যুক্তরাজ্য-ভারত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনায় স্কচ হুইস্কি ও ভিসা
পারস্পরিক বাণিজ্য ও নিরাপত্তা সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার জন্য দুদিনের ভারত সফরে এসেছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। এ বছরের শেষ নাগাদ ভারতের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করতে চান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, চুক্তির খুঁটিনাটি বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ঐক্যমত্যে পৌঁছানো সহজ হবে না।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই চুক্তি স্বাক্ষরের পেছনে বেশ বড় একটি প্রভাবক হয়ে দাঁড়াতে পারে স্কচ হুইস্কি।
বিবিসি জানায়, ভারতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি হুইস্কি পান করা হয়। আর বিশ্বে সবচেয়ে নামকরা হুইস্কি উৎপাদিত হয় স্কটল্যান্ডে। তাই ভারত স্কচ হুইস্কির বড় বাজার হতে পারে।
ভারতে বিক্রি হওয়া প্রতি বোতল স্কচ হুইস্কির পেছনে ভোক্তাদের মোটা অংকের রুপি গুনতে হয়। এর পেছনে মূল কারণ হলো ভারতে বর্তমানে আমদানিকৃত মদের ওপর ১৫০ শতাংশ শুল্ক রয়েছে। ফলে বিক্রি হওয়া হুইস্কির বেশিরভাগই উৎপাদিত হয় ভারতের সীমানার ভেতরে।
স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত স্কচ হুইস্কি ভারতের বাজারে মাত্র ২ শতাংশ জায়গা নিতে পেরেছে।
স্কচ হুইস্কি অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, এই শুল্ক প্রত্যাহার করা হলে ভারতে হুইস্কি রপ্তানির পরিমাণ ৫ বছরে ১ বিলিয়ন পাউন্ড বাড়তে পারে।
শুধু হুইস্কি নয়, আমদানিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং শুল্ক, কোটা ও বিনিয়োগের ওপর বিধিনিষেধের কারণে অনেকেই ভারতের বাজারে পণ্য নিয়ে যেতেই চান না। যেমন বিদেশি গাড়ি আমদানিতে ভারত শতভাগ শুল্ক আরোপ করেছে। ফলে দেশটির বাজারে ব্রিটিশ গাড়ি সেভাবে ঢুকতে পারছে না। বরং বেলজিয়ামের বাজারে যুক্তরাজ্যের গাড়ি রপ্তানির পরিমাণ ভারতের বাজারের চেয়ে বেশি।
বিবিসি জানায়, ব্রিটিশরা এই পরিস্থিতি বদলানোর আশা দেখছে। ২০২২ সালের শেষ নাগাদ একটি বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছানোর লক্ষ্যে দুই দেশের প্রতিনিধিরা এরই মধ্যে আলোচনা শুরু করেছেন এবং আগামী সপ্তাহে এ আলোচনার তৃতীয় পর্যায় শুরু হবে।
যুক্তরাজ্যের বাণিজ্যমন্ত্রী অ্যান-মারি বলেছেন, এমন একটি চুক্তি একটি 'সোনালী সম্ভাবনা' বয়ে আনবে। হয়তো ২০৩৫ সালের মধ্যে ভারত-যুক্তরাজ্য বাণিজ্য বেড়ে দ্বিগুণ হবে, যার পরিমাণ হতে পারে প্রায় ২ হাজার ৮০০ কোটি পাউন্ড।
অস্ট্রেলিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করেছে, তাই যুক্তরাজ্যও বেশ আশাবাদী।
তবে এ ধরনের আলোচনার ক্ষেত্রে উভয় দেশেরই কিছু চাহিদা থাকে।
বাণিজ্য অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভারত দেশি শিল্পকারখানা ও কর্মীদের সুরক্ষায় আরোপিত শুল্ক উঠিয়ে নিতে নাও চাইতে পারে। প্রধানমন্ত্রী মোদি ভারতের নিজ সীমানায় মদ চোলাই কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের কথা ভেবে হুইস্কির ওপর শুল্ক কমাতে নাও চাইতে পারেন। ভারত শুল্ক উঠিয়ে দিতে রাজি হবে তখনই যখন বিনিময়ে যুক্তরাজ্যও ছাড় দেবে।
