শ্রম আইন সংশোধনকে কেন্দ্র করে নতুন বির্তক

রেফায়েত উল্লাহ মীরধা
রেফায়েত উল্লাহ মীরধা

বাংলাদেশ শ্রম আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫–এর খসড়াটি গত মাসে অনুমোদন করেছে উপদেষ্টা পরিষদ। কিন্তু এই খসড়াটি কারখানার মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধি—উভয়কেই বিস্মিত করেছে।

শিল্প নেতাদের মতে, ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের বিষয়ে অনুমোদিত খসড়াটি আগের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তার সঙ্গে মেলে না। ওই বৈঠকে মালিক, শ্রমিক ও সরকারি প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছিলেন।

তারা বলেন, ইউনিয়ন নিবন্ধনের নিয়ম এখন আগের চেয়ে অনেক সহজ করা হয়েছে। ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদের (টিসিসি) বৈঠকে যে সংখ্যায় সবাই একমত হয়েছিল, তার চেয়েও কম শ্রমিকের সম্মতিতে নিবন্ধনের বিধান রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সতর্ক করে বলেছে, এই পরিবর্তন শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা না করে, বরং কারখানায় বিভ্রান্তি ও অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।


শ্রম আইন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সবচেয়ে বড় মঞ্চ টিসিসি। সংগঠনটি শ্রম আইন সংশোধনের বৈঠকগুলোতে ইউনিয়ন গঠনের জন্য আগের নিয়মে ২০ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতির শর্ত বাতিল এবং তার বদলে ধাপে ধাপে নতুন নিয়ম চালুর সিদ্ধান্তে একমত হয়েছিল।

সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ৫০ থেকে ৫০০ শ্রমিকের কারখানায় অন্তত ৫০ জন শ্রমিকের সম্মতিতে ইউনিয়ন গঠন করা যাবে। ৫০১ থেকে ১ হাজার শ্রমিক থাকলে ১৫০ জনের সম্মতি লাগবে। 

১ হাজার ১ থেকে ৩ হাজার শ্রমিক থাকলে ৩০০ জনের সম্মতি প্রয়োজন হবে। ৩ হাজারের বেশি শ্রমিক থাকলে ৪০০ জনের সম্মতিতে ইউনিয়ন করা যাবে।

এছাড়া, একটি কারখানায় সর্বোচ্চ পাঁচটি ইউনিয়ন গঠনের সুযোগ রাখার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছিল।

কিন্তু উপদেষ্টা পরিষদ এই সংখ্যা আরও কমিয়ে দিয়েছে। নতুন খসড়ায় এই সীমা অনেক নিচে নামানো হয়েছে।

খসড়াটি অনুযায়ী—২০ থেকে ৩০০ শ্রমিকের কারখানায় মাত্র ২০ শ্রমিকের সম্মতিতেই ইউনিয়ন গঠন করা যাবে। ৩০১ থেকে ৫০০ শ্রমিক থাকলে ৪০ জনের সম্মতি লাগবে।

৫০১ থেকে ১ হাজার ৫০০ শ্রমিক থাকলে ১০০ জনের সম্মতি যথেষ্ট হবে। ১ হাজার ৫০১ থেকে ৩ হাজার শ্রমিকের ক্ষেত্রে ৩০০ জনের এবং ৩ হাজারের বেশি শ্রমিক থাকলে ৪০০ জনের সম্মতি প্রয়োজন হবে।

এখন উপদেষ্টা পরিষদ এই খসড়াটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে যাচাইয়ের জন্য। সেখানে পর্যালোচনার পর এটি রাষ্ট্রপতির দপ্তরে যাবে অনুমোদনের জন্য। সংসদ অধিবেশন না থাকায় এটি অধ্যাদেশ হিসেবে জারি করা হবে।

বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর চাপের মুখে শ্রম আইন হালনাগাদ করছে, যেন বৈশ্বিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য আনা যায়।

শক্তিশালী শ্রম অধিকার নিশ্চিত করা দেশের বাণিজ্য প্রতিযোগিতা বাড়ানো, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ, জিএসপি সুবিধা পুনরুদ্ধার এবং নতুন বাণিজ্য চুক্তি সইয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

তবু পোশাক কারখানার মালিকরা আশঙ্কা করছেন, এতটা সহজ শর্ত উল্টো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।

তাদের মতে, বাইরের গোষ্ঠী বা প্রভাবশালী পক্ষগুলো সহজেই ইউনিয়ন গঠনে যুক্ত হতে পারে। ফলে অরাজকতা, বিভ্রান্তি ও সংঘাত দেখা দিতে পারে কারখানাগুলোয়।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, 'আমরা চাই সরকার টিসিসি বৈঠকের সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করুক। কারণ সেই সিদ্ধান্তে সব পক্ষের পরামর্শ নেওয়া হয়েছিল।'

তিনি আরও বলেন, 'যদি টিসিসির সিদ্ধান্ত অনুমোদন না পায়, তাহলে বর্তমান ২০ শতাংশ বা তার চেয়েও কম শ্রমিকের সম্মতির যে নিয়ম আছে, সেটিই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য।'

