সঙ্গীত যখন রসায়নের ভাষা

By আখিউজ্জামান মেনন
31 May 2022, 15:41 PM
UPDATED 31 May 2022, 22:07 PM

যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষক দাবি করেছেন, বস্তুর আণবিক কাঠামোকে চাইলে সঙ্গীতে রূপান্তর করা সম্ভব। যেখানে সঙ্গীতের স্বর হিসেবে কাজ করবে যৌগের উপাদান এবং সুরের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে পরমাণু ও রাসায়নিক বন্ধনের বিন্যাস।

গবেষকরা জানিয়েছেন, এটা যে শুধু বিজ্ঞান এবং শিল্পের মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ অন্তঃনির্ভরশীল সম্পর্ক তৈরির ক্ষমতা রাখে তাই না, বরং গবেষকদের নিরীক্ষা সফল হলে তার ব্যবহার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিশ্ব বিপুলভাবে উপকৃত হতে পারে। এর অন্যতন কারণ হচ্ছে মানুষের মতোই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আছে সঙ্গীত বিশ্লেষণ করার দুর্দান্ত সক্ষমতা।   

2.png
 

জৈব রাসায়নিক গঠন ও মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের পরীক্ষা

জৈব রাসায়নিক গঠনে মূলত যৌগের পরমাণু, রাসায়নিক বন্ধনের বিন্যাসসহ বিভিন্ন তথ্য প্রোথিত থাকে। আর এই তথ্য ধারণ ও প্রকাশ সাধারণত রেখাভিত্তিক ছবির মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ রাসায়নিক গঠনের আমরা যে পঞ্চ, ষড়ভূজাকার ছবি দেখি সেগুলোর মাধ্যমে। মাঝেমাঝে রাসায়নিক গঠন উপাস্থাপনে গ্রাফসহ আরও কিছু পন্থারও সাহায্য নেওয়া হয়। কিন্তু কম্পিউটারভিত্তিক যৌগের অধ্যয়ন, গবেষণায় এই পন্থাগুলো খানিকটা জটিলতার সৃষ্টি করে।
 
প্রেক্ষাপট

বেনজিনের মতো জৈব যৌগের গঠন প্রকাশ করতে গিয়ে আমরা যে ষড়ভূজাকৃতির এক ছবি আঁকি তা আমাদেরকে বেনজিনের বৈশিষ্ট্য জানতে এবং আমাদের চোখে তার কাঠামো সম্পর্কে একটা ধারণা দিতে সহযোগিতা করে। কিন্তু কম্পিউটার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বেনজিনের এমন ছবি দ্রুততার সঙ্গে বিশ্লেষণ করতে, কাজে লাগাতে সমস্যায় পড়ে যায়। এর কারণ, তাদের জন্য অক্ষর বা সংখ্যা অতি দ্রুত চেনা-বোঝা যতটা সহজ; কোনো প্রকার ছবি, আঁকাআঁকি ততটা না।
         
আর এই কারণেই পেশাদার রসায়নবিদরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছে যৌগের গঠন উপাস্থাপনে অক্ষর এবং সংখ্যার সাহায্য নিয়ে থাকেন। সেগুলো প্রকাশের জন্য স্মাইলস (SMILES), স্মার্টের (SMART) মতো আকর্ষণীয় নামও আছে। 

যেমন মেশিন বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যাতে বেনজিনকে চিনতে পারে, পড়তে পারে তাই তাকে c1ccccc1 বা C1=CC=CC=C1 এর মতো অক্ষরভিত্তিক পন্থায় উপাস্থাপন করা হয়।
 
