মৌলভীবাজারে সাফারি পার্ক তৈরিতে জীব বৈচিত্র্য ধ্বংসের আশঙ্কা
মৌলভীবাজারের লাঠিটিলা বনে দেশের তৃতীয় সাফারি পার্ক তৈরির পরিকল্পনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদরা। তারা বলছেন, সংরক্ষিত এই বনে সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণের বিষয়টি এখানকার জীব বৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ফেলবে।
এ ছাড়া এই বনে বংশ পরম্পরায় বসবাসের পাশাপাশি চাষাবাদের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে আসা বাসিন্দারাও উদ্যোগটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের মনে কাজ করছে উচ্ছেদের ভয়। এই বনে প্রায় সাড়ে তিন শ পরিবারের বসবাস।
যদিও কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, সাফারি পার্ক গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় পরিবেশগত বিষয়গুলো দেখা হবে এবং এতে করে কেউ উচ্ছেদ হবে না। তবে কাউকে কাউকে বন এলাকার ভেতরে অন্য কোথাও স্থানান্তর করা হতে পারে। আর এই সাফারি পার্ক তাদের সবার জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করে দেবে।
সাফারি পার্ক বাণিজ্যিক পর্যটকদের জন্য সেই আকর্ষণীয় জায়গা, যেখানে বনের পশুরা মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ায়। আর দর্শনার্থীরা গাড়িতে চড়ে তা দেখতে পারেন।
১৯৯৯ সালে কক্সবাজারের ডুলাহাজরায় দেশের প্রথম সাফারি পার্ক তৈরি করা হয়। দ্বিতীয়টি তৈরি হয় ২০১৩ সালে, গাজীপুরে। এ দুটি সাফারি পার্কের নামকরণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। প্রস্তাবিত তৃতীয় পার্কটিও একই নামে হবে।
পাথারিয়া হিল রিজার্ভের আওতাধীন জুড়ি ফরেস্ট রেঞ্জের লাঠিটিলা বনের আয়তন পাঁচ হাজার ১৪১ একর। যার বেশিরভাগ পাহাড়ি ভূমি আর অল্প কিছু সমতল।
বনটিকে সাফারি পার্কে রূপান্তরের প্রস্তাব এমন একটি সময়ে এলো, যখন দেশের পাহাড়ি বনের পরিমাণ দ্রুত কমে আসছে।
বন বিভাগের করা ফরেস্ট সেক্টর মাস্টার প্ল্যান অনুসারে ১৯৯০ সালে পাহাড়ি প্রাকৃতিক বনের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৮ হাজার ৬৩০ হেক্টর। ২০১৫ সাল নাগাদ তা ৭৯ হাজার ১৬০ হেক্টরে নেমে আসে।
সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক সংস্থাগুলোর জোট আইইউসিএন এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘লাঠিটিলা বনটি বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল। আমাদের যেটুকু বনভূমি আছে, সেটুকু সংরক্ষণের ব্যাপারে সরকারের মনোযোগ দেওয়া উচিত।’
শত বছর আগে এই বনভূমির আংশিক ছিল অনুর্বর। অন্য অংশে ছিল প্রাকৃতিক বাঁশের বাগান। গত শতকের চল্লিশের দশকের শুরু থেকে বন বিভাগ এর ২ হাজার ৫৯৬ একর এলাকাজুড়ে সেগুন গাছ লাগাতে শুরু করে।
গাছ লাগানোর পাশাপাশি তা সংরক্ষণের জন্য বন বিভাগ ৮৭টি পরিবার এখানে নিয়ে আসে। যারা তখন থেকেই বনটির পরিচর্যা ও দেখভাল করে আসছে।
সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এস এম সাজ্জাদ হোসেন জানান, বনটিতে এখনো সেগুন গাছ আছে। কিন্তু ২০০০ সালে ব্যাপকভাবে ফুল আসার দরুন বাঁশ বন প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। যা এখন আবার আস্তে আস্তে গড়ে উঠছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বন কর্মকর্তা বলেন, বাঁশ বনের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় লম্বা সময়ের দরকার হয়। এখন যদি সাফারি পার্কের অবকাঠামো নির্মাণ ও অন্যান্য গাছ লাগানোর জন্য এই বনের ভূমি ব্যবহার করা হয়, তাহলে এখানকার জীব বৈচিত্র্য ঝুঁকির মুখে পড়বে।
গত বছরের জুলাই মাসে বন বিভাগের উদ্যোগে ‘প্রিপারেশন অব মাস্টার প্ল্যান অ্যান্ড ফিজিবিলিটি স্টাডি ফর এস্টাব্লিসমেন্ট অব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক অ্যাট মৌলভীবাজার’ শীর্ষক সাড়ে চার কোটি টাকার এই প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়।
প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য দরপত্র আহ্বান করে ৬ অক্টোবর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। পরে চলতি বছরে ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিইটিএস কানসাল্টিং সার্ভিস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ দেওয়া হয়।
প্রতিষ্ঠানটি এখন লাঠিটিলা বনে সাফারি পার্ক তৈরির ক্ষেত্রে এর পরিবেশগত, বাহ্যিক ও আর্থিক উপযুক্ততার বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছে।
এদিকে প্রকল্পের জরিপের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই লালছড়া, রূপাছড়া ও জরিছড়া গ্রামের প্রায় সাড়ে তিন শ পরিবারের ভেতর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
হেডম্যান বাবুল মিয়া বলেন, ‘তিন প্রজন্ম ধরে আমরা এই বনে বসবাস করছি। আমরা বনে হাজার হাজার সেগুন গাছ লাগিয়েছি। পরিচর্যা করেছি। আর ফল ও শস্য চাষের জন্য আমরা খুব অল্প পরিমাণ ভূমি ব্যবহার করি।
‘এখন আমাদের যদি এখান থেকে উচ্ছেদ করা হয়, তাহলে তা হবে নিষ্ঠুর একটি কাজ।’
লালছড়া গ্রামের তোফায়েল আহমেদ নামের এক যুবক জানান, জরিপকারীরা কাজ শুরু করার পর তারা সরকারের এই পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে পারেন। তিনি বলেন, ‘সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, এই কাজের জন্য আমাদের বাড়িঘর বাদ দিয়ে যেন উন্মুক্ত কোনো জায়গা ব্যবহার করা হয়।’
গ্রামের অন্য বাসিন্দারা বলছেন, বন বিভাগ এই পরিকল্পনার বিষয়ে তাদের কিছুই জানায়নি। এ ক্ষেত্রে গ্রামের বাসিন্দাদের কী কবে, সে ব্যাপারেও কর্মকর্তারা নিশ্চিত করে কিছু বলছেন না।
লালছড়া গ্রামের বয়স্ক বাসিন্দা ফকর উদ্দীন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর নামে সাফারি পার্ক হলে, আমরা খুব খুশি হব। কিন্তু সেটা যেন আমাদের উচ্ছেদ করে না হয়।
এর আগে গত ১২ এপ্রিল গ্রামবাসীরা উচ্ছেদের হাত থেকে তাদের বাড়ি ও ফল বাগান রক্ষার জন্য লালছড়ায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে।
সিলেটে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম লাঠিটিলা বনে সাফারি পার্ক তৈরির বিষয়ে বলেন, ‘লাঠিটিলা বনের খুব গভীর একটা অংশ। এবং এটা প্রত্যন্ত একটা এলাকা। পরিবেশ সংরক্ষণসহ সার্বিক বিবেচনায় সাফারি পার্ক তৈরির জন্য এমন একটা জায়গা বেছে নেওয়ার বিষয়টি ভালো কিছু হবে না।’
কিম আরও বলেন, ‘বরং পার্কের কোনো এমন জায়গা বেছে নেওয়াটা ভালো হবে, যেখানে সহজে যাতায়াত করা যায়। যেমন মৌলভীবাজার শহরের বরশিজোড়া ইকো পার্ক। আর যেখানকার জন্যই এই পরিকল্পনা করা হোক না কেন, অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রকৃতি সংরক্ষণের বিষয়েই সর্বোচ্চ গুরুত্বটা দিতে হবে।
‘আর এ কারণে যদি গ্রামবাসীকে উচ্ছেদ হতে হয়, তাহলে সেটা হবে অন্যায়।’
(ঈষৎ সংক্ষেপিত)
*প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