মহাসাগরে পানির বদলে পেট্রোল থাকলে কী হতো?

By স্টার অনলাইন ডেস্ক
1 April 2022, 10:07 AM
UPDATED 1 April 2022, 16:31 PM

ধরুন আপনাকে পানির পরিবর্তে পেট্রোলপূর্ণ একটি মহাসাগরের মালিকানা দেওয়া হলো। যেখান থেকে ইচ্ছেমতো পেট্রোল সংগ্রহ করা যায়। তাহলে কেমন হতো?

সাগর-মহাসাগরগুলো পেট্রোলপূর্ণ হলে কি সেখানে আগুন লেগে যেত? সুপেয় পানির ব্যবস্থাই বা হতো কীভাবে? এতে সাগরে কি বিস্ফোরণ ঘটতো? নাকি এই পেট্রোল ভর্তি মহাসাগর বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিতো? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হবে আজ।

জ্বলন্ত মহাসাগর

পৃথিবীর ৪ ভাগের ৩ ভাগ জল (প্রায় ৭১ শতাংশ), যার অধিকাংশ ধারণ করে আছে আমাদের এই মহাসাগরগুলো। মনে হতে পারে সেগুলো পেট্রোল দিয়ে পূর্ণ করা হলে বিস্ফোরণ ঘটার সম্ভাবনা থাকতো ছিল সময়ের ব্যাপার। তবে বিষয়টা কি আসলেই তেমন? এর উত্তর হচ্ছে না। 

what_if.png
ছবি: সংগৃহীত

সাগর ভর্তি পেট্রোল থাকলেই সেখানে আগুনে জ্বলবে না। এর বড় কারণ হচ্ছে, পেট্রোল তরল অবস্থায় নিজে নিজে জ্বলতে পারে না। তবে, পেট্রোলের বাষ্প যদি বাতাসের সঙ্গে মিশে যায়, তাহলে সেটা দাহ্য গ্যাসে পরিণত হয়। প্রতিটা জ্বালানী পদার্থের বাষ্প বন্ধ করার জন্য দরকার হয় একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার, যাকে বলে ফ্ল্যাশপয়েন্ট।

মাইনাস ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রাতেই গ্যাসোলিন বাষ্প উৎপন্ন করতে পারে। এর ফলে ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার এই পৃথিবীতে মহাসাগরগুলো থেকে ক্রমাগত তরল গ্যাসের বাষ্পীভবন দেখা যাবে। এ ছাড়া মহাসাগরগুলোতে ভয়ঙ্কর অগ্নিকুণ্ড দেখা না গেলেও সমুদ্রপৃষ্ঠে সারাক্ষণ আগুন জ্বলতে থাকবে।  

সাগর-মহাসাগরগুলো ক্রমাগত জ্বলতে থাকলে সেখান থেকে নির্গত হবে বিষাক্ত ধোঁয়া। কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনো অক্সাইড ও নাইট্রোজেন অক্সাইডের মতো বিষাক্ত বাতাস। যা আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনকে আরও বেশি ত্বরান্বিত করবে। সব ধরনের সামুদ্রিক প্রাণীর মৃত্যু হবে। 

gettyimages-621781392-596b71833df78c57f4a8b61d.jpg
ছবি: সংগৃহীত

শারীরিক ও বাণিজ্যিক প্রভাব

বায়ুমণ্ডলের প্রায় অর্ধেক অক্সিজেন আসে মহাসাগরগুলো থেকে, এমন পরিস্থিতিতে তা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে, আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত হবে। সবাইকে তখন নভোচারীদের মতো মুখে বিশেষ ধরনের মাস্ক ও সঙ্গে অক্সিজেন নিয়ে ঘুরতে হবে। তা না হলে নিঃশ্বাসের সঙ্গে বিষাক্ত রাসায়নিক গ্রহণ করতে হবে। মানবদেহের লোহিত রক্ত কণিকায় অক্সিজেনের পরিবর্তে কার্বন মনো অক্সাইড প্রবাহিত হবে। যা টিস্যু গুলোকে মারাত্মক ক্ষতিসাধন করবে। আর যারা সাগরের কাছাকাছি বাস করেন, তারা অতিরিক্ত কার্বন মনো অক্সাইড গ্রহণের ফলে দ্রুত মারা যেতে পারেন। 

