কেমন হতো পৃথিবীটা সমতল হলে
কেমন হতো যদি পৃথিবীটা গোল না হয়ে সমতল হতো, অথবা পৃথিবীর একটি প্রান্ত থাকত! আর যদি সেই সমতল পৃথিবীর প্রান্ত ধরে ছুটে চলা গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যেত, তখন? সৌরজগত সমতল পৃথিবীটাকে ধরে রাখতোই বা কীভাবে? পৃথিবী সূর্যের চারপাশে, নাকি সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতো? গাছগুলো কী তীর্যকভাবে বেড়ে উঠতো?
আত্মঘাতীরা যদি এই প্রান্ত থেকে ঝাঁপ দিত, তাহলে তারা কোথায় গিয়ে পড়তো? প্রান্ত নিরাপদ রাখতে তারপাশে মানুষের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকতো? থাকলেও সেই নিরাপত্তার দায়িত্ব নিশ্চয়ই নাসা অথবা মার্কিন মহাকাশ বাহিনীর হাতেই থাকতো? কেন না, এলিয়েনরা শুধু আমেরিকাতেই আসে, অন্তত সিনেমায় আমরা তাই দেখি। যাইহোক, পৃথিবীটা সমতল হলে কী হতো, সেসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হবে আজ।
সমতল পৃথিবী নিয়ে প্রচলিত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বা বিশ্বাস কিন্তু আজকের না, হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ পৃথিবীকে সমতল ভেবে এসেছে। যাকে ঘিরে সবকিছু ঘূর্ণায়মান। কারণ মানবজাতি মহাবিশ্বের কেন্দ্রে থাকতেই বেশি ভালবাসে। তাই সবকিছুকে তার চারপাশে আবর্তিত করে কল্পনা করতে চেয়েছে। তবে, এই ধারণা ২ হাজার বছর আগে থেকে পাল্টাতে শুরু করে।
নাসার একটি নিবন্ধ থেকে জানা যায়, প্রাচীন গ্রিকরা মহাকাশে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান, গ্রীষ্মের অয়নকালের সময় ও চন্দ্রগ্রহণের সময় তার ওপর পতিত পৃথিবীর ছায়া পরিমাপ করে পৃথিবীর গোলাকার ধারণাতে উপনীত হয়েছিল।
যা শক্তিশালী হয় ৫ শতাব্দী আগে, বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপার্নিকাসের তত্ত্বে। দীর্ঘ সময় পর্যবেক্ষণের পর সমতল পৃথিবীর তত্ত্বটাকেই বাতিল করে দেন তিনি। শুধু তাই নয়, সৌরজগতের কেন্দ্রের অবস্থানটাও তিনি পৃথিবীর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলেন। পৃথিবী নয় বরং সূর্যকে সৌরজগতের কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। আধুনিক যুগের বিজ্ঞানীরা জিওডেসি ব্যবহার করে পৃথিবীর আকৃতি, মাধ্যাকর্ষণ এবং ঘূর্ণন পরিমাপ করেন। জিপিএসসহ মহাকাশ থেকে পাওয়া ছবিতেও পৃথিবীকে চাঁদের মতো গোলাকার দেখায়। গ্রহগুলোর এমন গোলাকারে তৈরি হওয়ার পেছনে মূলত মাধ্যাকর্ষণ শক্তি দায়ী।
মাধ্যাকর্ষণ সব বস্তুকে সব দিক থেকে সমানভাবে একত্রিত করে, যার ফলে পদার্থ একটি গোলক গঠন করে। মাধ্যাকর্ষণ না থাকলে আমাদের আজকের কল্পনা হয়তো বাস্তবও হতে পারতো। তবে, সেটা হয়তো অনেকে চাইতো না। কিছু মানুষ কিন্তু এর বিপরীতেও আছেন। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য, পৃথিবীতে একটা গোষ্ঠী আছে যারা পৃথিবীর সব বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন, বহু বছর ধরে যারা পরিচিত 'ফ্লাট আর্থ সোসাইটি', ও 'মডার্ন ফ্লাট আর্থ সোসাইটি' নামে, যাদের রয়েছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গবেষণার জন্য 'ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাট আর্থ রিসার্চ সোসাইটি'!
