বন্যা বিতর্ক ও উজান-ভাটির পানির ন্যায্য হিস্যা
জুলাই অভ্যুত্থানের পর এক অস্থির সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সবাই। আর এ সময়েই বন্যায় তলিয়ে গেল দেশের পূর্বাঞ্চল। উদ্ধার, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার চাইতেও কিছু মানুষ সরব হয়েছে বন্যা-বিতর্কে। তর্কের ফেনা না তুলে ছাত্ররা বন্যা-দুর্গত অঞ্চলে ছুটেছে। জনতা সহযোগিতা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার দুর্যোগ-তৎপরতা শুরু করেছে। জরুরি বৈঠক এবং এমনকি দ্বিরাষ্ট্রিক বন্যাব্যবস্থাপনা নিয়েও আলাপ হয়েছে। পাড়া মহল্লায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, ফেসবুকে নানাভাবে গণচাঁদা তোলা হচ্ছে। দুর্যোগে সাড়া দেয়া বাংলাদেশের এক শক্তিময় পরিচয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের কাঠামোগত অগ্রগতিও বিশ্বে আলোচিত। বন্যার আগে আমাদের পূর্বাভাস, প্রস্তুতি ও করণীয় স্পষ্ট ছিল না। এখন বন্যাকালীন তৎপরতাই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে রাখতে হবে। বন্যার পর একের পর এক ক্ষত ও যন্ত্রণাগুলো প্রকাশ হবে। পরবর্তী পুনর্বাসন ও ব্যবস্থাপনাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকতে হবে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সকল দুর্যোগ তৎপরতা হয়তো সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্কের টার্গেট বা কোর হিউম্যানিটারিয়ান স্ট্যান্ডার্ড (সিএইচএস) মেনে নাও হতে পারে।
প্রথমত বন্যার্ত মানুষ, গবাদি পশু সবাইকে নিরাপদ জায়গায় নিতে হবে। জানমাল রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। উদ্ধারের ক্ষেত্রে শিশু, প্রবীণ, প্রতিবন্ধী মানুষ, গর্ভবতী নারী, অসুস্থ, দুর্গত অঞ্চলের বাসিন্দা এবং সামাজিক প্রান্তিকতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি। আশ্রয়কেন্দ্র গুলোতে নারী-পুরুষের জন্য পৃথক টয়লেট, ব্রেস্টফিডিং রুম, কাপড় বদলানোর জায়গা নিশ্চিত করতে হবে। আশ্রয়কেন্দ্রে নিরাপদ সুপেয় পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকা দরকার। জরুরি ওষুধ ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা রাখতে হবে। জরুরি প্রয়োজনীয় ফোন নাম্বারগুলো আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে হবে। ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সাইক্লোন প্রিপেয়ার্ডনেস প্রোগ্রাম/সিপিপি), রোভার স্কাউট এবং বহু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আছে। স্থানীয়ভাবে স্বেচ্ছাসেবী ছাত্র-জনতা ও পেশাজীবী প্রতিনিধিদের নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি তৈরি করতে হবে। সবকিছু পরীক্ষা করে বিদ্যুৎ সরবরাহ দিতে হবে, তা না হল দুর্ঘটনা হতে পারে। শুকনো খাবারের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে রান্না কওে সহজপাচ্য নিরাপদ খাবার সরবরাহ করা যায়। ত্রাণ সহযোগিতার ভেতর লাইফ জ্যাকেট, পাওয়ার ব্যাংক, হ্যান্ড মাইক, ছাতা, টর্চ লাইট, বুট জুতা, কুড়াল, দা, দড়ি, ব্যাগ এসব রাখা যেতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, থানা, আদালত ও সরকারি অফিসের নথি, বইপত্র নিরাপদ স্থানে নিতে হবে। খাদ্যগুদাম, সংরক্ষণাগার, সারের গুদাম এবং বীজ সংরক্ষণাগার পানিমুক্ত করতে হবে দ্রুত। বর্ষণ থামলে, উজানের পানি প্রবাহ কমলে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মানুষ বাড়ি ও গ্রামে ফেরার পর তালিকা তৈরি করে ধারাবাহিকভাবে সহযোগিতা করা যেতে পারে। বসতবাড়ি, নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্যসেবা কিংবা কৃষি উৎপাদন ও ক্ষুদ্র ব্যবসা নানাভাবে তখন পরিস্থিতি অনুযায়ী সহযোগিতা লাগতে পারে। আউশ ও আমন মওসুমের প্রাক্কালে এবং বর্ষাকালীন সবজি মওসুমে এমন বন্যায় সব বীজতলা এবং সবজিবাগান, মৎস্য ও হাঁস-মুরগির খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পরে তীব্র বীজ সংকটে পড়বে বন্যা-দুর্গত এলাকাগুলো। এক্ষেত্রে বন্যামুক্ত এলাকা থেকে একই কৃষিপ্রতিবেশ চাষাবাদযোগ্য ধান ও শস্যফসলের বীজ সংগ্রহ করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বিনাশর্তে প্রণোদনা দিতে হবে। উঁচু বীজতলা, ভাসমান বীজতলা, স্যাক গার্ডেনিং, মাদা পদ্ধতি, মাচা পদ্ধতি, গাউতা পদ্ধতির চাষকে প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে। বন্যা-দুর্গত অঞ্চলে দুর্যোগ পূর্বাভাস, প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বাড়ানো জরুরি। ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যালয়গুলো দ্রুত চালু করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। তরুণ যুব প্রজন্মদের সৃজনশীল উদ্যোগগুলোকে সহযোগিতা করতে হবে। বন্যা-দুর্গত জেলাগুলোর অনেকেই প্রবাসী, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এলাকাভিত্তিক নতুন অর্থনৈতিক উদ্যোগ গড়ে তোলা যায়। ভাদ্রের ভরা কাটালে নদীর পানি নামতে দেরি হয়, এছাড়া পূর্ণিমা থাকায় প্রথম দিকে পানি খুব নামেনি। আশা করি দ্রুত পানি নামবে। সকলের ভেতরেই একটা ট্রমা তৈরি হয়েছে। ট্রমা সারাতে সাংস্কৃতিক তৎপরতা ও সাইকো-সোশাল কর্মসূচি জরুরি। কিন্তু কেন এমন বন্যা হয় এই প্রশ্ন কি আমরা করব না? নদী, পানি, আবহাওয়া, জলবায়ু, প্রকৃতি নিয়ে ছিনিমিন খেলার কর্তৃত্ববাদী রেজিমের বিরুদ্ধে কী আওয়াজ তুলব না? বন্যা মোকাবিলা করবার পাশাপাশি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনৈতিক পঠনপাঠনও জারি রাখতে হবে। ছাত্র-জনতাকে বন্যার রাজনীতি এবং আন্তরাষ্ট্রীয় পানি কূটনীতি কিংবা বৈশ্বিক জলবায়ু দেনদরবার বুঝতে হবে। নিরপেক্ষভাবে ইকোনমিক এবং নন-ইকোনমিক লস অ্যান্ড ড্যামেজকে নথিভুক্ত করতে হবে। এই সরকারের জন্য এটা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্যদলিল হতে পারে। আসন্ন আজারবাইজান জলবায়ু সম্মেলন কিংবা যৌথ নদী কমিশনে ছাত্র-জনতার তৈরি এমন দলিল রাষ্ট্রের অবস্থানকে জোরালো করবে। রাষ্ট্রের সংস্কারে এসবও ভূমিকা রাখবে।
রাজনৈতিক বন্যা নাকি প্রাকৃতিক বন্যা
