মুক্তিযুদ্ধের ভুলে যাওয়া এক বিদেশি বন্ধুর খোঁজে

আহমাদ ইশতিয়াক
আহমাদ ইশতিয়াক
16 December 2025, 05:14 AM
UPDATED 16 December 2025, 12:42 PM

১ অক্টোবর ১৯৭১, ঘড়িতে রাত আনুমানিক আটটা। বেলজিয়ামের ব্রাসেলসের লা সোয়েরে পত্রিকার সাংবাদিক ওয়াল্টার শুল্ডেনের কাছে অচেনা নাম্বার থেকে একটি ফোন এলো। ওয়াল্টার টেলিফোন রিসিভার তুলতেই ওপাশ থেকে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি বললেন, 'আমি থিল ফন লিমবার্গ। গত কয়েকদিন আগে ব্রাসেলসের মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টস থেকে জোহানস্‌ ভারমিরের দ্য লাভ লেটার আর্টটি আমিই চুরি করেছি।'

'যদি মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ এই আর্টটি নিখুঁত অবস্থায় ফিরে পেতে চায় তবে তাদের ২০০ মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক (তৎকালীন সময়ে চার মিলিয়ন ডলার) মুক্তিপণ দিতে হবে। তবে শর্ত হলো সেই মুক্তিপণ দিতে হবে কারিতাসে (আন্তর্জাতিক রোমান ক্যাথলিক সাহায্য সংস্থা)। এবং এই অর্থ খরচ হবে পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধে আক্রান্ত অসহায় শরণার্থীদের জন্য। আমি কোনো পেশাদার অপরাধী নই। কেবলই একজন শিল্প পিপাসু।'

the_love_letter_by_johannes_vermeer.png
জোহানস্‌ ভারমিরের দ্য লাভ লেটার আর্ট। ছবি: সংগৃহীত

বিখ্যাত ডাচ চিত্রশিল্পী জোহানস্‌ ভারমিরের সপ্তদশ শতাব্দীতে আঁকা একটি বিখ্যাত চিত্রকর্ম 'দ্য লাভ লেটার'। নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামের রাইখস মিউজিয়ামে সংরক্ষিত এই চিত্রকর্মটির তৎকালীন বাজারমূল্য ছিল প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক। 

বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টসে আয়োজন করা হয় 'র‌্যঁবা অ্যান্ড হিজ টাইম' একটি চিত্রকলা প্রদর্শনীর। সেই প্রদর্শনীতে প্রদর্শনের জন্য রাইখস মিউজিয়াম থেকে আনা হয়েছিল 'দ্য লাভ লেটার'। প্রদর্শনীতে 'দ্যা লাভ লেটার' ছাড়াও স্থান পেয়েছিল ফ্রান্স, ডেনমার্ক, জার্মানির বিভিন্ন মিউজিয়াম থেকে আনা ষোলো ও সতের শতকের বেশ কয়েকজন শিল্পীর বেশ কয়েকটি বিখ্যাত চিত্রকর্ম।

'দ্য লাভ লেটার' যেভাবে সাফাই হলো

২৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় প্রদর্শনীটির উদ্বোধন করেন বেলজিয়ামের রাজকন্যা প্রিন্সেস পামেলা। একপর্যায়ে প্রদর্শনী দেখার অজুহাতে জাদুঘরে ঢোকেন মারিও রয়ম্যান্স। আদতে মারিও শিল্প পিপাসু হওয়ায় জানতেন 'দ্য লাভ লেটারে'র শিল্পমূল্য সম্পর্কে। 

brussels_museum_of_fine_arts.jpg

জাদুঘরে ঢোকার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী মুহূর্তে প্রথমে কিছুক্ষণ চারপাশে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন মারিও। দেখলেন জাদুঘরের অভ্যন্তরে এবং বহির্ভাগে পাহারা দিচ্ছে চারজন নিরস্ত্র পুলিশ। একটি কক্ষের দেয়ালে ঝুলছে জোহানস্‌ ভারমিরের বিখ্যাত চিত্রকর্মটি। একপর্যায়ে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেরাজে লুকিয়ে পড়লেন মারিও।