২০১০ সালে 'দ্য গার্ডিয়ান'-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এই গোষ্ঠীর তৎকালীন সভাপতি ড্যানিয়েল শেন্টন, মানুষের বিবর্তনকে একটা জালিয়াতি ও বৈশ্বিক উষ্ণতাকে রহস্য বলে মনে করেন। আর পৃথিবীর গোলাকৃতির তত্ত্ব, তা তো তাদের কাছে বাতিলের খাতায় চলে গেছে। তাদের ধারণা, মাধ্যাকর্ষণ বলে আসলে কিছুই নেই, যা আমরা কেবল অনুভব করি। কারণ, কিছু রহস্যময় শক্তি প্যানকেক আকৃতির এই পৃথিবীকে উপরের দিকে ত্বরান্বিত করছে।
সমতল পৃথিবীতে কি মাধ্যাকর্ষণ থাকতো? বৈজ্ঞানিক ভাষায় বলতে গেলে সমতল পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ কাজ করতো কেন্দ্রে, অর্থাৎ ঠিক মাঝখানে, যা আশেপাশের সবকিছুকে কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করতো, যত কাছাকাছি পৌঁছানো যেত কেন্দ্রের আকর্ষণ ততই শক্তিশালী হতো। একইসঙ্গে এটা নিচের দিকে টানতো, ফলে মানুষকে শরীরের সমস্ত শক্তি কাজে লাগিয়ে উপরের দিকে উঠতে হতো। আর এ কারণেই মানুষকে পৃথিবীর প্রান্তে যেতে দেওয়া হতো না, কারণ মাধ্যাকর্ষণ সেখানে খুবই শক্তিশালী হতো।
একটু অন্যভাবে ভাবা যাক, সমতল পৃথিবীর অন্য পাশে কি থাকতো? সেখানে নিশ্চয় বিপরীত মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করতো। এবং উলটো পাশের প্রান্তে বস্তুগুলো নিচের পরিবর্তে পাশের দিকে হেলে পড়তো, কারণ সমস্ত মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কেন্দ্রে থাকতো। গাছগুলো মাধ্যাকর্ষণের ফলে তীর্যকভাবে বেড়ে উঠবে। বৃষ্টি, তুষারপাত কেবল পৃথিবীর কেন্দ্র, আর্কটিকের দিকেই বর্ষিত হবে। মহাসাগরগুলো কেন্দ্রে গিয়ে একত্র হয়ে একটি বড় মহাসাগরে পরিণত হতো।
সমতল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় একটি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে বাতাসের চাপ। মাধ্যাকর্ষণের ফলে অধিকাংশ বাতাসের চাপ কেবল পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকেই থাকবে। ফলে, প্রান্তের চারপাশের অঞ্চলগুলোতে বায়ুচাপ প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়বে, অস্ট্রেলিয়ানদের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্যে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন থাকবে না। আর কেন্দ্র, অর্থাৎ আর্কটিকের আশেপাশের দেশ যেমন, রাশিয়া, আমেরিকা ও স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলোর মানুষ বায়ুমণ্ডলের অতিরিক্ত চাপে পিষ্ট হয়ে যেত। এশিয়ানরা এই দুদিক থেকেই খানিকটা নিরাপদ।