বর্তমান আইনে ইউনিয়ন গঠনের জন্য মোট শ্রমিকের ২০ শতাংশের সম্মতি প্রয়োজন।

টিসিসির আলোচনায় মালিকপক্ষ আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তা ১৫ শতাংশে নামাতে রাজি হয়। অন্যদিকে শ্রমিক সংগঠনগুলো ১০ শতাংশে নামানোর দাবি জানিয়েছে।

সরকার, মালিক ও শ্রমিক—প্রতিটি পক্ষ থেকে ২০ জন করে প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত এই পরিষদে এই শতাংশের পরিমাণ নিয়ে বিতর্ক হয়।

হাতেম বলেন, 'যদি সরকার ১০ ও ১৫ শতাংশের মাঝামাঝি ১২ দশমিক ৫ শতাংশে নির্ধারণ করত, তাহলে ভালো হতো। আমরা ১২ দশমিক ৫ শতাংশের প্রত্যাশা করেছিলাম। কিন্তু টিসিসির সিদ্ধান্ত পাশ কাটানো হয়েছে বলে আমরা ভিন্নমত দিয়েছি।'

তিনি উদাহরণ হিসেবে আদমজী জুট মিলস ও লক্ষ্মীনারায়ণ জুট মিলসের কথা বলেন। তার মতে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো অতিরিক্ত শ্রমিক রাজনীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের (এনজিডব্লিউএফ) সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, '২০ শতাংশ থেকে কিছুটা কমানো যেতে পারে আলোচনার মাধ্যমে, কিন্তু হঠাৎ করে এতটা কমিয়ে ফেলা উচিত নয়।'

তিনি বলেন, 'দেশের শ্রম আইন আন্তর্জাতিক মানে হালনাগাদ করা প্রয়োজন, এটা ঠিক। তবে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কথাই হুবহু অনুসরণ করতে হবে, এমন নয়।'

তার মতে, যদি ২০ শ্রমিকের সীমা নির্ধারণ করা হয়, তাহলে নকল বা ভুয়া ইউনিয়ন ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা শ্রমিক-মালিক সম্পর্ককে আরও জটিল করবে।

বাংলাদেশ অ্যাপারেলস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি তৌহিদুর রহমান বলেন, 'বড় কারখানাগুলো হয়তো সামলাতে পারবে, কিন্তু ছোট কারখানাগুলো মারাত্মক সমস্যায় পড়বে।'

তবে তিনি আরও যোগ করেন, 'যদি কোনো ভুল থেকে থাকে, সংশোধনের সুযোগ এখনো আছে।'

সম্মিলিত গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার জানান, তিনি টিসিসির আলোচনায় নির্ধারিত ৫০–৫০০ শ্রমিকের সীমাকে সমর্থন করেন। যদি ২০ শ্রমিকের সীমা কার্যকর হয়, তাহলে পোশাক শিল্প বিপাকে পড়বে বলে মনে করেন তিনি।

তবে তিনি সংশোধনীর অন্যান্য শ্রমিকবান্ধব পদক্ষেপ, যেমন নতুন মজুরি বোর্ড গঠনের প্রস্তাবকে স্বাগত জানান।

একজন সাবেক বিজিএমইএ সভাপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'যে কোনো আকারের কারখানায় ২০ শ্রমিক দিয়ে ইউনিয়ন গঠন করা অত্যন্ত বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করবে।'

সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান সতর্ক করেন, 'যদি এই অযৌক্তিক প্রস্তাবগুলো অনুমোদিত হয়, তাহলে রপ্তানি, বিদেশি বিনিয়োগ ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ঝুঁকির মুখে পড়বে।'

বিজিএমইএ সংশোধনীর পুনর্বিবেচনা দাবি করেছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জাফরুল হাসান শরীফ বলেন, প্রস্তাবিত সীমা কার্যকর হলে বহু ইউনিয়ন গঠিত হতে পারে।

তবে মন্ত্রিসভা চাইলে টিসিসির যেকোনো সিদ্ধান্ত সংশোধন বা বাতিল করার ক্ষমতা রাখে।

শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, বড় পোশাক কারখানাগুলোর ক্ষেত্রে এই সীমা তেমন প্রভাব ফেলবে না, কারণ সেগুলো ২০ শ্রমিকের সীমার আওতায় পড়ে না। ছোট কারখানাগুলোই সমস্যায় পড়তে পারে।

তার মতে, ইউনিয়ন গঠনের নিয়ম সহজ করা মানে এই নয় যে সব কারখানাই ইউনিয়ন কার্যক্রম চালাতে দেবে। তবে সুস্থ ইউনিয়ন কার্যক্রম গড়ে তোলা গঠনমূলক শিল্প সম্পর্কের জন্য জরুরি।

শ্রম মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'নির্ধারিত পদ্ধতি মেনেই সীমাগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে। টিসিসির সিদ্ধান্তগুলো সংশোধনীর খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত আছে।'

তিনি শ্রমিকসংখ্যার হিসাব ঠিক হয়নি বলে মালিকদের অভিযোগকে অস্বীকার করেন।

শ্রম ও কর্মসংস্থানবিষয়ক উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, 'এটি এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়।' তিনি বিস্তারিত কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান।