সিলেটে টিলা ধ্বংসের উপাখ্যান
শত-সহস্র বছর ধরে সিলেট জেলার যেসব টিলা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল, নগর সভ্যতার চাপে গত দুই দশকের মধ্যেই সেগুলো বিলীন হতে বসেছে। আইনের কঠোর প্রয়োগের অভাবে নির্বিচারে টিলা কাটার ফলে সিলেটের প্রকৃতি-পরিবেশে চরম বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
পরিবেশবাদীদের দাবি, গত দুই দশকে টিলা কাটা সিলেট অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মানবসৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয়ে দেখা দিয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের পরোক্ষ সহযোগিতায় টিলা কাটা হচ্ছে। সরকারি প্রকল্পের জন্য টিলা কাটার বিষয়টি এসব প্রভাবশালীদের আরও সহায়তা করছে।
১৯৫৬ সালের ভূমি জরিপের আলোকে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রস্তুত করা তথ্য অনুযায়ী, সিলেট জেলায় ১ হাজার ২৫টি টিলা ছিল, যার মধ্যে ১৯৯টি টিলা সিলেট নগরী ও এর আশপাশের এলাকায় অবস্থিত।
বেলা'র সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ শাহেদা আক্তার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এসব টিলার মধ্যে অর্ধেকই ইতোমধ্যে কাটা হয়ে গেছে, আর অবশিষ্ট টিলাও খুব দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে ঠিক কী পরিমাণ টিলা অবশিষ্ট আছে, তার তথ্য কোনো সরকারি কার্যালয়ে নেই।'
সিলেটের প্রতিটি উপজেলাতেই বিপুল পরিমাণ টিলা কাটা হলেও সম্প্রতি সিলেট নগরীর পার্শ্ববর্তী এলাকায় টিলা কাটা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।
গত আগস্ট মাসে সিলেট সিটি করপোরেশনের সীমানা ২৬ দশমিক ৫০ বর্গকিলোমিটার থেকে বর্ধিত করে পার্শ্ববর্তী সিলেট সদর ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলার বেশ কিছু এলাকা অন্তর্ভুক্ত করে ৫৮ বর্গকিলোমিটার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নগরীর সীমানা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পার্শ্ববর্তী এলাকায় বাসযোগ্য জায়গার দাম ও চাহিদা বেড়েছে। আর এর ফলে সেসব এলাকায় আরও ব্যাপকভাবে টিলা কাটা হচ্ছে।'
সম্প্রতি নগরীর বালুচর, মলাইটিলা, ব্রাক্ষ্মণশাসন, হাওলদারপাড়া, খাদিমপাড়া, মেজরটিলাসহ বেশকিছু এলাকা পরিদর্শক করে দেখা যায়, রাতের আঁধারে কাটা হচ্ছে অসংখ্য টিলা।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) অনুযায়ী, ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক যেকোনো প্রয়োজনেই কোনো ধরনের পাহাড়-টিলা কাটা যাবে না। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে টিলা কাটা যেতে পারে।
এ আইনের পরিপ্রেক্ষিতে ও সিলেটে টিলা কাটা বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০১১ সালের নভেম্বরে উচ্চ আদালতে একটি রিট দায়ের করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি। ২০১২ সালে সেই রিটের রায়ে সিলেটে সবধরনের টিলা কাটায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেন উচ্চ আদালত।
কিন্তু এসব আইন ও আদেশ লঙ্ঘন করে সিলেটে অবাধে চলছে টিলা কাটা। প্রভাবশালীদের পাশাপাশি সরকারি প্রকল্পের স্বার্থেও অনুমোদনহীনভাবে কাটা হচ্ছে টিলা।
গত মাসে সিলেট নগরীর উপকণ্ঠে টিলাগড় এলাকায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীনে নির্মিতব্য ইনস্টিটিউট অব লাইভস্টক সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির ক্যাম্পাস নির্মাণের জন্য টিলা কাটা হয়েছে। বিষয়টি জানাজানি হলে গত ২১ অক্টোবর নির্মাণ কাজের ঠিকাদারকে ৭ লাখ টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর।
প্রকল্পটির পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই ভূমিটি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এবং এখানে টিলায় নয়, বরং সমতলেই ইনস্টিটিউটটি নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ভূমি উন্নয়নের প্রয়োজনে টিলা নয়, বরং টিলার সামান্য একটু অংশ কাটা হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর ইতোমধ্যে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে বিষয়টি সমাধান করেছে।'
বেলা'র বিভাগীয় সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ শাহেদা আক্তার বলেন, 'ব্যক্তিগত প্রয়োজনে টিলা কাটার পেছনে প্রভাবশালীদের সমর্থন থাকে। আর তারা যখন দেখে যে সরকারি প্রকল্পেও টিলা কাটা হচ্ছে, তখন তারা আরও বেশি প্রশ্রয় পায়।'
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইমরুল হাসান বলেন, 'টিলা কাটা বন্ধে যৌথ অভিযান পরিচালনা অব্যাহত আছে। এ ছাড়াও, উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রায়ই অভিযান পরিচালনা করছেন।'
পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, গত ২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে চলতি নভেম্বর মাস পর্যন্ত টিলা কাটার অপরাধে ২ দশমিক ২৮ কোটি টাকার মতো জরিমানা করা হয়েছে, যার মধ্যে অর্ধেকই আদায় করা হয়েছে। এসময় অন্তত ৫০টি অভিযান এবং ১০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। এ ছাড়াও, টিলা কাটার অপরাধে ১৬৮টি মামলা বর্তমানে আদালতে পরিচালিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, 'সীমিত লোকবল নিয়ে এত বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চলতে থাকা টিলা কাটা বন্ধ করা কঠিন। তবুও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, নিয়মিত অভিযান পরিচালনাও করছি। টিলা কাটা পুরোপুরি বন্ধে সরকারের সব দপ্তরের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।'
অভিযান ও জরিমানার পরও টিলা কাটা বন্ধ না হওয়া প্রসঙ্গে বাপা'র আব্দুল করিম কিম বলেন, 'টিলা কেটে সমতল করে ভবন নির্মাণের উপযোগী ভূমি প্রস্তুত করা হলে ভূমির দাম অন্তত ১০ গুণ বেড়ে যায়। টিলা কাটার সময় পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে জরিমানা করলেও সেই জরিমানার টাকা বর্ধিত মূল্যের তুলনায় খুবই কম। তাছাড়া টিলার মাটির বিক্রয়মূল্যও রয়েছে। তাই এই জরিমানাকে হিসেবের মধ্যে রেখেই টিলা কাটা হচ্ছে। বরং জরিমানার মাধ্যমে টিলা কাটাকে পরোক্ষভাবে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'জরিমানা ছাড়াও অনেক সময় মামলা দেওয়া হলেও বেশিরভাগ মামলা কেবল শ্রমিক বা মাটি কাটার ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে করা হয়। তাই নামমাত্র জরিমানা ও শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা নয়, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ভূমির মূল্যের চেয়েও বেশি অংকের জরিমানার সঙ্গে ভূমির মালিকদের কারাদণ্ড দেওয়া হলেই কেবল টিলা কাটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।'