একটি সমতল পৃথিবীর চারপাশে ভূ-চৌম্বকীয় ক্ষেত্র থাকবে না, যে ক্ষেত্রটি পৃথিবীর কেন্দ্রের গতিবিধির মাধ্যমে উৎপন্ন হয়। একইসঙ্গে সমতল পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে যথাস্থানে ধরে রাখার মতো কিছু থাকবে না। ফলে, এটি মহাকাশে ছড়িয়ে পড়বে আর আমরা সৌর বিকিরণের সংস্পর্শে চলে যাব, যা থেকে দেখা দিতো ক্যান্সারের মতো মহামারি। এমনকি তাতে মানুষের ডিএনএ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এবং পৃথিবীর কোথাও শ্বাস নেওয়ার জন্যে উপযোগী বাতাস পাওয়া যেত না। তাই, সর্বদা অক্সিজেন মাস্ক মুখে দিয়ে ঘুরতে হতো। কেমন একটা মহাকাশচারীদের মতো অনুভূতি হতো।
এবার আসল প্রশ্নে আসা যাক, কক্ষপথের কী হতো? দিন-রাত, সময় গণনা কীভাবে হতো? সমতল পৃথিবীতে বিশ্বাসকারীদের মতে, সূর্য ও চন্দ্র পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। উভয়ই কাজ করতো ৫০ কিলোমিটার ব্যাসের স্পট-লাইটের মতো। এবার এই বিষয়টা বিজ্ঞানের আলোকে চিন্তা করা যাক, সূর্য যদি একটি স্পট-লাইট হিসেবে কাজ করে তবে পৃথিবীর সব স্থান থেকেই সূর্যকে দেখা যেত। যা কিছুটা এলিয়েনকেন্দ্রিক সায়েন্স ফিকশন সিনেমায় দেখা যায়।
এই ব্যবস্থায় দিন ও রাতের কোনো চক্র থাকবে না। থাকবে না কোনো টাইম জোন, কিংবা কোনো ঋতুচক্র। তবে, ছোট্ট এই সূর্য যখন পৃথিবীর উপরে থাকতো তখন দিন, আর নিচে থাকা অবস্থায় রাত। ভাগ্যিস, এখানে সূর্যটা অনেক ছোট, আসল সূর্যের মতো বিশাল হলে এর উত্তাপে সমতল পৃথিবীটা মুহূর্তের মধ্যেই পুড়ে ছাই হয়ে যেত। সূর্যটা আবার বেশি ছোট হলেও সমস্যা, সমস্ত পৃথিবীটা তখন হিমাগারে পরিণত হতো। সবকিছু তাহলে হিমায়িত হয়ে মৃত্যুবরণ করত। এর কারণ হলো সমতল পৃথিবী হবে গোলাকার পৃথিবীর পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফলের প্রায় আড়াই গুণ। বর্তমানে বাস্তব আকারের সূর্যের শক্তির মাত্র এক-তৃতীয়াংশ পাওয়া যায়। সমতল পৃথিবীর ক্ষুদ্রাকৃতির সূর্যালোকের এক তৃতীয়াংশ জীবনের অস্তিত্বের জন্য একদমই যথেষ্ট হতো না।
আচ্ছা, চন্দ্রগ্রহণ কেমন হতো? সমতল পৃথিবীতে বিশ্বাসীরা এক ধরনের বিরোধী চাঁদে (অ্যান্টি-মুন) বিশ্বাস করে। গোলাকার পৃথিবীতে, পৃথিবী, চন্দ্র ও সূর্যের মাঝে অবস্থান করলে চন্দ্রগ্রহণ ঘটে। যা একটি সমতল পৃথিবীর ক্ষেত্রে সম্ভব না।
সমতল পৃথিবীর তত্ত্বটি সত্য বলে প্রমাণিত হলে বর্তমান পৃথিবীর অনেক কিছুই অসম্ভব হয়ে যেত, প্রান্তে যাওয়ার জন্যে সৃষ্টি হতো একদল মাফিয়ার, যারা অর্থের বিনিময়ে ভ্রমণপিপাসু, আত্মঘাতী ও চোরাকারবারীদের সেখানে পৌঁছে দিত। দৌড়ে দৌড়ে গাছে ওঠা যেত। প্রান্তে ব্রেক ফেল হলে সোজা মহাকাশে। লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও ও কেট উইন্সলেটের সেই বিখ্যাত ছবিটাও জাহাজে না তুলে পৃথিবীর প্রান্তেই তোলা যেত।
গ্রন্থনা: এস এম সোহাগ
তথ্যসূত্র: হোয়াট ইফ, দ্য গার্ডিয়ান ও নাসা