শিখ নেতা হত্যা: ভারত-কানাডা সম্পর্কে দীর্ঘস্থায়ী ফাটলের আশঙ্কা

মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
20 September 2023, 09:31 AM
UPDATED 20 September 2023, 15:43 PM

বেশ কিছুদিন ধরে ভারত-কানাডার সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে। সম্প্রতি জি-২০ সম্মেলনে ট্রুডো-মোদির দ্বিপাক্ষিক আলোচনা বাতিল, শুল্কমুক্ত বাণিজ্য আলোচনা স্থগিতসহ দুই দেশের সম্পর্কের এই বিষয়টির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এর মাঝেই যেন এক বোমা ফাটালেন ট্রুডো।

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সোমবার জানান, জুনে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় শিখ সম্প্রদায়ের নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরকে খুনের ঘটনার সঙ্গে ভারতীয় এজেন্টদের যুক্ত থাকার বিষয়ে তার সরকারের কাছে 'বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ' আছে।

ট্রুডোর এই বিস্ফোরক মন্তব্যের ফলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও তিক্ত হতে পারে বলে ভাবছেন বিশ্লেষকরা। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার কানাডায় শিখ স্বাধীনতাকামীদের নানা উদ্যোগ নিয়ে নয়াদিল্লি তাদের অসন্তুষ্টির কথা অটোয়াকে জানিয়েছে।

পার্লামেন্টে যা বললেন ট্রুডো

Australia_in_Dhaka.jpg
হাউজ অফ কমন্সে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছেন ট্রুডো। ছবি: রয়টার্স

হাউস অব কমন্সে বক্তব্য রাখার সময় ট্রুডো জানান, তিনি এই মাসের শুরুর দিকে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনের সময় এই শিখ নেতাকে হত্যার সঙ্গে ভারতের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সামনে সবিস্তারে তুলে ধরেন। কানাডা সরকারের জোগাড় করা তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তিনি এই উদ্যোগ নেন বলে জানান তিনি।

ট্রুডো আরও বলেন, 'কানাডার মাটিতে কানাডীয় নাগরিককে হত্যার সঙ্গে বিদেশি সরকারের জড়িত থাকার বিষয়টি আমাদের সার্বভৌম কানাডার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।'

বিষয়টি সুরাহার জন্য ভারত সরকারকে আহ্বান জানান ট্রুডো। আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, স্বাধীন শিখ রাষ্ট্রের পক্ষে সোচ্চার হরদীপের হত্যাকাণ্ডের তদন্তে সহায়তা করতে ভারতের ওপর চাপ দেবেন তিনি।

কানাডা-যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ তদন্ত

কানাডা সরকারের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা হরদীপের হত্যা-রহস্যের তদন্তে একসঙ্গে কাজ করেছে। গতকাল মঙ্গলবার তিনি করেন, যৌথ তদন্তেই উঠে এসেছে ভারতীয় এজেন্টদের জড়িত থাকার বিষয়টি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, 'কানাডার কাছে যে তথ্যপ্রমাণ আছে, তা "সময়মতো" প্রকাশ করা হবে।'

গতকাল যুক্তরাষ্ট্র জানায়, তারা কানাডার তদন্তে সহায়তা করেছে।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, এ বিষয়ে কানাডার কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। তারা এই অভিযোগ নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। তারা মনে করেন, বিষয়টি নিয়ে পূর্ণ ও স্পষ্ট তদন্ত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। তারা ভারত সরকারকে এই তদন্তে সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ করবেন।

বহিষ্কার-পাল্টা বহিষ্কার

motijheel_3.jpg
ভারত-কানাডার কূটনীতিক সম্পর্কে চলছে টানাপড়েন। প্রতিকী ছবি: সংগৃহীত

ট্রুডোর বক্তব্যের পর জানা যায়, কানাডায় নিযুক্ত 'র' প্রধানকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানিয়া জোলি জানান, এ ঘটনায় ট্রুডো সরকার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছে।

তিনি বলেন, 'আমরা এক জ্যেষ্ঠ ভারতীয় কূটনীতিককে কানাডা থেকে বহিষ্কার করেছি।'

এরপর জোলি জানান, যাকে বহিষ্কার করা হয়েছে, তিনি কানাডায় ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (র) প্রধান ছিলেন।

এই ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পর এক জ্যেষ্ঠ কানাডীয় কূটনীতিককে ভারত ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয় নয়াদিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এই কূটনীতিকের পরিচয় ও পদবী প্রকাশ করা না হলেও তাকে ভারত ছাড়ার জন্য ৫ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, 'নয়াদিল্লির এই  সিদ্ধান্তে "আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো নিয়ে কানাডার কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপ ও ভারত-বিরোধী কার্যক্রমে তাদের সম্পৃক্ততা ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের" প্রতিফলন ঘটেছে।'

