এভাবে গণভোটে কি জনমত যাচাই হয়, নাকি শুধুই রাবার স্ট্যাম্প?
দেশে একটা গণভোট হবে, সেটা এখন প্রায় নিশ্চিত। সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ৪৮টি প্রস্তাবের ওপর এই 'হ্যাঁ-না' ভোট হবে। হয় সাধারণ নির্বাচনের দিন, নয়তো তার আগেই। জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি সমমনা ইসলামপন্থি দলের দাবি অনুযায়ী নভেম্বরেই।
ঐকমত্য কমিশন প্রস্তাব করেছে, সংবিধান সম্পর্কিত মূল প্রস্তাবগুলো গণভোটে দেওয়া হবে। গণভোটে প্রশ্নটি হবে এমন: আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সাংবিধানিক সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং এই আদেশের প্রথম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত সাংবিধানিক সংস্কারের প্রস্তাবগুলো অনুমোদন করছেন?
বিকল্প আরেকটি প্রস্তাব হলো, গণভোটের প্রশ্নে একটি খসড়া বিলের কথা উল্লেখ থাকবে, যে বিলে সংস্কার প্রস্তাবগুলো থাকবে। এই বিলটি নতুন সংসদকে (যা গণপরিষদ হিসেবেও কাজ করবে) প্রস্তাবগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত (বা আলোচনার ভিত্তিতে সেটা প্রত্যাখ্যানও হতে পারে) করার জন্য ২৭০ দিন সময় দেবে। বিলটিতে একটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যদি ২৭০ দিনের মধ্যে কোনো সিদ্ধান্ত না হয়, তবে প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাবে। একটি নির্বাচিত সংসদ থাকা সত্ত্বেও সংবিধানের বড় ধরনের সংশোধন প্রস্তাব কতোটা হাস্যকর, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এই লেখার উদ্দেশ্য না হলেও, সেটা উল্লেখ না করলেও হয় না।
গণভোটের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। গণভোটের দুটি বিকল্প প্রস্তাবের মোদ্দা কথা একই। ভোটারদের একসঙ্গে ৪৮টি প্রস্তাবের পুরো প্যাকেজকে 'হ্যাঁ' বা 'না' বলতে হবে; যা কেবল অবাস্তবই নয়, অগণতান্ত্রিকও বটে।
কেন এটি অবাস্তব, তা দিয়েই শুরু করা যাক। আলোচ্য ৪৮টি প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মাসব্যাপী আলোচনার ফসল। এরপরও কিছু দল 'নোট অব ডিসেন্ট' বা ভিন্নমত দিয়ে তাদের অসম্মতি জানিয়েছে। বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। কারও মতে প্রস্তাবগুলো অনেক বেশি পরিবর্তন আনছে, আবার কারও মতে যথেষ্ট পরিবর্তনই হচ্ছে না। রাজনৈতিক আলোচনার আরেকটি বিষয় ছিল। প্রস্তাবগুলো বাস্তবে কীভাবে কাজ করবে এবং রাষ্ট্র পরিচালনাকে কতটা সহজ বা জটিল করে তুলবে, সরকারকে কতটা জবাবদিহি করবে তার নিরিখে আলোচনা হয়েছে। সেজন্যে ঐকমত্যে পৌঁছানো সহজ ছিল না, আর বাস্তবে সেটা হয়ওনি।
উদাহরণ হিসেবে সংসদের উচ্চকক্ষের কথা বলা যায়। উচ্চকক্ষের ধারণাটি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য সামান্যই। কিন্তু বর্তমান প্রস্তাবে উচ্চকক্ষকে কোনো বিল আটকে দেওয়ার মতো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। উচ্চকক্ষ বড়জোর নিম্নকক্ষের পাঠানো কোনো বিল অনুমোদন করতে অস্বীকৃতি জানাতে পারবে। কিন্তু এরপর নিম্নকক্ষের আর কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না। চাইলে বিলটি সংশোধন করে আবার উচ্চকক্ষে পাঠাতে পারে নিম্নকক্ষ। কিন্তু না চাইলে নিম্নকক্ষে বিলটি দ্বিতীয়বার ভোটে পাস করিয়ে সরাসরি রাষ্ট্রপতির কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানোর এখতিয়ার নিম্নকক্ষের হাতেই থাকছে। এমনকি সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ গঠিত হলে সংবিধান সংশোধনীতে এর কোনো ভূমিকা থাকার ব্যাপারেও কয়েকটি দল আপত্তি জানিয়েছে।
