
তিনি আরও বলেন, গত বছর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। তখন কয়েকটি ব্যাংক তদন্তের আওতায় আসে এবং বহুদিনের চাপা পড়ে থাকা মন্দ ঋণের তথ্য সামনে আসে।
২০২৪ সালে ব্যাংকগুলোর মন্দ ঋণ ৫৯ শতাংশ বেড়ে রেকর্ড ৭ লাখ ৫৬ হাজার ৫২৬ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এই পরিসংখ্যান দেশের আর্থিক খাতের নড়বড়ে অবস্থারই প্রতিচ্ছবি। এই ঋণ মোট বিতরণ করা ঋণের ৪৫ শতাংশ, প্রায় ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা, যা ২০২৫–২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের কাছাকাছি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মন্দ সম্পদের মধ্যে খেলাপি ঋণ ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, পুনঃতফসিলকৃত ঋণ ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৪৬১ কোটি টাক, রাইট-অব ঋণ ৬২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
বিআইবিএম অধ্যাপক শাহ মো. আহসান আরও বলেন, গ্রাহকরা দুর্বল ব্যাংক থেকে আমানত সরিয়ে ভালো ব্যাংকে রাখছে। ভালোভাবে পরিচালিত ব্যাংকগুলো আমানত টানতে পারলেও সামগ্রিক ব্যবসায়িক পরিবেশ এখনো অনিশ্চিত।'
তিনি আরও বলেন, কিছু উদ্যোক্তা কারখানা বন্ধ করেছেন বা বাজার ছেড়ে দিয়েছেন, ফলে ঋণের সামগ্রিক চাহিদা কমেছে। ব্যাংকগুলোও এখন ঋণ বিতরণে আগের চেয়ে অনেক সতর্ক। এছাড়া তারা পুরনো ঋণ উদ্ধারে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ, যা গত বিশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
তিনি বলেন, 'বর্তমানে ঋণের চাহিদা কম এবং বন্ড বাজার দুর্বল। তাই ব্যাংকগুলো মুনাফা ধরে রাখতে ট্রেজারি বন্ডে ঝুঁকছে।'
'যদিও ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিনিয়োগ থেকে আয় করছে, তবে আমরা আশা করি ঋণ বিতরণের মাধ্যমে শিল্প খাতকে সহায়তা করেব। তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে।'
নয় মাসে বেশি মুনাফা করা ব্যাংকগুলোর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংক ১ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা মুনাফা করেছে, যা ২০২৪ সালের ১ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা থেকে বেড়েছে। ব্যাংকটি জানিয়েছে, বিনিয়োগ আয় ও আমানত বৃদ্ধির ফলে তাদের মুনাফা বেড়েছে, যদিও ঋণ বৃদ্ধির হার ছিল কম।
পূবালী ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ৯০০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের ৭৬২ কোটি টাকার চেয়ে বেশি।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, গত নয় মাসে ব্যাংকের সম্পদের গুণগত মান উন্নত হয়েছে এবং সরকারি সিকিউরিটিজ থেকে ভালো রিটার্ন পাওয়া গেছে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, আন্তর্জাতিক ব্যবসা থেকেও আয় ভালো ছিল, কারণ অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতার কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
যমুনা ব্যাংক নয় মাসে ৪১৬ কোটি টাকা মুনাফা করেছে, যেখানে ২০২৪ সালে ছিল ২৭৯ কোটি টাকা। ব্যাংকের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বেশি বিনিয়োগ আয় এবং অন্যান্য অপারেটিং ইনকাম থেকে এই আয় এসেছে।
ব্যাংক এশিয়া মুনাফা করেছে ৩৫১ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের একই সময়ে ব্যাংকটির আয় ছিল ২৭৭ কোটি টাকা। ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে মূলত বিনিয়োগ আয় প্রায় দ্বিগুণ হওয়ায়, যা ৯৭৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১ হাজার ৯৩০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক নয় মাসে ৩৮৯ কোটি টাকা মুনাফা করেছে, যা আগের বছরের ১৬৯ কোটি টাকা থেকে বেশ বেশি।
ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'মুনাফা বৃদ্ধির পেছনে তিনটি কারণ ছিল, যথাক্রমে আমানতের সুদের হার স্থিতিশীল রাখা, পরিচালন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং বিনিয়োগ থেকে বেশি রিটার্ন পাওয়া।'
তিনি আরও উল্লেখ করেন, রপ্তানি-আমদানি ব্যবসায়ও ভালো আয় হয়েছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক বাণিজ্যে ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি নিয়ে তিনি আশাবাদী।
ঢাকা ব্যাংক নয় মাসে ১৪০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে, যা ২০২৪ সালের ১২৭ কোটি টাকার চেয়েও বেশি। ব্যাংকটি জানিয়েছে, পরিচালন মুনাফা কিছুটা কম হলেও আমানত বৃদ্ধির ফলে নগদ প্রবাহ বেড়েছে।
অন্য ব্যাংকগুলোও চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে ভালো মুনাফা করেছে, যদিও তারা এখনো ২০২৪ সালের আয়কে ছাড়াতে পারেনি।
যেমন—ইস্টার্ন ব্যাংক আগের বছরের তুলনায় ২৬ শতাংশ বেশি মুনাফা করে ৫৮৪ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
গত নয় মাসে প্রাইম ব্যাংক মুনাফা করেছে ৬৩০ কোটি টাকা, যেখানে গত বছর ছিল ৭৩২ কোটি টাকা।
সিটি ব্যাংক নয় মাসে মুনাফা করেছে ৭২২ কোটি টাকা এবং ডাচ-বাংলা ব্যাংক ২৫৬ কোটি টাকা মুনাফা করেছে।