ভারতের জবাব

tom cruise
সারে'র গুরু নানক শাহী মন্দিরের বাইরে ঝোলানো বিলবোর্ডে নিহত শিখ নেতা হরদিপ সিং নিজ্জারের ছবি দেখা যাচ্ছে। ফাইল ছবি: রয়টার্স

কানাডার অভিযোগের জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, 'কানাডার কোনো সহিংস ঘটনায় ভারত সরকারের সম্পৃক্ততার অভিযোগ একেবারে ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত।'

'আমরা একটি গণতান্ত্রিক দেশ, যাদের আইনের শাসনের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার রয়েছে', যোগ করে ভারত সরকার।

দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, প্রধানমন্ত্রী মোদির কাছে ট্রুডো এসব অভিযোগের কথা জানালে তিনি এটি 'সম্পূর্ণ অস্বীকার' করেন।

'আমরা কানাডা সরকারকে তাদের ভূখণ্ডে সব ধরনের ভারত-বিরোধী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কার্যকর আইনি উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানাই', যোগ করে মন্ত্রণালয়।

ভারত-কানাডা সম্পর্কে প্রভাব

ভারত সরকার কানাডায় একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল—এই অভিযোগে দুই দেশের সম্পর্ক আরও শীতল হবে, এটা মোটামুটি অবধারিত।

চলতি মাসের শুরুতে কানাডা ভারতের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা স্থগিত করে। চুক্তিতে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের বিষয়টি প্রাধান্য পাওয়ার কথা ছিল এবং এর কাজ এ বছরের মধ্যেই শেষ হওয়ার কথা ছিল।

এ ছাড়াও ভারতে আগামী অক্টোবরে একটি পূর্বনির্ধারিত, বড় আকারের বাণিজ্য মিশনের পরিকল্পনাও বাতিল করে দেশটি।

সে সময় কারণ জানা না গেলেও এখন ধারণা করা হচ্ছে, হরদীপের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ভারতের জড়িত থাকার অভিযোগ এই সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে।

এ ছাড়াও, জি-২০ বৈঠকের সময় বেশ কয়েকজন বিশ্ব নেতার সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করলেও এ তালিকা থেকে ট্রুডোকে বাদ রাখেন মোদি।

ট্রুডোর সাবেক পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ও অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক রোল্যান্ড প্যারিস রয়টার্সকে বলেন, 'এই সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত দুই সরকারের মধ্যে স্বাভাবিক আলোচনা হওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই।'

ট্রুডোর রাজনৈতিক ফায়দা

train ticket
সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন জগমিৎ সিং। ছবি: রয়টার্স

কানাডার মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪ শতাংশই ভারতীয় বংশোদ্ভূত। এ ছাড়াও, পাঞ্জাবের পর শিখ ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় সম্প্রদায়টিও কানাডায় অবস্থিত। ট্রুডো জানান, হরদীপের হত্যাকাণ্ডে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর সদস্যরা রাগান্বিত হয়েছে এবং কেউ কেউ তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়েছেন।

দেশটির ১৪ লাখেরও বেশি মানুষ ভারতীয় বংশোদ্ভূত, যাদের অনেকেই শিখ সম্প্রদায়ের সদস্য। তাদের মধ্যে অন্যতম বিরোধী দল নিউ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা জগমিৎ সিং। পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখতে না পেয়েও ট্রুডোর সরকার টিকে থাকার পেছনে জগমিতের দলের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে দাবি করছেন বিশ্লেষকরা।

জগমিৎ সিং প্রচলিত প্রথা ভেঙে হাউস অব কমন্সে পাঞ্জাবি ও ইংরেজি ভাষায় বক্তব্য দেন। তিনি জানান, তিনি হরদীপের ছেলের সঙ্গে কথা বলেছেন।

'আমি তার কণ্ঠে বেদনা ও সবকিছু হারিয়ে ফেলার বিষয়টি অনুভব করেছি। আমি শুধু কল্পনা করতে পারি, সে এই সম্ভাব্য সম্পৃক্ততার (ভারত সরকারের) বিষয়টি জানতে পারলে তার বেদনার ভার আরও কতখানি বাড়বে', যোগ করেন তিনি।