একক সময়ে অতিবর্ষণ হয়েছে উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ে। একইসাথে জলবিদ্যুৎ, ব্যারেজ ও বাঁধের গেট খুলে নেমেছে ঢলের পানি। উজান থেকে নেমে আসা ঢল বাংলাদেশের সাতটি অভিন্ন নদীর ১৪টি পয়েন্টে বিপৎসীমার উপরে প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশেও গোমতীসহ ভেঙেছে বহু বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, খাগড়াছড়ি, হবিগঞ্জ, চাঁদপুর, কক্সবাজার, মুন্সীগঞ্জ, সিলেট, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া বন্যায় তলিয়ে গেছে। প্রায় ৫০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। যদিও প্রাণিসম্পদের ক্ষতির বিবরণ এখনো জানা যায়নি। বন্যা-দুর্গত জেলাগুলোতে প্রাকৃতিক বন, হাওর ও বন্যপ্রাণী আছে। বন্যপ্রাণীর ক্ষয়ক্ষতি এখনো জানা যায়নি। মানুষজন গরু-ছাগল নিয়ে ১৫৩৪টি আশ্রয়কেন্দ্র, বিদ্যালয়, মন্দির, মসজিদে গিয়ে উঠেছে। বিদ্যুৎ নেই, ইন্টারনেট নেই, সড়ক যোগাযোগ বন্ধ। সিলেট ও চট্টগ্রামের সঙ্গে ট্রেন চলাচল বন্ধ। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত বেশি ক্ষতি হয়েছে কুমিল্লা (৬৫১৩৫ হেক্টর) এবং মৌলভীবাজারের (৪৩,২৭১ হেক্টর) কৃষিজমির। ১২টি জেলার মোট ৬৮,২০৯ হেক্টর আউশ, ১৩,৮৬১৯ হেক্টর আমন মওসুমের ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১২,৯১০ হেক্টর রোপা আমনের বীজতলা, ৯৫১৯ হেক্টর শাক-সবজি, ৩৮৪ হেক্টর আখক্ষেত ও ১৯১ হেক্টর পানের বরজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিতর্ক উঠেছে এই বন্যা প্রাকৃতিক নাকি রাজনৈতিকভাবে সৃষ্ট? এধরনের প্রশ্নই ভুল। কারণ সব দুর্যোগই প্রাকৃতিক এবং একইসাথে রাজনৈতিক। আগস্ট বন্যার মূল কারণ অল্প সময়ে অতিবর্ষণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সিলেট, সুনামগঞ্জ, বান্দরবান এবং এমনকি দুবাইয়েও একইভাবে বন্যা হয়েছে। অতিবর্ষণে বন্যা বা অনাবৃষ্টিতে খরাকে জলবায়ুবিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হিসেবে দেখছেন। বিজ্ঞানীরা একইসাথে প্রমাণ করেছেন বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে জলবায়ু সংকট বাড়ছে আর এর জন্য ধনী দেশের জীবাশ্ম জ্বালানির্ভর নিওলিবারেল ভোগবাদী অর্থনীতি ও ব্যবস্থা দায়ী। আগস্ট বন্যার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ককে কোনোভাবেই অরাজনৈতিক ভাবার কারণ নেই। ভারত যদি বিদ্যুৎকেন্দ্র, বাঁধ-ব্যারেজের গেট নাও খুলে দেয় তাও এই বন্যা রাজনৈতিক। কারণ এর সঙ্গে বৈশ্বিক বিশাল জলবায়ু রাজনীতি জড়িয়ে আছে। পাশাপাশি ভারত-বাংলাদেশের অমীমাংসিত আন্তরাষ্ট্রীয় নদী ব্যবস্থাপনাও রাজনীতির অংশ। তাই আগস্ট বন্যাকে কোনোভাবেই অরাজনৈতিক হিসেবে পাঠের সুযোগ নেই। পাশাপাশি সাম্প্রতিক বন্যাগুলো আমাদের বার্তা দিয়েছে অতিবর্ষণ হোক আর বর্ষণ হোক ঢলের পানি প্রবাহ এবং ধরে রাখার মতো পানিপ্রবাহের পথ ও জলাধার এখন ক্রমশই কমেছে। নদী-জলাভূমি ভরাট এবং খাল-নালা না থাকার ফলে ঢলের পানি একটি নির্দিষ্ট প্রবাহে না গিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে জলাবদ্ধ অবস্থা তৈরি করছে।
পূর্বাভাস নাকি প্রস্তুতির সংকট?