241789_web.jpg
ছবি: সংগৃহীত

 
এ ছাড়া বিষাক্ত গ্যাসের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবে মানবদেহের নানামুখী জটিলতা সৃষ্টি হবে। মাদকগ্রহণ ছাড়াই বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে মাদকসেবীদের মতো লক্ষণ দেখা দেবে। কম্পন, খিঁচুনি ও হ্যালুসিনেশন শুরু হবে। কেউ কেউ আবার স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলতে পারে। ঘটনার এখানেই শেষ না, আরও আছে।

সামুদ্রিক জলের তুলনায় পেট্রোলের ঘনত্ব ৪ ভাগের ৩ ভাগ (৭৫ শতাংশ), তাই পেট্রোলের সাগরে জাহাজ ভাসিয়ে রাখার মতো পর্যাপ্ত প্লবতা থাকবে না। বৈশ্বিক বাণিজ্যের অধিকাংশ পণ্য পরিবহণ সমুদ্রপথের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় হওয়া, সেটা ধ্বংস হয়ে যাবে। আর এর ফলে নিত্যদিনের জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। 

অ্যাসিড বৃষ্টি 

এবার আসল প্রশ্নে আসা যাক। এতক্ষণ পড়তে পড়তে যে প্রশ্নটা অনেকের মস্তিষ্কের কোণে বারবার উঁকি দিচ্ছিল। তা হলো- মহাসাগর যদি পেট্রোলে পূর্ণ হয়, তাহলে বৃষ্টিতেও কি পেট্রোল বর্ষিত হবে? পেট্রোল আসলে বিভিন্ন হাইড্রোকার্বন দিয়ে তৈরি, যার সবকটির আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যখন তারা বায়বীয় অবস্থায় পরিণত হয়, তখন হাইড্রোকার্বনগুলো আলাদা হয়ে যায় এবং তা ছড়িয়ে পড়ে। ফলে, পেট্রোল বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। 

পেট্রোলের মহাসাগরগুলো সালফার ডাই অক্সাইড এবং নাইট্রোজেন অক্সাইড নির্গত করবে। যা বায়ুমণ্ডলে জল এবং অক্সিজেনের সঙ্গে মিশে অ্যাসিড বৃষ্টি হিসাবে বর্ষিত হবে। যা পৃথিবীর জন্যে হবে আরও ভয়ঙ্কর। অ্যাসিড বৃষ্টির ফলে গাছপালা ও ফসলের যে পরিমাণ ক্ষতি হবে তাতে খাদ্যের চরম সংকট সৃষ্টি হবে।

dead_vlei_sossusvlei_namib_desert_namibia_luca_galuzzi_2004.jpg
ছবি: সংগৃহীত

তবে, মানুষের জন্যে খাবারের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বিশুদ্ধ জল। পৃথিবীর সব জলধারা একটা পর্যায়ে গিয়ে সাগরে প্রবাহিত হয়। যেকোনো সুপেয় জল পেট্রোলে পূর্ণ সাগরে মেশার সঙ্গে সঙ্গেই দূষিত হয়ে যাবে। তাই, পৃথিবীতে জীবন টিকিয়ে রাখার জন্য দরকার পড়বে সুপেয় জলের বিকল্প তৈরি করা। যা মোটেও সহজ কাজ নয়, যদিও মিঠা পানির গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে অবস্থিত বাঙ্গালি জাতির জন্যে বিষয়টা উপলব্ধি করা কিছুটা কঠিন। 

যাইহোক, এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পেট্রোলে পূর্ণ সাগর-মহাসাগরের কি কোনো ভালো দিক নেই? অবশ্যই আছে, সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে জ্বালানীর দাম কমে যাওয়া, চুলাতে ইচ্ছেমতো কাপড় শুকাতে পারা। গ্যাসোলিন দিয়ে তৈরি পণ্য, এমনকি বিদ্যুৎ এর দাম কমে যাওয়া। কিন্তু, বিষাক্ত ধোয়াচ্ছন্ন বায়ুমণ্ডল, খাদ্য ও সুপেয় জলের সংকটের চেয়েও কি এটা বেশি মূল্যবান?

গ্রন্থনা: এস এম সোহাগ