খালিস্তান আন্দোলন ও হরদীপ সিং নিজ্জরের ভূমিকা

Monkey
হরদীপ সিং নিজ্জর। ছবি: এক্স থেকে সংগৃহীত

বিশ্লেষকদের মতে, হরদীপ সিং নিজ্জরকে হত্যার নেপথ্যে আছে খালিস্তান আন্দোলন দমনের প্রচেষ্টা।

১৯৭৭ সালে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের জলন্ধর জেলায় ভার সিং পুরা গ্রামে জন্ম নেন হরদীপ। পাঞ্জাব থেকে ১৯৯৭ সালে তিনি কানাডায় পাড়ি জমান। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে কানাডায় বসবাস করতেন তিনি। সেখানে মিস্ত্রির কাজ করতেন। তিনি নিজেকে একাধিকবার 'শুধুই ব্যবসায়ী' বলে অভিহিত করেন।

ভারতের অভিযোগ, হরদীপ খালিস্তান আন্দোলনের একজন নেতা। ভারতের উত্তরাঞ্চল ও পাকিস্তানের কিছু অংশ নিয়ে স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র 'খালিস্তান' গঠনের আন্দোলনকারীরা ভারতের চোখে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে বিবেচিত।

ভারতের দৃষ্টিতে 'সন্ত্রাসী সংগঠন' খালিস্তান টাইগার ফোর্সের (কেটিএফ) মূল পরিকল্পনাকারী হরদীপ। এ ছাড়া ভারতে নিষিদ্ধ শিখ ফর জাস্টিস (এসএফজে) নামে আরেকটি সংগঠনের সঙ্গেও হরদীপ যুক্ত ছিলেন বলে নয়াদিল্লির অভিযোগ।

২০২০ সালে ভারত সরকার হরদীপ সিংকে 'সন্ত্রাসী' তকমা দেয়। দেশটির ওয়ান্টেড তালিকায়ও তার নাম ছিল।

এক হিন্দু পুরোহিতকে খুনের মামলায় পলাতক হরদীপ সিংকে ধরিয়ে দিতে ১০ লাখ রুপি পুরস্কারও ঘোষণা করেছিল ভারত।

গত ১৮ জুন কানাডার ভ্যাঙ্কুভারের এক শহরতলিতে হরদীপকে (৪৫) গুলি করে হত্যা করা হয়। এটি কানাডার শিখঅধ্যুষিত এলাকা। ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের পর কানাডাতেই শিখ সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বেশি মানুষ থাকেন।

ভারতে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর জন্য হরদীপের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে নয়াদিল্লি। তবে এ অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন।

আশির দশকে ভারতে খালিস্তান আন্দোলন তীব্রতা পায়। 'অপারেশন ব্লু স্টার' চালিয়ে ব্যাপক হতাহতের মধ্য দিয়ে সেই আন্দোলন দমন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। হাজারো মানুষ প্রাণ হারায়। পরবর্তীতে দুই পাঞ্জাবি দেহরক্ষীর গুলিতে প্রাণ হারান গান্ধী পরিবারের অন্যতম জনপ্রিয় এই নেতা।

ভারতে এই আন্দোলন স্তিমিত। বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো এটি সমর্থন করে না এবং পাঞ্জাবেও দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে কোনো কার্যক্রমের কথা শোনা যায়নি।

তবে প্রবাসী শিখরা এখনো এই মতবাদে বিশ্বাসী, বিশেষত কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের। এসব দেশে খালিস্তানের স্বপক্ষে যেকোনো উদ্যোগে ভারত বিরক্তি ও অসন্তোষ প্রকাশ করে এসেছে।

এ বছর বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ৩ জনপ্রিয় খালিস্তানপন্থী নেতার মৃত্যুতে বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে।

পাকিস্তানে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন খালিস্তান কমান্ডো বাহিনীর নেতা পরমজিৎ সিং পাঞ্জওয়ার। তার হত্যা-রহস্যের সমাধান হয়নি এখনো।

যুক্তরাজ্যে ১৫ জুন খালিস্তান লিবারেশন ফোর্সের প্রধান আভতার সিং খানদা হাসপাতালের শয্যায় মারা যান। লন্ডনে ভারতের দূতাবাসের পতাকা নামিয়ে ফেলার অভিযোগে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তারের পর তিনি মারা যান।

তবে পুলিশের মুখপাত্র জানায়, 'এই মৃত্যুর ঘটনায় সন্দেহজনক কিছু নেই।'

এর তিন দিন পরেই মারা যান হরদীপ, যার মৃত্যুর ঘটনায় কানাডা-ভারতের সম্পর্ক একেবারে তলানিতে ঠেকেছে।