যুক্তরাজ্যের যেমন ভারতের উৎপাদন ও সেবা খাতে প্রবেশের আগ্রহ রয়েছে, তেমনি ভারত চায়, তাদের উৎপাদিত ওষুধ যুক্তরাজ্যের বাজারে সহজে প্রবেশ করুক। সেইসঙ্গে ভারতীয়দের জন্য ভিসার সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়টিও ভারতের চাহিদায় রয়েছে।
তবে এই চুক্তির রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয়ে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীকেই সতর্ক থাকতে হবে। ব্রেক্সিট পরবর্তী অভিবাসন আইন অনুযায়ী, গত বছর ৬০ হাজার ভারতীয় দক্ষ-কর্মী হিসেবে যুক্তরাজ্যের ভিসা পেয়েছেন, যা মোট ভিসাপ্রাপ্তদের ৪০ শতাংশ।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভিসার সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে এবং দক্ষ ভারতীয়দের দীর্ঘ সময়ের জন্য যুক্তরাজ্যে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। বরিস জনসন নিজেই এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন, যুক্তরাজ্যে দক্ষ জনশক্তির অভাব মেটাতে ভারতীয়দের ভিসা দেওয়া খুবই প্রয়োজন।
২০১৬ সালের ব্রেক্সিট স্মারকের পর থেকে অভিবাসন খুবই সংবেদনশীল বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
ধারণা করা হয়, ২০৫০ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠতে যাচ্ছে ভারত। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে মধ্যবিত্তের প্রসার বাড়বে, সেইসঙ্গে বাড়বে তাদের ক্রয়ক্ষমতা। তাই অনেক দেশের জন্যই ভারত খুবই কাঙ্ক্ষিত একটি বাজার। যুক্তরাজ্য চাইছে আগেভাগেই সেই বাজারের বড় অংশ দখলে নিতে। তবে হিসাব-নিকাশ খুব সহজ নয়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে নিজের দেশের শিল্পখাত ও কর্মীদের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে। তিনি চাইলেও অভ্যন্তরীণ মদের বাজারে নিয়োজিত লাখ লাখ কর্মীর কর্মসংস্থানের বিষয়টি উপেক্ষা করতে পারবেন না, তাই বিদেশি মদের শুল্ক তুলে নেওয়াও হয়ত তার জন্য সহজ হবে না।
অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের কাছে অভিবাসনের বিষয়টি স্পর্শকাতর। বিশেষ করে ২০১৬ সালে ব্রেক্সিটের পর ব্রিটেনে এটি একটি বড় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। তাই ভারতের ভিসার সংখ্যা বাড়ানোর দাবি প্রধানমন্ত্রী জনসনের পক্ষে পূরণ করা খুব সহজ হবে না।
বাণিজ্য আলোচনার শুরুর পর্যায়গুলো সাধারণত সহজেই পার হওয়া যায়। জটিল বিষয়গুলো রয়ে যায় শেষের অংশে সমঝোতার জন্য। তাই যুক্তরাজ্য-ভারত বাণিজ্য চুক্তির সত্যিকারের বাধাগুলো হয়ত স্পষ্ট হতে আরও কিছু সময় লাগবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দুই পক্ষ ছাড় দিতে রাজি হলে এ বছরের শেষ নাগাদ হয়ত একটি অন্তর্বর্তী চুক্তিতে পৌঁছানো সম্ভব হবে। তবে বড়দিনের আগেই একটি পূর্ণ চুক্তি সইয়ের লক্ষ্যকে 'উচ্চাভিলাসী' বলছেন তারা।