দুর্যোগ পূর্বাভাস ও প্রস্তুতি নিয়ে বহুদিন ধরে প্রশ্ন করছি আমরা। পূর্বাভাস ও বিপৎসংকেত প্রদানে সদিচ্ছা, সক্রিয়তা এবং দায়িত্বশীলতার অভাব বহুবার সামনে এসেছে। খনার বচনের দেশে পূর্বাভাস পাঠে লোকায়ত আবওয়াবিদ্যার চর্চা এখন গ্রামীণ জনপদে খুব কম দেখা যায়। রাষ্ট্র কখনোই নিম্নবর্গের এই জ্ঞান-কারিগরিকে স্বীকৃতি দেয়নি। মেঘের ধরণ, বাতাসের গতি, তাপের তারতম্য, তারকামন্ডল বা প্রাণ-প্রজাতির নানাবিধ তৎপরতা বিশ্লেষণ করে দুর্যোগ-প্রস্তুতি নেওয়ার সমাজবাস্তবতা এখন বিরল। আবহাওয়া অধিদপ্তর প্রদত্ত পূর্বাভাসই এখন একমাত্র প্রবল বার্তা। আবার এই বার্তা দেশের সর্বত্র, সব শ্রেণি ও পেশাজীবী বর্গে একইভাবে অনুবাদ হয় না। যেমন '১০ নাম্বার বিপৎসংকেত', উপকূল-হাওর-পাহাড় কিংবা বরেন্দ্র অঞ্চলে একই বার্তা বহন করে না। আবার হাওর-জলাভূমি যখন নিদারুণভাবে পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যায় কিংবা বরেন্দ্র অঞ্চল তীব্র খরায় পুড়ে তখন আমরা কোনো আগাম বিপৎসংকেত বা কার্যকর পূর্বাভাস দেখি না। পূর্বাভাস ও বিপদবার্তাকে রাষ্ট্র 'প্রতিরক্ষা' হিসেবে বিবেচনা করে বিধায় আবহাওয়া অধিদপ্তর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। 'দুর্যোগ-বার্তা' রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। পূর্বাভাস ও প্রস্তুতির বেসামাল ঘাটতি ও কর্তৃত্ববাদী আচরণ কোনো রাষ্ট্র ও ব্যবস্থাকে চুরমার করে দিতে পারে। স্বাধীন বাংলাদেশ এক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে বহু রাজনৈতিক তৎপরতা যেমন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভিত গড়েছিল, একইভাবে ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী 'ভোলা ঘূর্ণিঝড়ও' তৎকালীন পরাধীন পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণকে দ্রোহী করে তুলেছিল। স্মরণকালের ভয়াবহ সেই দুর্যোগে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ নিহত হয়। আহত কয়েক লাখ। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটা বড় অংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। তৎকালীন কর্তৃত্ববাদী পাকিস্তান সরকার পূর্ব-পাকিস্তানের সঙ্গে চরমতম নিষ্ঠুর আচরণ করেছিল। কোনো পূর্বাভাস ও বিপদবার্তা জানায়নি। ত্রাণ বা কোনো জরুরি সেবা নিয়ে আগায়নি। চারদিকে লাশ আর লণ্ডভণ্ড জনপদ, প্রতিদিন অনাহারে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে বহু মানুষ। দুর্গত মানুষের প্রতি পাকিস্তান সরকারের নিষ্ঠুরতার জবাবে জেগে ওঠে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ। ২৪ নভেম্বর এক জনসভায় মাওলানা ভাসানী এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি করেন। তুমুল জনঘৃণা ও ক্ষোভ পাকিস্তানি কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে এক জনযুদ্ধের সূচনা করে।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় আমরা দুর্যোগ পূর্বাভাস ও বিপদবার্তাকে আমরা কীভাবে দেখি? মূলত ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর ঘূর্ণিঝড়ের আগামবার্তা নিয়মিত প্রচার শুরু হয়। ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলার পর এই পূর্বাভাস বার্তা ও দুর্যোগ-প্রস্তুতি আরও কাঠামোগত হতে শুরু করে। আগে রেডিও-টেলিভিশন-পত্রিকা এবং স্থানীয় পর্যায়ে মাইকিং বা সংকেত-পতাকা টানানোর মাধ্যমেই কেবল দুর্যোগ-বার্তা প্রচার হতো। বুলবুল, ফণী, আমফান, জাওয়াদ, রোয়ানু, ইয়াস, সিত্রাং বা মিধিলি ঘূর্ণিঝড়ে দেখা গেছে পূর্বাভাস প্রচারের ক্ষেত্রে অনলাইন নানা প্ল্যাটফর্ম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি এখন এই আগামবার্তা কেবলমাত্র আবহাওয়া অফিস থেকে প্রচারিত হচ্ছে না, বহু মুক্ত আবহাওয়াবিদ এবং প্রতিষ্ঠানও পূর্বাভাস বার্তা প্রচার করছেন। হয়তো মানুষের কাছে এখন পূর্বাভাস বার্তার উৎস অনেক, কিন্তু দুর্যোগ-প্রস্তুতির সংস্কৃতি দেশের সর্বত্র ভিন্ন ভিন্ন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আমার মাত্র বিশ বছরের অভিজ্ঞতা বলে তুলনামূলকভাবে দেশের উপকূল, তাও ১৯টি উপকূল জেলার সর্বত্র নয়, বিশেষভাবে সাতক্ষীরা-খুলনায় পূর্বাভাস এবং দুর্যোগ প্রস্তুতির জনসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। আবার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর জনপদে, বিশেষভাবে সুনামগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোণায় কেবলমাত্র বোরো মওসুমে ধান কাটার আগে প্রস্তুতি থাকে। উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী কিংবা গাইবান্ধার চরাঞ্চলে বন্যার আগাম প্রস্তুতির চর্চা আছে। আমরা দেখি হাওরের ক্ষেত্রে মার্চ-এপ্রিল এবং উপকূলে মে-জুন ও নভেম্বর এবং দেশের অন্যত্র বর্ষাকালে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশংকা থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক আগস্ট বন্যা এক নতুন অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে ফেনী, নোয়াখালী, খাগড়াছড়ি ও কুমিল্লার প্রবীণজনের স্মৃতিভাষ্য অনুযায়ী। তো এই বন্যার কী কোনো পূর্বাভাস ও আগামবার্তা ছিল না? ছিল। জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আগেও ছিল এবং পরেও ছিল। নিয়মিত কর্মসূচি হিসেবে আবহাওয়া অধিদপ্তর আগস্ট মাসের শুরুতে উত্তরাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদী বন্যার পূর্বাভাস দিয়েছিল। বলেছিল মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে অতিবৃষ্টির কারণে এ বন্যা হতে পারে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) 'বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র' জানিয়েছে, সাতটি অভিন্ন নদীর পানি বিপৎসীমার উপরে বইছে। এমনকি জুলাইয়ের শুরুতে পদত্যাগী সরকারপ্রধান আগস্ট বন্যার শঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন। এপ্রিলে অনুষ্ঠিত 'সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট আউটলুক ফোরামেও' সাম্প্রতিক বন্যা নিয়ে পূর্বাভাস দেওয়া হয়। এতো পূর্বাভাসের পরেও তাহলে আমাদের আগাম প্রস্তুতি জোরদার ছিল না কেন? সদিচ্ছা থাকলেও আগাম প্রস্তুতির ক্ষেত্রে সরকারের কার্যত কোনো সময়ই ছিল না, কারণ গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বহু কিছু ঘটছে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে। আবার একইসাথে অতিবর্ষণ এবং বন্যার সামগ্রিক আগাম বার্তা বাংলাদেশকে দিতেও দেরি করেছে ভারত। এটি পূর্ববর্তী অঙ্গীকার ও চুক্তির বরখেলাপ।
ট্রান্সবাউন্ডারি রিভার ডিক্টেটরশিপ
