ভেনেজুয়েলায় যুদ্ধে জড়াচ্ছেন ‘শান্তিদূত’ ট্রাম্প?
বিশ্বমঞ্চে সব সময় নিজেকে 'শান্তিদূত' হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন মহাশক্তিধর মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি গত 'আট মাসে আটটি যুদ্ধ বন্ধের' দাবি করছেন। অতি সম্প্রতি, তথা গত মাসে তিনি গাজা যুদ্ধ বন্ধের ব্যবস্থা করেন।
এমন বাস্তবতায় ট্রাম্পকে প্রকৃত অর্থেই 'শান্তিদূত' বললে হয়ত অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু, এই 'শান্তিদূত'কে এখন দেখা যাচ্ছে যুদ্ধে জড়াতে। বিশেষ করে, দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ভেনেজুয়েলায়।
আজ রোববার সিএনএন-এর এক প্রতিবেদনের শিরোনামে বলা হয়, 'ট্রাম্প জানালেন তিনি ভেনেজুয়েলায় সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন'। একইদিনে সংবাদমাধ্যমটির অপর প্রতিবেদনের শিরোনামে বলা হয়—বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ভেনেজুয়েলার মাদুরোকে সরিয়ে দেওয়া হলে ট্রাম্প দীর্ঘস্থায়ী সামরিক অভিযান ও বিশৃঙ্খলায় জড়িয়ে যেতে পারেন।
এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্রাম্প মনস্থির করেছেন যে ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নিতে হবে। তার এমন সিদ্ধান্ত দক্ষিণ আমেরিকায় মার্কিন সামরিক অভিযানের ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।
ভেনেজুয়েলার ভেতরে সম্ভাব্য সামরিক অভিযান নিয়ে ট্রাম্প ইতোমধ্যে তার শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। ঘনিষ্ঠ সূত্রের বরাত দিয়ে সিএনএন আরও জানিয়েছে যে, দক্ষিণ আমেরিকার তেলসমৃদ্ধ দেশটির সমাজবাদী রাষ্ট্রপতি নিকোলাস মাদুরোকে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে কী সব ঝুঁকি আর কী কী সুবিধা পাওয়া যাবে—তা নিয়ে সেসব বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।
মার্কিন সেনা সদরদপ্তর পেন্টাগন এই সামরিক অভিযানের নাম দিয়েছে 'অপারেশন সাউদার্ন স্পিয়ার'। এই 'দখিনি বর্শা' অভিযানের জন্য ইতোমধ্যে এক ডজনের বেশি যুদ্ধজাহাজ ও ১৫ হাজার সেনা সেই এলাকায় পাঠানো হয়েছে।
এয়ার ফোর্স ওয়ান-এ সাংবাদিকদের প্রশ্নে জবাবে ট্রাম্প বলেন, 'আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। কী সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা বলবো না। তবে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।'
গত ১২ নভেম্বর মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ ও জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ জেনারেল ড্যান কেইনসহ কয়েকজন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন। পরদিন, দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তা ট্রাম্পের সঙ্গে হোয়াইট হাউসের 'সিচুয়েশন রুম'-এ বৈঠক করেন। এই রুমে গোয়েন্দা তথ্য নিয়ে আলোচনা করা হয়।
সূত্র মতে, এসব বৈঠকে ট্রাম্প তার সহকর্মীদের সঙ্গে হামলার লক্ষ্যবস্তু নিয়েও আলোচনা করেছেন।
ভেনেজুয়েলার সামরিক ও সরকারি ভবন এবং মাদক চোরাচালানের পথগুলোয় সরাসরি বিমান হামলা, অথবা মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করার ব্যবস্থাসহ অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
গত মাসে ট্রাম্প বলেছিলেন যে তিনি ভেনেজুয়েলায় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-কে কাজ করার দায়িত্ব দিয়েছেন।
আবার গত সপ্তাহে ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা আইনপ্রণেতাদের বলেছেন যে, কোনো দেশে এমন কাজ করার আইনি অধিকার সংস্থাটির নেই। তবে তারা এ ধরনের কাজ আয়োজন করতে পারে।