এর কারণ ছিল প্রায় ১৭ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য ও ১৫ ইঞ্চি প্রস্তের চিত্রকর্মটি আড়াল করে নিয়ে বের হওয়া একপ্রকার অসম্ভবই বলা চলে। তাই মারিও জাদুঘর বন্ধ হওয়ার প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। একপর্যায়ে জাদুঘর বন্ধ হলো। রাত গভীর হলে দেরাজ থেকে বেরিয়ে এলেন মারিও। পকেট থেকে ছুরি বের করে সন্তর্পণে দেয়ালে টাঙানো চিত্রকর্মটির চারপাশের ফ্রেম কাটলেন। অতঃপর মূল কাগজটিকে মুড়িয়ে নিয়ে ভাঁজ করে পকেটে পুরলেন তিনি। ভেন্টিলেটর দিয়ে বেরিয়ে কেউ কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই পালিয়ে গেলেন মারিও রয়ম্যান্স। 

চিত্রকর্মটি নিয়ে টঙ্গারেনের বাড়িতে ফিরে মহা মুশকিলে পড়লেন মারিও। কারণ এটি তিনি কোথায় রাখবেন সেই ভাবনা তার মাথায় চেপে বসেছে। উপায় না দেখে বাড়ির পাশের জঙ্গলে চিত্রকর্মটি মাটিচাপা দিলেন তিনি। কিন্তু রাতে বৃষ্টি হলে পরদিন ভোরেই আবার  তা বাড়ি নিয়ে এলেন। 

the_love_letter_was_recovered_from_the_sittweete_hotel.jpg
হিউসডেন-জোল্ডারের সিতেওয়েতে নামের একটি হোটেল

এরপর চাকরির খোঁজ করতে লাগলেন মারিও। হিউসডেন-জোল্ডারের সিতেওয়েতে নামের একটি হোটেলে ওয়েটার হিসেবে চাকরিও পেয়ে গেলেন। হোটেল থেকে তাকে রাতে থাকার জন্য যে কক্ষটি দেওয়া হয়েছিলো সেই কক্ষের বিছানার তোশকের নিচে 'দ্য লাভ লেটার'র আশ্রয় জুটল।

যে কারণে শিল্পকর্ম চুরির জন্য উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন মারিও রয়ম্যান্স 

আগস্ট মাসের কোনো এক সকালে বাড়িতে শুয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে টিভি দেখছিলেন ২১ বছর বয়সী ফ্লেমিশ তরুণ মারিও পিয়েরে রয়ম্যান্স। হঠাৎই তার চোখ আটকে গেল টিভি পর্দায়। সেখানে দেখানো হচ্ছিল পূর্ব পাকিস্তানে কথিত বিচ্ছিন্নতাবাদী দমনের নামে কি নারকীয় নিকৃষ্টতম গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। 

মারিও টিভি পর্দায় দেখতে পেলেন প্রাণ বাঁচাতে অসহায় নিরীহ মানুষ ছুটছে সীমান্তের পানে। উদ্দেশ্য শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ। টিভি পর্দায় দেখা গেল মৃত মানুষের পচন ধরা লাশ খুবলে ছিবড়ে খাচ্ছে ক্ষুধার্ত কুকুর, শকুন।

সাড়ে ৭ হাজার কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে বসবাস করা সত্ত্বেও ফ্লেমিশ তরুণ মারিওর মন কেঁদে উঠল অসহায় মানুষের জন্য। তার কি তবে কিছুই করার নেই! এরপরই মারিও সিদ্ধান্ত নিলেন কিছু একটি করার। যার মধ্য দিয়ে যেমন সাহায্য পাবে সেই অঞ্চলটির মানুষ, ঠিক তেমনি বিশ্বজুড়ে সেই অঞ্চলটির স্বাধীনতার পক্ষেও সৃষ্টি হবে জনমত, যা শেষপর্যন্ত মারিওকে ধাবিত করেছিলো শিল্পকর্ম চুরির দিকে।

যেভাবে ধরা পড়েছিলেন মারিও 

ঘটনার পরদিনই মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টস কর্তৃপক্ষ জানতে পারে, জাদুঘর থেকে 'দ্য লাভ লেটার' খোয়া গেছে। তৎক্ষণাৎ গোয়েন্দারা ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করে জানতে জানায় এটি নিশ্চিতভাবেই সংঘবদ্ধ পেশাদার চোরদের কাণ্ড। বেলজিয়াম সরকারের পক্ষ থেকে শিল্পকর্মটির সন্ধান মারফতে মোটা অঙ্কের পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। একইসঙ্গে শুরু হয় চিরুনি অভিযানও। 