২০০৫ সালে হাওরের সমস্যাকে যখন ট্রান্সবাউন্ডারি সংকট হিসেবে চিহ্নিত করি তখন আমাদের অভিন্ন নদী প্রশ্নে কোনো আলোচনা ছিল না। মোটাদাগে মানুষের ভেতর ফারাক্কা বাঁধ বিরোধিতা ছিল, তিস্তা পানিবন্টন নিয়ে প্রত্যাশা ছিল আর কিছু মানুষ টিপাইমুখ বাঁধের বিরোধিতা করতেন। বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারতের অভিন্ন নদী অববাহিকার জনপদে ঘুরে ঘুরে ট্রান্সবাউন্ডারি সংকটগুলো বোঝার চেষ্টা করেছি। উজানে বৃহৎ বাঁধ, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, রাস্তা, সেতু, বনউজাড়, মনো কালচার বাগান কিংবা বহুজাতিক খননের ফলে ভাটির বাংলাদেশের সংকটগুলো নিয়ে নিয়মিত লিখেছি। আজ যারা আগস্ট বন্যাকে সামনে এনে 'ভারত-বিরোধিতায়' সরব হয়েছেন, এমন কাউকে দীর্ঘ বিশ বছর পাইনি।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ২০২৩ সালে প্রকাশিত 'বাংলাদেশের নদ-নদীর সংজ্ঞা ও সংখ্যা' বইতে ১০০৮টি নদ-নদীকে তালিকাভুক্ত করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) দেশের নদ-নদীগুলোকে ১৭টি হাইড্রলজিক্যাল রিজিয়নে ভাগ করেছে এবং ৫৭টি নদীকে অভিন্ন আন্তরাষ্ট্রিক সীমান্ত নদী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর ভেতর ৫৪টি নদীর উৎস ভারতে এবং তিনটি মিয়ানমারে। যদিও মহাদেও বা রংদীর মতো আরও বহু অভিন্ন নদী তালিকার বাইরে আছে এখনো। অভিন্ন নদীর প্রায় প্রতিটিতে ভারত বাঁধ, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বা কোনো স্থাপনা তৈরি করেছে কিংবা কোনো না কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে আন্তরাষ্ট্রিক নদীর প্রবাহ রুদ্ধ করেছে বা দখল ও দূষণ ঘটছে। এই ট্রান্সবাউন্ডারি ডিক্টেটরশিপ কেবল ভাটির বাংলাদেশ নয়, উজানের জনজীবন এবং প্রাণপ্রকৃতিকেও বিপন্ন করছে।
আন্তরাষ্ট্রিক নদীর উজানে বৃহৎ বাঁধ প্রকল্পের বিরুদ্ধে ভাটির বাংলাদেশ মূলত প্রথম প্রতিবাদী হয় ফারাক্কার বিরুদ্ধে। পরবর্তীতে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে দুদেশের রাজনৈতিক দরবার নানাভাবে উচ্চকিত। বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদীপ্রণালী মেঘনা-সুরমা-কুশিয়ারার উজানে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও নাগরিক প্রতিক্রিয়া কিছু সরব। কিন্তু এর বাইরে নদী ও প্রাণপ্রকৃতির সাথে জড়িত আর কোনো ট্রান্সবাউন্ডারি ডিক্টেটরশিপের বিরুদ্ধে নাগরিক আওয়াজ সরব নয়। ভারত সীমান্তে অপরিকল্পিত রাস্তা নির্মাণ, বন উজাড় এবং পাথর উত্তোলনের ফলে প্রচুর পাহাড় ধ্বসের ঘটনা বাড়ছে এবং ২০০৮ সালে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে বিশাল পাহাড় ধসে সীমান্তের বহু গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০১২ সালে মেঘালয়ে উদ্বোধন হয় 'মন্তডু-লেসকা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প', যে নদীর ভাটিতে বাংলাদেশের সিলেটের সারী নদী। এই প্রকল্পের প্রভাব পড়ছে দেশের অন্যতম নাজুক সোয়াম্প ফরেস্ট রাতারগুলে। একই বছর মেঘালয়ের উমইয়্যু নদীতে তৈরি হয় 'মন্তডু-লেসকা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প', যার প্রভাব পড়ছে সিলেটের ধলা নদীতে। মেঘালয়ে বাণিজ্যিক খনন, সিমেন্ট কারখানা, উন্মুক্ত কয়লা খনির কারণে বাংলাদেশের টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রাণ-প্রকৃতি বিপন্ন। সিমেন্ট কারখানার দূষণে আন্তরাষ্ট্রিক নদী থেকে বিলুপ্ত হয়েছে লোচ মাছ। ২০২২ সালে ত্রিপুরার ধলাই নদীর ওপর গার্ডাও সেতু নির্মিত হয় এবং বাংলাদেশে এই নদীর প্রবাহ শীর্ণ হয়ে যায়, যার প্রভাব পড়ে স্থানীয় কৃষিকাজে। ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী সেগুন বাগানে আগাছানাশক হার্বিসাইড ব্যবহার করা হয়, যা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে বাংলাদেশের হবিগঞ্জের কোরাঙ্গী ও খোয়াই নদীকে দূষিত করে। সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, নেত্রকোণা, শেরপুর, ময়মনসিংহ সীমান্তে উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে আসা পাহাড়ি বালির কারণে সীমান্তবর্তী কৃষিজমি বিনষ্ট হচ্ছে এবং কৃষিকাজ করতে না পেওে জীবিকার প্রয়োজনে বহু মানুষের ইন্টারনাল মাইগ্রেশনন বাড়ছে।