আবার, আপাতদৃষ্টিতে একটি সাধারণ প্রস্তাব নেওয়া যাক—বাংলাদেশের জনগণকে জাতি হিসেবে 'বাঙালি'র উল্লেখ বাদ দিয়ে 'বাংলাদেশি' বলা হবে। এর বিরুদ্ধেও অনেকে অবস্থান নেবেন। অনেকেই মনে করতে পারেন তাদের পরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তাদের বাঙালিত্ব, আর এই সংশোধনের মাধ্যমে তারা সেটা হারাতে বসেছেন। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি পরিবর্তনের বিষয়েও কয়েকটি দল আপত্তি জানিয়ে বলেছে—গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা থাকতে হবে। কেউ বলেছে তার সঙ্গে অন্যকিছু যোগ করা যেতে পারে।
মূল কথা হলো, এমন ৪৮টি প্রস্তাবের একটি প্যাকেজে দুজন মানুষের পক্ষেও পুরোপুরি একমত হওয়া প্রায় অসম্ভব। প্রতিটি প্রস্তাবেরই সূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণ প্রয়োজন। একজন ভোটার হয়তো ৪৭টি প্রস্তাবের সঙ্গে একমত, কিন্তু একটি প্রস্তাবের কারণে তাকে 'না' ভোট দিতে হতে পারে, যা পুরো আয়োজনকেই অর্থহীন করে দেবে। এর বদলে, প্রতিটি প্রস্তাবের ওপর আলাদাভাবে মতামত নেওয়া উচিত। একসঙ্গে একগুচ্ছ প্রস্তাব চাপিয়ে দেওয়ার মধ্যে 'হয় পুরোটাই নাও, না হয় পুরোটাই ছাড়ো' ধরনের একটি বার্তা থাকে। এমন প্রশ্ন দিয়ে গণভোট আয়োজন করা ভোটারদের কাছ থেকে 'না' শোনার আমন্ত্রণ জানানোরই নামান্তর।
এবার আসা যাক এই গণভোটের অগণতান্ত্রিক চরিত্র প্রসঙ্গে। সাংবিধানিক প্রস্তাবগুলো অত্যন্ত জটিল এবং এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। প্রস্তাবগুলোর অর্থ ও তাৎপর্য বুঝতে হলে বার বার পড়া ও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। যারা ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, জুলাই সনদ বেশ কয়েকবার পড়েছেন এবং পুরো প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করেছেন, তাদের অনেকের কাছেও প্রস্তাবগুলো নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে এগুলো বোঝা যে কঠিন হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
দেশব্যাপী ব্যাপক প্রচারণা এবং আলোচনার মাধ্যমে প্রস্তাবগুলো সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা তৈরি করা যেত। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। সরকার বা গণভোটের প্রস্তাবকে সমর্থনকারী দলগুলো, কেউই জনগণকে প্রস্তাবগুলো ব্যাখ্যা করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সনদের সহজপাঠ্য কোনো সংস্করণও ব্যাপকভাবে জনগণের কাছে পৌঁছানো বা বিতরণ করা হয়নি।
এমনকি জামায়াতে ইসলামী ও তার মিত্ররা, যারা নভেম্বরে গণভোটের জন্য প্রচারণা চালাচ্ছে, তারাও সনদের কোনো প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা বা জনসচেতনতামূলক কোনো কর্মসূচি হাতে নেয়নি। তাহলে প্রশ্ন জাগে, তারা কীভাবে আশা করে যে ভোটাররা এই প্রস্তাবগুলো সম্পর্কে জেনে-বুঝে সিদ্ধান্ত নেবে এবং ভোট দেবে? একই প্রশ্ন সরকার ও অন্য দলগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তারা তাদের ভোটার বা নাগরিকদের কাছে প্রস্তাবগুলোর ভালো-মন্দ ব্যাখ্যা করার জন্য কী করছে?
উত্তর হলো, কিছুই না। জুলাই সনদ বা এর প্রস্তাবগুলো সম্পর্কে জনগণ সংবাদমাধ্যমে কিছুটা জেনেছে। সেটা মোটেও যথেষ্ট নয়। অন্য কারও পক্ষ থেকে কোনো প্রচেষ্টা নেই। ফলে শেষ পর্যন্ত যা হবে তা হলো, রাজনৈতিক দলগুলো মঞ্চের বক্তৃতা আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভোটারদের মাছে 'হ্যাঁ' বা 'না' ভোট দেওয়ার একটা হিড়িক তুলবে। কিন্তু এর পেছনের কারণ ব্যাখ্যা করবে না।
সব মিলিয়ে, গণভোটের নামে আমরা যা পেতে যাচ্ছি, তা হলো সংস্কারের ওপর একটি রাবার স্ট্যাম্প। আর সেই সিল বসাবেন দেশের ভোটাররা, যাদের ওপর এর প্রভাব সরাসরি। দুঃখজনকভাবে, এই প্রতারণায় রাজনৈতিক দল ও সরকার সবাই সমানভাবে জড়িত। এটি জুলাইয়ের চেতনার সঙ্গে এক ঘোরতর বিশ্বাসঘাতকতা।