এমন উপাস্থাপনের এক ধরনের জটিলতা হচ্ছে ছবির তুলনায় এতে তুলনামূলক কম তথ্য সমাহার করতে পারার সীমাবদ্ধতা।

capture.png

  
অন্যদিকে, বেনজিনের এমন অক্ষরভিত্তিক উপাস্থাপন- তাতে অল্প সংখ্যক পরমাণু থাকায়- আমাদের চোখে সয়ে যায়, কিন্তু যখন বৃহৎ কোনো যৌগের উপাস্থাপনে এমন পন্থার আশ্রয় নেওয়া হয় তখন আমাদের জন্য বিপত্তির দেখা মেলে, চোখের শ্রাদ্ধ ঘটে। দেখা যায় যে, জটিল কোনো রাসায়নিক গঠনকে এরকম অক্ষরভিত্তিক উপায়ে প্রকাশ করতে গিয়ে এক টুকরা কাগজ তো আর কী? এমনি এক বিশাল দেয়াল ভর্তি হয়ে গেছে!
 
অন্যদিকে, সঙ্গীত যেহেতু সুর, তাল, লয়সহ বহু দিকের সমন্বয়ে গঠিত এক শিল্প তাই একে তথ্য বিজ্ঞানের আওতায় বিবেচনা করলে বলা যেতে পারে যে সঙ্গীত বহুমাত্রিক তথ্য সংরক্ষণের একটা মাধ্যম এবং তা মানুষ ও কম্পিউটারের মধ্যকার মিথষ্ক্রিয়া, ব্যাখ্যা, সৃজনশীলতাকে সর্বোচ্চ সীমায় নিয়ে যেতে পারে। 

তাই আণবিক তথ্য সংরক্ষণের জন্য মিশিগানের গবেষকরা সঙ্গীতকেই বেছে নিয়েছিলেন। সঙ্গীতের মাধ্যমে আণবিক তথ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তারা সঙ্গীতের তাল, লয়, সুর ইত্যাদির মাধ্যমে যৌগের নানাবিধ বৈশিষ্ট্যকে ধারণ ও প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। চমৎকার সফলতাও মিলেছে তাদের সেই প্রচেষ্টায়। 

ব্যবহৃত কৌশল

গবেষকরা এ কাজে যে কৌশলটির ব্যবহার করেছেন তাকে বলা হয় মলিকিউলার সোনিফিকেশন অর্থাৎ আণবিক বা যৌগিক তথ্যকে অডিও বা শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা। কৌশলটি বহুল ব্যবহৃত ডাটা সোনিফিকেশনেরই একটা ধারা। যা ইতোমধ্যে হৃদরোগ শনাক্তসহ আরও বহু কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।
 
গবেষক দলের গৃহীত পন্থায় তারা যৌগের বিভিন্ন ভৌত-রাসায়নিক উপাদানকে মিউজিক্যাল কী বা সঙ্গীতের স্বর দ্বারা প্রতিনিধিত্ব করান।

যৌগের বিভিন্ন ভৌত-রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য যেমন আণবিক ভর, হাইড্রোজেন বন্ধন ইত্যাদিকে গাণিতিক উপায়ে একত্র করেন এবং সঙ্গীতের ১২টা স্বরে অনুবাদ বা রূপান্তর করেন।
  
গবেষণার বিভিন্ন দিক  

গবেষকরা নিজেদের ব্যবহৃত অ্যালগরিদম কতটা কার্যকরী তা দেখার জন্য লিপিনস্কির বিধান উতরানো যৌগ কী ধরনের সুর সৃষ্টি করে আর সেই সুর লিপিনস্কির মানদণ্ড সমূহে অনুত্তীর্ণ যৌগ থেকে ভিন্ন কি না তা দেখার চেষ্টা করেন। এবং তারা এই ২ ধরনের যৌগের সৃষ্ট ভিন্ন ভিন্ন সুর পর্যবেক্ষণ করেন, যা তাদের নিরীক্ষার ডানায় সফলতার পালক যোগ করে।
 
প্রাথমিকভাবে কোনো রাসায়নিক যৌগের ঔষধ হওয়ার সম্ভাবনা দেখার জন্য যৌগের হাইড্রোজেন বন্ধনের সংখ্যা, আণবিক ভরসহ মোট ৪টি মানদণ্ডে সেই যৌগকে যাচাই করার বিধানকে লিপিনস্কি বিধান বলা হয়।
    