কিন্তু অভিন্ন নদী ব্যবস্থাপনা প্রশ্নে এই ডিক্টেটরশিপ চুক্তি ও বৈশ্বিক অঙ্গীকার বিরোধী। ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন দেশের সকল অভিন্ন আন্তরাষ্ট্রিক নদী বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তিতে ভারত ও বাংলাদেশ অভিন্ন নদীর সাম্য ও স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনায় দায়বদ্ধ। জাতিসংঘের 'কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভার্সিটি সনদ (১৯৯২)' অনুযায়ী রাষ্ট্র এমন কিছু করতে পারবে না, যা, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বায়োডাইভার্সিটি বিপন্ন হয়। আগস্ট বন্যার ক্ষেত্রে দেখা গেল মুহুরী, গোমতী, ফেনী নদীতে হুরমুড়িয়ে বাড়ছে পানি। ১৫৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ফেনী নদীর উৎসমুখ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে। নদীটি ফেনী, চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়ির ভেতর দিয়ে প্রবাহিত। ফেনীর ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়ার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ৬৮ কিলোমিটার দীর্ঘ মুহুরী নদীর উৎস ও পতনমুখ উল্লেখ করেনি নদী রক্ষা কমিশন। গোমতী নদীও ত্রিপুরা থেকে উৎপন্ন হয়ে কুমিল্লা দিয়ে প্রবেশ করে মেঘনায় মিলেছে। মুহুরী জলবিদ্যুৎ প্রকল্প কিংবা গোমতীর ডম্বুর বাঁধের দরজা খুলে দেওয়ার ফলে উজান থেকে নেমেছে ঢলের পানি আর সবকিছু তলিয়ে গেছে খুব দ্রুত।
২০০৬ সালে যৌথ নদী কমিশনের ৩৬ তম বৈঠকে ফেনী নদীর পানি ব্যবস্থাপনা, অভিন্ন নদীর তীর সংরক্ষণ এবং মুহুরী নদীর ভাঙন প্রতিরোধ বিষয়ে আলোচনা করে। বাংলাদেশের ফেনী নদী থেকে পানি নিয়ে ভারতের ত্রিপুরার সাব্রুম শহরে খাবার পানি সরবরাহের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ২০১৯ সালে। ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত কমিশনের ৩৮তম বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ভারত সঠিক সময়ে বন্যার তথ্য বাংলাদেশকে জানাবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বন্যার তথ্য সময়মত জানাতে ব্যর্থ হয়েছে, যে কারণে জনগণ জানমাল রক্ষায় জনগণ প্রস্তুতির তেমন সময় পায়নি।
ফ্লাড-ট্রমা এবং ওয়াটার জাস্টিস
বাংলাদেশের বহু মানুষের মনে ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যা এক দুঃসহ স্মৃতি বা ট্রমা হয়ে আছে। কাপ্তাই বাঁধ, ভোলা ঘূর্ণিঝড়, সিডর ও আইলা ঘূর্ণিঝড় এবং হাওরাঞ্চলের ফ্ল্যাশ ফ্লাড ট্রমা তৈরি করেছে। এইসব দুর্যোগের সাক্ষীরা যেকোনো ঝড়-বন্যাতেই একটা অজানা ভয় পান। মার্চ-এপ্রিলের আগে হাওরাঞ্চলে ফ্লাশ ফ্লাডের খুব ভয় কাজ করে। শিলাবৃষ্টি ও ঢলের হাত থেকে বোরো মওসুমের ধান বাঁচানোর জন্য অনেকে ব্লাকম্যাজিক 'হিরাল প্রথা' বিশ্বাস করে। তিস্তা ও পদ্মা অববাহিকার মানুষ কৃষি মওসুমে পানি বঞ্চিত হয়ে সর্বদাই আশঙ্কায় থাকেন। আন্তরাষ্ট্রিক নদী নিয়ে কোনো রাষ্ট্রের একতরফা কর্তৃত্ববাদী আচরণ অন্য রাষ্ট্রের জনগণের ভেতর নিদারুণভাবে সামাজিক ফ্লাড-ট্রমা জারি রাখে। একইসাথে অভিন্ন নদী থেকে উজানে নানাভাবে পানি প্রত্যাহার ও নিয়ন্ত্রণ ভাটি জনপদে পানি-কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে জন-অসন্তোষকেও প্রতিষ্ঠা করে। একইসঙ্গে রিভার-ডেমক্রেসি এবং ওয়াটার জাস্টিসের জন্য মানুষের দ্রোহের ন্যারেটিভ ক্রমাগতভাবে জোরালো হচ্ছে।