paper_cutting.png
বিভিন্ন পত্রিকায় শিল্পকর্ম চুরির খবর। ছবি: সংগৃহীত

১ অক্টোবর রাতে মারিওর সঙ্গে কথোপকথনের সময় সাংবাদিক ওয়াল্টার শুল্ডেন যতবারই মারিওর নাম এবং পরিচয় সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলেন ততবারই মারিও নিজের নাম 'থিল ফন লিনবার্গ' বলেই পরিচয় দিচ্ছিলেন। বলে রাখা ভালো, ফ্লেমিশ ভাষার লোকগাঁথার বিখ্যাত চরিত্র 'থিল ফন লিনবার্গ'। ফ্লেমিশ লোকগাথায় চরিত্রটি নীতিবান চরিত্র হিসেবেই বিবেচিত হয়। ওয়াল্টারকে টেলিফোনে মারিও এও জানান যে যদি শরণার্থীদের সহায়তার জন্য ২০০ মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক মুক্তিপণ না দেয়া হয়, তাহলে এটি ছাড়াও ব্রাসেলসের মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টসের বাকি ৩৯টি চিত্রকর্মের সবকটিই তিনি চুরি করবেন। 

ওয়াল্টার তখন মারিওকে বললেন চিত্রকর্মটি যে তার কাছে আছে তার প্রমাণ কী! যদি তিনি প্রমাণস্বরূপ তা গোপনে ওয়াল্টারকে দেখান, তবেই তিনি তা বিশ্বাস করবেন। মারিও তখন ওয়াল্টারকে প্রস্তাব দিলেন পরদিন ভোরের আগে নির্দিষ্ট স্থানে থাকার জন্য। সেই মোতাবেক পরদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই লিমবার্গের জঙ্গলের নির্দিষ্ট স্থানে গাড়ি নিয়ে আসেন ওয়াল্টার। মুখোশ পরে আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন মারিও। এরপর ওয়াল্টারের চোখ বেঁধে একটি চার্চের সামনে নিয়ে মারিও চিত্রকর্মটি বের করে আনেন। এরপর গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে চিত্রকর্মটির বেশ কয়েকটি ছবি তোলেন ওয়াল্টার। 

পরদিন ৩ অক্টোবর লা সোয়েরে পত্রিকায় চিত্রকর্মের ছবি ও মারিওর দাবি সমেত একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে গোটা বেলজিয়াম জুড়েই আলোড়ন সৃষ্টি হয়। 

লা সোয়েরে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদটি নজর এড়ায়নি আমস্টারডামের রাইখস মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষেরও। মারিও রয়ম্যান্সের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে তারা বলে, সত্যিই যদি এটি মূল চিত্রকর্ম হয়ে থাকে তবে তা তারা বিশেষজ্ঞ দ্বারা যাচাই করতে যায়। যদি আসল প্রমাণিত হয় তবেই তারা মুক্তিপণ দেবে। এক্ষেত্রে পুলিশি ঝামেলার বিষয়টি নিয়েও মারিওকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলে রাইখস মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তাদের এই টোপ গেলেননি মারিও। 

court.png
আদালতে মারিও রয়ম্যান্স। ছবি: সংগৃহীত

এদিকে মারিও 'হট ফেক' নামের আরেকটি পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেন, যদি ৬ অক্টোবরের মধ্যে মুক্তিপণের ২০০ মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক পরিশোধ না করা হয় তবে পেইন্টিংটি বিক্রি করে দেওয়া হবে। ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকজন ক্রেতা তার সঙ্গে যোগাযোগও করেছেন। মারিও একই সঙ্গে এ শর্তও জুড়ে দেন, মুক্তিপণ পরিশোধের বিষয়টি কোন টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করতে হবে। এবং চিত্রকর্মটির বীমার দায়িত্বে থাকা বিমা কোম্পানিকেও চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরের সময় উপস্থিত থাকতে হবে। পুরো বিষয়টি শুনে ডাচ যাদুঘর কর্তৃপক্ষ দেখে, এই স্বল্প সময়ে ২০০ মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক জোগাড় করা রীতিমতো অসম্ভব। যার ফলে তারা মুক্তিপণের অর্থ দিতে অস্বীকৃতি জানায়।

মুক্তিপণের অর্থ না পাওয়া ৬ অক্টোবর সকালে ভিআরটি রেডিওতে জনপ্রিয় রেডিও শো 'টু বেড অর নট টু বেড' চলার সময় মারিওকে টেলিফোনের মাধ্যমে কিছু বলার সুযোগ দেওয়া হলে মারিও তার পুরো পরিকল্পনার কথা খুলে বলেন। একইসঙ্গে তিনি তুলে ধরেন পূর্ব পাকিস্তানে কতোটা পৈশাচিক গণহত্যা চালাচ্ছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। তার সামগ্রিক বয়ানে মুগ্ধ হন অনুষ্ঠানটির শ্রোতা ও উপস্থাপকেরা।

