‘কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়’

মামুনুর রশীদ
মামুনুর রশীদ
19 October 2022, 06:56 AM

'নতুন' ঢাকার রাজপথ দাপিয়ে বেড়ানো ছবির এই ঘোড়াগুলো জীবনানন্দ দাশের 'মহীনের ঘোড়াগুলো' কি না- তা জানা যায়নি। তবে এটা বলা যায়, ঠাসবুনটের এই ঊষর নগরে 'কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে' ঘাস খাওয়ার কোনো সুযোগ নেই এই ঘোড়াগুলোর। তবুও তারা 'কেবলি দৃশ্যের জন্ম' দিয়ে চলে এই স্মৃতির নগরে।

বাংলা ভাষার আরেক প্রধান কবি শামসুর রাহমান ঢাকাকে নিয়ে 'একটি বিনষ্ট নগরের দিকে' শিরোনামের কবিতায় লিখেছিলেন, 'অচেনা জোৎস্নায় বুঝি এসে গেছি। চতুর্দিকে ঘোড়ার কঙ্কাল/ঝুলে আছে, দরজায় দরজায় ঊর্ণাজাল; এখানে সেখানে/বিষণ্ন কাদার মূর্তি এলোমেলো…'

horse-2.jpg
ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

আবার গত শতকের সত্তরের দশকের মধ্যভাগে রচিত কবির 'এই শহরে বহুদিন' শীর্ষক আত্মস্মৃতিমূলক নিবন্ধেও তিনি বলেন, 'এর (ঢাকার) শরীরে আছে প্রচুর ধুলো, হাওয়া রৌদ্র, জোৎস্না, ভেজা মাটির গন্ধ, ঘাসের স্পর্শ, ঘোড়ার গাড়ির শব্দ, বিস্কুটের টক-টক ঘ্রাণ।…কখনো ছ্যাকড়া গাড়ির চাকায়, কখনোবা রিকশার ঘণ্টির রিনধিন আওয়াজে ঢাকা ঝংকৃত হয়ে ওঠে আমার চেতনায়।'

৪০০ বছরের প্রাচীন শহর ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন হয়েছিল দেড়শ বছরেরও বেশি সময় আগে। দশকে দশকে এই স্মৃতির শহরের অবয়ব বদলেছে। মোগল আমলের ঢাকা, ব্রিটিশ আমলের ঢাকা, পাকিস্তান আমলের ঢাকা আর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মধ্যে পার্থক্য এখন অনেক।

horse-3.jpg
ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

তাই কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া এবং ঘোড়ার গাড়ির এতিহ্যের গায়েও ধুলা জমেছে। কদরও তেমন নেই। তারপরও অনাদর-অবহেলায় চলছে সংশ্লিষ্টদের টিকে থাকার লড়াই।

এখানেও জীবনানন্দের বিখ্যাত 'ঘোড়া' কবিতার দুটি লাইন ধার করে বলা যায়, 'প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন—এখনও ঘাসের লোভে চরে/পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর 'পরে।'

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তার 'ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী' গ্রন্থে বলছেন, ১৮৫৬ সালে আর্মেনীয়দের হাত ধরে ঢাকায় প্রথম ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন হয়, যা শুরুতে পরিচিত ছিল 'ঠিকা গাড়ি' নামে। সময় পরিক্রমায় আর্মেনীয় প্রতিষ্ঠান 'সিরকো অ্যান্ড সন্স'র এই ব্যবসা জমে ওঠে। ঘোড়ার গাড়ি হয়ে ওঠে ঢাকার প্রধান বাহন। ১৮৬৭ সালে ঠিকা গাড়ির সংখ্যা ছিল ৬০। ১৮৮৯ সালের দিকে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৬০০টিতে।

horse-4.jpg
মিরপুর ১২ নম্বরের সাগুফতা লেকপাড়ে ঘাস খাচ্ছে একটি ঘোড়া। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

একসময় রাজা-জমিদাররা নানা কাজে ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করতেন। গত শতকের ষাটের দশকে তা সাধারণ নাগরিকদের আওতায় চলে আসে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বিয়েসহ বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে ঘোড়ার গাড়ির ডাক পড়তে থাকে।

এখন এই বাহনটি টমটম নামেই বেশি পরিচিত। গুলিস্তান-সদরঘাট রুটে নিয়মিত যাত্রী পরিবহন ছাড়াও টমটম ব্যবহৃত হয় বিয়ে, পূজাসহ বিভিন্ন দিবসের শোভাযাত্রা ও সিনেমার শুটিংয়ে। এছাড়া অনেকে ঘোড়ার গাড়িতে ভ্রমণ করেন মূলত বিনোদনের উদ্দেশ্যে। পুরান ঢাকায় বিয়েতে আজও ঘোড়ার গাড়িকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

horse-5.jpg
বঙ্গবাজারের মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে নিচে অস্থায়ী আস্তাবলে রাখা ঘোড়ার খুনসুটি। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

কিন্তু ঢাকায় ঘোড়ার জন্য কোনো আস্তাবল নেই এখন। বর্তমানে বঙ্গবাজার এলাকায় মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের জায়গাটি ব্যবহৃত হয় অস্থায়ী আস্তাবল হিসেবে।