২০১৯ সালে হাইকোর্ট নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে রায় দেয়। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কি ভারতের নিওলিবারেল সিস্টেম নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ধারণ করে না। উভয় রাষ্ট্রই নদীকে কেটে টুকরো টুকরো করে, জোর করে নিয়ন্ত্রণ করে, লুট ও ধর্ষণ করে। ফারাক্কা বা টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে লংমার্চ হলেও রাষ্ট্র কিন্তু বাঁধ-বিরোধী নয়। রাষ্ট্র কাপ্তাই বাঁধ সমর্থন করে, যা এক লাখ মানুষকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করেছে, বসতবাড়ি কৃষিজমি সব ডুবিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিটি অভিন্ন নদীর কেবল উজান নয়; ভাটির বাংলাদেশেও পদে পদে বাঁধা ও যন্ত্রণা। বাংলাদেশও ব্যারেজ, বাঁধ, দখল, দূষণের মাধ্যমে নদীকে বন্দী করে রেখেছে। আগস্ট বন্যার ক্ষেত্রে জলাধারে জমা অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেওয়া নিয়ে যে তর্ক উঠেছে, এই যন্ত্রণা দেশেও ঘটে ছোট পরিসরে। ঠাকুরগাঁওয়ে শুক নদী, নেত্রকোণায় রংদী কিংবা সুনামগঞ্জে খাসিয়ামারা নদীতে নির্মিত রাবার ড্যামগুলো শুষ্ক মওসুমে পানি আটকে বা বর্ষাতে ছেড়ে দিয়ে ড্যামের উজান ও ভাটির গ্রামবাসীর সঙ্গে অন্যায্য আচরণ করে। ১৯৭৪ সালের একর্ডের মাধ্যমে মুহুরী নদীর দ্বিরাষ্ট্রিক ডিমার্কেশন ঠিক করা হয়। ১৯৭৫ সালে ত্রিপুরার বিলোনিয়া শহরকে ভাঙন থেকে রক্ষা করার জন্য মুহুরী নদীতে স্পার বসায় ভারত। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ 'মুহুরী সেচ প্রকল্প' তৈরি করে। এই সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে মুহুরীর প্রাকৃতিক প্রবাহকে আটকে জলাধার তৈরি করা হয় এবং এটি একইসাথে বাণিজ্যিক মৎস্যচাষকেও উৎসাহিত করে। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ফেনী নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ করে। ২০২১ সালে ফেনী নদীর উপর ভারতের নির্মিত মৈত্রী সেতুর উদ্বোধন হয়। ভারত গোমতী নদীতে ডম্বুর বাঁধ তৈরি করে। বালু বাণিজ্যের নামে বাংলাদেশেও গোমতী ছিন্ন ভিন্ন, গোমতি বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ এবং এবারের বন্যায় এই বাঁধও ভেঙেছে। এসব ঘটনা নদী নিয়ে আমাদের সংহারী উন্নয়ন-দর্শনকে হাজির করে। বাংলাদেশ ও ভারত উভয় রাষ্ট্র একটি প্রবাহমান নদীতে যেকোনো ধরণের বাঁধ বা স্থাপনা নির্মাণ করে কিংবা একটি নদী থেকে কে কত কিউসেক পানি পাবে এ নিয়ে নদীকে টুকরা টুকরা ভাগ করার আলোচনা করে। উভয় রাষ্ট্র একটি মুক্ত নদীর স্বাধীন বাঁধাহীন প্রবাহের পক্ষে এখনো দাঁড়ায়নি। আর যৌথ নদী ব্যবস্থাপনায় পানির ন্যায়বিচার হিসেবে এই উন্নয়ন-দর্শনকেই প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। আগস্ট বন্যাকে সামনে রেখে ছাত্র-জনতার দাবি হোক অভিন্ন নদীর উজান ও ভাটি থেকে সব বাঁধ ও স্থাপনা সরাতে হবে। পানির ধর্ম উপর থেকে নিচে গড়িয়ে পড়া, উজান থেকে ভাটিতে পানি এভাবেই বইবে, বন্ধনহীন এবং কর্তৃত্বহীন।
পাভেল পার্থ: গবেষক এবং লেখক, বাস্তুতন্ত্র এবং বৈচিত্র্য। ইমেইল: animistbangla@gmail.com