মারিও কলটি করেছিলেন হ্যাসেল্টের পেট্রোলপাম্প থেকে। পেট্রোল পাম্পের মালিকের স্ত্রী মারিওকে চিনতে পেরে পুরস্কারের লোভে পুলিশে খবর দেন। তখন সম্ভাব্য পরিণতির কথা ভেবে মোটরসাইকেলে করে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়েও ব্যর্থ হন। পুলিশের ধাওয়ার মুখে তিনি মোটরসাইকেল থেকে লাফ দিয়ে আশ্রয় নেন পার্শ্ববর্তী হেরকেনরোথ আবদে খামারে। শেষপর্যন্ত খামারের গোবরের স্তূপ থেকে তাকে আটক করে পুলিশ। অতঃপর পুলিশ মারিওকে নিয়ে অভিযান চালায় হিউসডেন-জোল্ডারের সিতেওয়েতে হোটেলে। হোটেলে মারিওর কক্ষের তোশকের তলা থেকে উদ্ধার করা হয় জোহানস্‌ ভারমিরের 'দ্য লাভ লেটার'।

সে বছরের ২০ ডিসেম্বর মারিও রয়ম্যান্সকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বিচারিক রায়ে ব্রাসেলসের আদালত মারিওকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেন। 

মারিওর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে এবং তার দাবিকৃত মুক্তিপণের অর্থ পূর্ব পাকিস্তানের অসহায় শরণার্থীদের জন্য ব্যয়ের দাবিতে রাজপথে নেমে আসে সাধারণ জনতা। নেওয়া হয় গণস্বাক্ষরের মতো কর্মসূচিও। মারিওর পক্ষে দাঁড়ান মানবাধিকার কর্মী থেকে সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিকেরা। শেষ পর্যন্ত গণমানুষের দাবি ও তার অপরাধ বিবেচনায় ১৯৭২ সালের ১২ জুলাই ছয় মাস কারাভোগের পর কারাগার থেকে মুক্তি পান মারিও রয়ম্যান্স। তবে আটক হওয়ার পর থেকেই মারিওর সেই প্রচেষ্টা ইউরোপে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গঠনে ভীষণ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল, যা হানাদারদের দ্বারা সংঘটিত চলমান গণহত্যা সম্পর্কেও ইউরোপজুড়ে বিপুল আলোচনার সৃষ্টি করেছিল। 

mario_roymans_rests_in_eternal_sleep_in_this_small_cemetery_in_nerem.png
মারিও রয়ম্যান্সের সমাধি। ছবি: সংগৃহীত

মারিও রয়ম্যান্সের পরবর্তী জীবন 

কারাগারে থাকা অবস্থাতেই প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন মারিও রয়ম্যান্স। একপর্যায়ে তিনি কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন। কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর স্থানীয় এক ফ্লেমিশ তরুণীকে বিয়ে করেছিলেন মারিও। তাদের কোলজুড়ে এসেছিলো ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানও। কিন্তু একপর্যায়ে মারিওর মানসিক সমস্যা পুরোপুরি জেঁকে বসে। এ সময় তিনি রাস্তায় দিন কাটাতেন, রাতে ঘুমাতেন রাস্তার পাশে পার্ক করা গাড়িতে। 

১৯৭৮ সালে বড়দিনের পরের দিন বক্সিং ডের সকালে লিয়েজের রাস্তার পাশে পার্ক করা একটি গাড়িতে মুমূর্ষু অবস্থায় পাওয়া যায় মারিওকে। উদ্ধারের পর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। কিন্তু ততোক্ষণে মস্তিষ্কে অত্যধিক রক্তক্ষরণের কারণে তার শারীরিক পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়ে গেছে। শেষপর্যন্ত টানা ১০ দিনের লড়াই শেষে ১৯৭৯ সালের ৫ জানুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের নিঃস্বার্থ বন্ধু মারিও পিয়েরে রয়ম্যান্স। পরে মারিওকে তার জন্মস্থান বেলজিয়ামের টঙ্গারেনের নেরেমের ছোট্ট একটি কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

