সারা জীবনের সঞ্চয় আটকে আছে ৯ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে, অনিশ্চয়তায় গ্রাহকরা

মো. মেহেদী হাসান
মো. মেহেদী হাসান
21 September 2025, 05:59 AM
UPDATED 21 September 2025, 12:07 PM

৬৪ বছর বয়সী খলিল আহমেদ খান তার ২৩ লাখ টাকার একটি স্থায়ী আমানত (এফডিআর) রেখেছিলেন আভিভা ফাইন্যান্সে। চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি মেয়াদ পূর্ণ হলেও এখন পর্যন্ত তিনি পেয়েছেন মাত্র ৮ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। বাকি টাকার জন্য প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে বারবার ঘুরেও কোনো লাভ হয়নি।

উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের রোগী খলিল আহমেদের মতো হাজারো মানুষ তাদের চিকিৎসার খরচ ও দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে সারা জীবনের সঞ্চয়ের অর্থ রেখেছেন বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। প্রতিষ্ঠানগুলো সংকটে থাকায় গ্রাহকরাও এখন বিপদে আছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক এরকম নয়টি প্রতিষ্ঠানগুলো অবসায়নের পরিকল্পনা করায় গ্রাহকদের প্রায় ১৫,৩৭০ কোটি টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। গ্রাহকেরা বলছেন, তারা এমন ভুলের শাস্তি পাচ্ছেন, যার জন্য তারা নিজেরা দায়ী নন।

খলিল আহমেদ বলেন, 'আমার পাওনা ও চিকিৎসার খরচ মেটাতে এই মাসে টাকা জরুরি দরকার। কিন্তু কবে পাব, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।'

যে ৯টি প্রতিষ্ঠান অবসায়নের পথে প্রতিষ্ঠানগুলো হলো— এফএএস ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি, প্রিমিয়ার লিজিং, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স, প্রাইম ফাইন্যান্স, আভিভা ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং এবং ইন্টারন্যাশনাল লিজিং।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এই ৯টি প্রতিষ্ঠানে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের মোট ১৫,৩৭০ কোটি টাকা আটকা পড়েছে। এর মধ্যে ৩,৫২৫ কোটি টাকা সাধারণ মানুষের এবং বাকি ১১,৮৪৫ কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যাংক ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের।

ব্যক্তি আমানতকারীদের সবচেয়ে বেশি ১,৪০৫ কোটি টাকা আটকা পড়েছে পিপলস লিজিংয়ে। এছাড়া আভিভা ফাইন্যান্সে ৮০৯ কোটি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে ৬৪৫ কোটি এবং প্রাইম ফাইন্যান্সে ৩২৮ কোটি টাকা আটকা রয়েছে।

আভিভা ফাইন্যান্সের অনেক গ্রাহক তাদের ভোগান্তির কথা জানালেও ভয়ে নাম প্রকাশ করতে চাননি। অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা জানান, তার ৮০ লাখ টাকা আভিভায় আটকে আছে। ৬৫ বছর বয়সী এই ব্যক্তি হৃদরোগসহ নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন, কিন্তু চিকিৎসার জন্য টাকা তুলতে পারছেন না। এ বিষয়ে জানতে আভিভা ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোদাসসের হাসানের সঙ্গে ফোনে ও মেসেজে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

গত সপ্তাহে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের দুর্দশার কথা জানান পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারীরা। তারা বলেন, অনেক অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি পরিবারের খরচ, চিকিৎসা ও সন্তানের পড়াশোনার জন্য এই টাকার ওপর নির্ভরশীল। টাকা ফেরত পাওয়ার অপেক্ষায় এ পর্যন্ত অন্তত ৩৫ জন আমানতকারী মারা গেছেন বলেও তারা জানান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ৯টি প্রতিষ্ঠানকে অবসায়নের জন্য সরকার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে এবং অর্থ কোম্পানি আইন, ২০২৩-এর অধীনে শিগগিরই প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। তবে কীভাবে এই অবসায়ন প্রক্রিয়া চলবে এবং আমানতকারীরা কীভাবে তাদের টাকা ফেরত পাবেন, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা জারি করেনি।

এদিকে, এই সিদ্ধান্তের কারণে পুরো খাতের ওপরই গ্রাহকদের আস্থা কমে যাচ্ছে বলে মনে করছেন অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। মিডাস ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অবসায়নের সিদ্ধান্তে আমরা মারাত্মক সমস্যায় পড়েছি, কারণ গ্রাহকেরা আমাদের ওপরও আস্থা হারাচ্ছেন।'

তিনি এই খাতের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তারল্য সহায়তার দাবি জানান।

খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দীর্ঘদিনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও দুর্বল তদারকির কারণেই এনবিএফআই খাতের এই দুর্দশা। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ৩৫টি এনবিএফআইয়ের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭,১৮৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫.৩২ শতাংশ।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া বেশিরভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠানই সমস্যায় জর্জরিত। স্বার্থান্বেষী মহলের প্রভাব ও অভ্যন্তরীণ ঋণ অনিয়মকে এর অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।

তার মতে, এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে সংলাপ প্রয়োজন, যার মাধ্যমে একটি কার্যকর সমাধান বেরিয়ে আসতে পারে।