কথা পাল্টাতে পটু ট্রাম্প সম্প্রতি সংবাদমাধ্যম সিবিএস-কে বলেন, তিনি ভেনেজুয়েলার ভেতরে হামলা করার কথা ভাবছেন না। যদিও এর আগে তিনি ভেনেজুয়েলায় হামলার কথা বলেছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো সিএনএন-কে জানিয়েছে যে, ভেনেজুয়েলায় অভিযান ব্যর্থ হতে পারে অথবা মার্কিন সেনারা সেখানে ঝুঁকিতে পড়তে পারেন—বৈঠকে এমন বিষয় নিয়ে আলোচনার সময় ট্রাম্পকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল।
অভিযানের সম্ভাব্য ঝুঁকি ও সুবিধা
ট্রাম্প প্রশাসনের অনেকেই ভাবছেন ভেনেজুয়েলায় শাসক বদলানোর অভিযান শুরু হলে তা যুক্তরাষ্ট্রকে বড় মাত্রার ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। কিন্তু, মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে ট্রাম্প ও তার প্রশাসনের কেউ কেউ হয়ত এর সুবিধা নেবেন। কিন্তু, মার্কিন প্রশাসনের অধিকাংশ ব্যক্তি এমনকি ট্রাম্প নিজেও ভেনেজুয়েলায় সামরিক সাফল্য নিয়ে নিশ্চিত নন।
২০১৭ সালে ট্রাম্প প্রথম ক্ষমতায় আসার পর ভেনেজুয়েলার বিরোধীদলের নেতা জুয়ান গুয়াইদোকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটির আইনগত নেতা বলে ঘোষণা দেন। কিন্তু, এর দুই বছর পর ভেনেজুয়েলায় সেনা অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে গুয়াইদো ক্ষমতায় আসতে পারেননি।
মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র বিশাল বিজয় দাবি করতে পারবে। একদিকে যেমন ভেনেজুয়েলায় একনায়কের পতন হবে, অন্যদিকে নির্বাচিত নেতা ক্ষমতায় আসবেন। মাদক, অভিবাসন ও তেল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তির সম্ভাবনা দেখা দেবে।
সমর বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করে বলছেন, যদি মাদুরোকে উৎখাত করতে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার ভেতরে হামলা করেন তাহলে মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে কঠিন সমস্যায় পড়তে হতে পারে। এর ফলে ভেনেজুয়েলার বিরোধীদলগুলোর মধ্যে সংঘাত বাড়তে ও দেশটিতে সেনা অভ্যুত্থানের আশঙ্কা তৈরি হতে পারে।
গত শুক্রবার ভেনেজুয়েলার রাজধানী কারাকাসে রাষ্ট্রপতি মাদুরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সামরিক অভিযান শুরু করলে তা ভেনেজুয়েলাকে 'আরেক গাজা' বা 'আরেক আফগানিস্তান'-এ পরিণত করতে পারে। এমনকি, 'আবারও ভিয়েতনাম' জন্ম নিতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মাদুরো যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি লক্ষ্য করে বলেন, 'যারা বোমা মারার হুকুম দেন, দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে যুদ্ধ ও হত্যাযজ্ঞ শুরুর হুকুম দেন সেই উন্মাদদের থামান। যুদ্ধ থামান। যুদ্ধকে না বলুন।'
বিশেষজ্ঞরা আরও মনে করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বিদেশের মাটিতে যুদ্ধ শুরু করলে ট্রাম্পেরই মুখ পুড়বে। কেননা, তিনি যুদ্ধ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। ইরাক যুদ্ধে অংশ নেওয়া মার্কিন উপরাষ্ট্রপতি জেডি ভ্যান্স ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথও চান না যুক্তরাষ্ট্র বিদেশে যুদ্ধে জড়াক।
ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান পার্টির এক প্রভাবশালী নেতা সিএনএন-কে বলেন, 'মার্কিনিরা ট্রাম্পকে দক্ষিণ আমেরিকায় যুদ্ধ করার জন্য ভোট দেননি। আবার ট্রাম্পের সমর্থনের কারণে ভেনেজুয়েলার বিরোধীরাও ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কায় আছে। তাদের সমর্থন ছাড়া ট্রাম্পের উদ্দেশ্য সফল হবে না।'
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে যে মার্কিন জনমানস যুদ্ধের পক্ষে নয়। আবার ট্রাম্প যখন নিজেকে 'শান্তিদূত' হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করছেন, তখন তিনি নতুন যুদ্ধে জড়ালে তা পুরো বিশ্বকে আবারও অস্থির করে তুলবে।