পরীক্ষায় গবেষক দল আরও দেখতে পান যে দুই ধরনের যৌগ ভিন্ন ভিন্ন যে সঙ্গীত সৃষ্টি করেছিল তার মধ্যে রয়েছে আবেদনের ব্যাপক পার্থক্য। আবার একই রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের বিভিন্ন যৌগের প্রায় একই রকম সঙ্গীত সৃষ্টি করতে দেখা গেছে। অন্যদিকে তারা নিজেরা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তা নিয়ে নতুন সুরের মধ্য দিয়ে নতুন যৌগ সৃষ্টির প্রক্রিয়াও চালিয়ে সফল হন।
 
এর সঙ্গে, গবেষণার অংশ হিসেবে কয়েজজন স্বেচ্ছাসেবককে কয়েকটা গান শুনতে দেওয়া হয়েছিল। যেই গানগুলো সৃষ্টি করা হয়েছিল তাদের সেই মলিকিউলার সোনিফিকেশন পদ্ধতির মাধ্যমে। স্বেচ্ছাসেবকদের একই রকম শুনতে গানগুলোকে বাছাই করতে দেওয়া হয়েছিল এবং স্বেচ্ছাসেবকদের প্রায় সবাই একই রকম বৈশিষ্ট্যের যৌগ থেকে যেসব গান তৈরি করা হয়েছিল ঠিক সেই গানগুলোকেই শুনতে একই রকম বলে বাছাই করেছিলেন! 

পরীক্ষার অসাধারণ কিছু ফলাফল  

পরীক্ষায় যেখানে অ্যামোনিয়াকে শুধু একটা নোট বা স্বর হিসেবে হাজির হতে দেখা গিয়েছিল সেখানে বেনজিন সৃষ্টি করেছিল খানিকটা জটিল সুর-সঙ্গীত।

twinkel2.png

অন্যদিকে, ডি-ফ্ল্যাটে টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটল স্টার গান যখন যৌগে রূপান্তর করা হয় তখন নিচের যৌগটিকে পাওয়া যায়। 
 

tolmetin.png


আবার টলমেটিনের মতো যৌগকে দেখা যায় বেশ উন্নত সুর-সঙ্গীত সৃষ্টি করতে এবং অক্সিটসিন সৃষ্টি করেছিল বেশ সূক্ষ্ম মিষ্টি সুর। 

প্রয়োগ
 
সঙ্গীতের চমৎকার আবেদন এবং আবেগের সঙ্গে এর সহজভাবে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা থাকায় রসায়নের বিভিন ধারণা বুঝতে সঙ্গীতকে ব্যবহার করা যেতে পারে। কেউ একজন গান করতে করতে কোনো রাসায়নিক গঠন সৃষ্টি করছে- বেশ চমৎকার এক দৃশ্য হবে যদি মিশিগানের গবেষকদের পরীক্ষা সম্পূর্ণভাবে সফলতার মুখ দেখে।     
এরইসাথে যৌগের সোনিফিকেশন বা যৌগ সম্পর্কে ধারণা পেতে শব্দের সহায়তা নেয়ার পদ্ধতি রসায়নে আগ্রহী, গবেষক কোনো অন্ধ ব্যক্তির জন্য দারুণ সাহায্যে বিষয় হয়ে উঠতে পারে। 
 
সাম্প্রতিক সময়ে নতুন ঔষধ, রাসায়নিক উপাদান তৈরি করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নেওয়া হচ্ছে। সেক্ষত্রে যৌগের এমন সোনিফিকেশন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাজকে অনেক গতি দিতে পারে। এক্ষেত্রে আছে নভেল প্রোটিন তৈরির মতো সফলতার ঘটনা।  
নতুন যৌগ সৃষ্টির ক্ষেত্রেও এই সঙ্গীত পন্থার সাহায্য নেওয়া যাবে বলে গবেষকদের দাবী। অন্যদিকে যৌগও পারবে নতুন নতুন সঙ্গীত, সুর তৈরি করতে।