মারিও রয়ম্যান্সের শিল্পকর্ম চুরি সম্পর্কে এই প্রতিবেদক প্রথম জানতে পারেন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে। জোহানস্‌ ভারমিরের বিশ্বখ্যাত শিল্পকর্ম 'দ্য লাভ লেটার' চুরির বিষয়টি কেবল বেলজিয়ামই নয়, তৎকালীন সময়ে গোটা ইউরোপজুড়েই ভীষণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। 'লা সোয়েরে' পত্রিকা ছাড়াও বেলজিয়ামের বহুল প্রকাশিত দ্য স্ট্যান্ডার্ড, লা লিব্রে বেলশিক, হেট নিউজব্লাড, 'উসডাইনফিস', 'হেট বিলাং ফান লিমবুর্গ পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়েছিল শিল্প চুরির বিষয়টি। আলোড়ন সৃষ্টি করা সেই ঘটনার দুদিন পর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল প্যারিস থেকে প্রকাশিত 'লে ফিগারো' ও বার্সেলোনা থেকে প্রকাশিত 'লা ভ্যানগার্ডিয়া' পত্রিকাতেও। অন্যদিকে মারিওর পরবর্তী জীবনের খোঁজ পাওয়া যায় ২০২১ সালে 'হেট বিলাং ফান লিমবুর্গ' এ মারিওর বীরত্বগাথা নিয়ে প্রকাশিত ফিচারে।

মারিও সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা যায় 'দ্যা মর্গেন' পত্রিকার সাংবাদিক সু সমার্সের লেখা বই 'MARIO: HET VERHAAL VAN TIJL VAN LIMBURG' মারফতে। বইটি ফ্লেমিশ ভাষায় প্রকাশিত হওয়ায় বেলজিয়াম প্রবাসী বাংলাদেশি সৈয়দ মুসাদ্দেকুর রহমান এই প্রতিবেদককে সহযোগিতা করেন। 

মারিও রয়ম্যান্সের ঠিকানা ও পরিবারের সদস্যদের খোঁজে 

মুক্তিযুদ্ধের ৫২ বছর পরে মারিও রয়ম্যান্সের শেষ ঠিকানা ও তার পরিবারের খোঁজ পেতে অনুসন্ধান চালাই আমরা। এই প্রসঙ্গে প্রথমে বেশ কয়েকজন বেলজিয়াম প্রবাসী বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলেও তথ্য অনুসন্ধানে ব্যর্থ হন এই প্রতিবেদক। কারণ তারা কেউই মারিও সম্পর্কে কিছুই জানেন না। 

অনুসন্ধানের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই একপর্যায়ে বেলজিয়াম প্রবাসী এক বাংলাদেশির মারফতে এই প্রতিবেদকের পরিচয় হয় প্রবাসী বাংলাদেশি হুমায়ূন মাকসুদ হিমুর সঙ্গে। হিমু বর্তমানে থাকেন বেলজিয়ামের হ্যাসেল্ট শহরে।

the_book_mario_about_mario_roymans_written_by_journalist_su_summers.jpg
‘দ্যা মর্গেন’ পত্রিকার সাংবাদিক সু সমার্সের লেখা বই

হিমুর মাধ্যমেই আমরা খুঁজে পাই মারিও রয়ম্যান্সের ভুবন। পাওয়া যায় তার শেষ ঠিকানা ও তার একমাত্র কন্যার খোঁজ। হুমায়ূন মাকসুদ হিমুর সঙ্গে কথা বলতেই বেরিয়ে আসে মারিও রয়ম্যান্সের ঠিকানা ও পরিবারের সন্ধান। 

২০০৮ সালে মারিও রয়ম্যান্স সম্পর্কে সর্বপ্রথম জানতে পারেন হুমায়ূন মাকসুদ হিমু। সেসময় মারিওর পরিবারের খোঁজ পাওয়ার জন্য তিনি ফেডারেল পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তবে মারিও রয়ম্যান্স বেলজিয়ামে অপরাধী হওয়ায় শুরুতে তারা তার ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল ফেডারেল পুলিশ। কিন্তু দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী হওয়ায় তার সম্পর্কে কোনপ্রকার তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানায় পুলিশ।

হিমু এই প্রতিবেদককে বলেন, 'ওরা যখন আমাকে তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানাল, তখন আমি ফেডারেল পুলিশ অধিদপ্তরে থাকা দায়িত্বপ্রাপ্তদের বোঝালাম যে মারিও বেলজিয়ামে অপরাধী কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তিনি অসামান্য এক চরিত্র। শেষমেশ তারা আমাকে মারিওর মেয়ের বাড়ির ঠিকানা দিতে সম্মত হয়।'

এরপর মারিওর একমাত্র সন্তানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন হিমু। কিন্তু সেখানেও তাকে পড়তে হয়েছিলো বিড়ম্বনায়। এই বিষয়ে হিমু বলেন, 'মারিওর মেয়ের নাম ইসাবেলা। আমি যখন ইসাবেলার বাড়িতে যাই, তখন ইসাবেলা আমার আসার উদ্দেশ্য জানতে পেরে কোনো কথা বলতে অস্বীকৃতি জানালেন। কারণ তার বাবার করুণ পরিণতির জন্য তিনি বাংলাদেশকে দায়ী করতেন। এছাড়া ভাষাগত সীমাবদ্ধতা তো ছিলই। তিনি ফ্লেমিশ ছাড়া কোনো ভাষাই বোঝেন না! বেশ কয়েক বছর চেষ্টা করেও আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। তিনি কিছুতেই আমার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিলেন না। বেশ কয়েক বছর প্রচেষ্টার পর তার রাগ ভাঙল। একসময় ও আমার সঙ্গে কথা বলল। তখন আমরা বেশ কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশি কয়েকবার তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। 

mario_roymans_daughter_isabella_roymans.jpg
মারিও রয়ম্যান্সের কন্যা ইসাবেলা

তবে মাঝে কয়েক বছর ইসাবেলার সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি হিমুর। এরইমধ্যে ততোদিনে ঠিকানাও বদলে ফেলেছেন ইসাবেলা। ইসাবেলার সঙ্গে যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় হিমুর। ২০২১ সালে মারিও রয়ম্যান্সের সেই দুঃসাহসী অপারেশন সম্পর্কে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় বেলজিয়ামের বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র 'হেট বিলাং ফান লিমবুর্গ' এ। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর প্রতিবেদনের প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা করেন হিমু। প্রতিবেদকের সাহায্যেই তিনি ইসাবেলার বর্তমান ঠিকানা খুঁজে পান। ইসাবেলা বর্তমানে বাস করেন বেলজিয়ামের হ্যাসেল্ট শহরে। 

হিমুর সহযোগিতাতেই দ্য ডেইলি স্টারের এই প্রতিবেদকের কথা হয় মারিও রয়ম্যান্সের একমাত্র উত্তরসূরি ইসাবেলা রয়ম্যান্সের সঙ্গে। ইসাবেলা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাবাকে যখন হারাই তখন আমার বয়স মাত্র তিন। মা আমাদের ছেড়ে ততোদিনে চলে গেছেন বাবার সঙ্গে কোন স্মৃতিও মনে নেই। তবে বাবা যে তোমাদের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন এতে আমি ভীষণ গর্ববোধ করি। আমি এখন আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী নই; তবে যদি কখনো সুযোগ হয় তবে তোমাদের দেশে একবারের জন্য হলেও ঘুরে আসতে চাই। কারণ তোমাদের দেশটির জন্যই তো আমার বাবা নিজের জীবন বিপন্ন করে ঝুঁকি নিয়েছিলেন। বাবা আমাদের দেশে হয়তো একজন অপরাধী, কিন্তু তিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে তোমাদের মুক্তি সংগ্রামের জন্য যা করেছেন, তা তোমরা স্মরণ করবে এটিই আমার একমাত্র চাওয়া।' 

মারিও রয়ম্যান্সের বীরত্ব মনে রাখেনি কেউই

না বেলজিয়াম, না বাংলাদেশ; মারিও রয়ম্যান্সের বীরত্ব মনে রাখেনি কেউই। বেলজিয়ামে তিনি চিরকালই চিহ্নিত ছিলেন অপরাধী হিসেবে। আর বাংলাদেশ! মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য ২০১১ সালের ২৫ জুলাই থেকে ২০১৩ সালের ২ অক্টোবর পর্যন্ত সাত দফায় ২১টি দেশের ৩৩৯ জন বিদেশি বন্ধু ও সংগঠনকে বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা', 'বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা' ও 'মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা' বিভাগে সম্মাননা দেয় সরকার। কিন্তু এর কোনো তালিকাতেই ঠাঁই মেলেনি মারিও রয়ম্যান্সের। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ৩৩টি দেশের ৩৪৮ জন বিদেশি বন্ধুর যে তালিকা করা হয়েছে, মন্ত্রণালয় সূত্রে সে তালিকাতেও মারিও রয়ম্যান্সের নাম পাওয়া যায়নি।