‘নদী ধ্বংস করে নিজেদের অদূরদর্শী জাতি হিসেবে প্রমাণ করছি আমরা’
নদী বাংলাদেশের একটি বড় সম্পদ। অথচ এর প্রতি অবহেলা করে, নদী ধ্বংস করে নিজেদের অদূরদর্শী একটি জাতি হিসেবে প্রমাণ করে চলেছি আমরা। নদী দখল ও দূষণ রোধে যে আইনগুলো আছে তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবও আছে। অথচ নদী রক্ষার ক্ষেত্রে এর দূষণ ও দখল রোধ করাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
আজ শনিবার বিকেলে রাজধানীর দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে আয়োজিত 'নদী ও আমাদের ভবিষ্যৎ' শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন বক্তারা।
আগামীকাল ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস সামনে রেখে দ্য ডেইলি স্টার এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে।
ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের সভাপতিত্বে বৈঠকে বক্তব্য দেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সরকারি দলের সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) নির্বাহী পরিচালক ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সদস্য মালিক ফিদা আবদুল্লাহ খান, নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ব্রতীর প্রধান নির্বাহী ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক সদস্য শারমিন মুরশিদ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মো. মুজিবর রহমান, ডেইলি স্টারের প্রধান প্রতিবেদক পিনাকী রায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও ডেইলি স্টারের আইন বিভাগের পরামর্শক গোলাম সারওয়ার, বাপা'র সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) বায়েস চৌধুরী, রিভারাইন পিপল'র মহাসচিব শেখ রোকন, বড়াল রক্ষা আন্দোলন ও চলনবিল রক্ষা আন্দোলনের সদস্য সচিব এস এম মিজানুর রহমান এবং বছিলা পুরাতন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য মো. মানিক হোসেন।
বৈঠকের শুরুতে নদীকে 'ঈশ্বরপ্রদত্ত একটি সম্পদ' হিসেবে অভিহিত করে ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, 'কীভাবে এমন একটি সম্পদ আমরা এতটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দেখি, তা আমি একেবারেই বুঝে উঠতে পারি না। আগে হয়তো আমরা পরিবেশগত বিষয়গুলোতে অতটা সচেতন ছিলাম না, কিন্তু এখন তো অনেক কিছু জানি। এটা নিয়ে অনেকে কথা বলছেন। তারপরেও কোনো নাটকীয় পরিবর্তন দেখছি না।'
ডেইলি স্টারের প্রধান প্রতিবেদক পিনাকী রায় বৈঠকে দেশের নদীগুলোর দখল ও দূষণের সার্বিক চিত্র নিয়ে একটি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন। সেখানে দুর্যোগ ফোরামের একটি প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, '১৯৬৩ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ৩৭ বছরে ১১৫টি নদী মারা গেছে। আরেকটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণায় বলা হচ্ছে ২০০০ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ২০ বছরে ৪৩টি নদী মারা গেছে।'
নদী রক্ষায় দখল ও দূষণকে মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে অভিহিত করে তিনি আরও বলেন, 'পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ হিসাবে নদী দখল, দূষণ ও পাহাড় কাটাসহ বিভিন্ন অপরাধে এখন পর্যন্ত ৯ হাজার ৪১০ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে ৪৫৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আদায় হয়েছে ২২৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। তবে আইনে থাকলেও নদী দখলের জন্য কিংবা দূষণ করার জন্য কাউকে এখন পর্যন্ত জেলে পাঠানো হয়নি '
বৈঠকে পরিবেশ ও নদী রক্ষায় প্রণীত বিভিন্ন আইন, বিধি-বিধান ও এগুলোর সীমাবদ্ধতা নিয়ে কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও ডেইলি স্টারের আইন বিভাগের পরামর্শক গোলাম সারওয়ার।
তিনি বলেন, 'জলাধার সংরক্ষণ আইনে এ সংক্রান্ত (ভরাট, দূষণ) যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, সেই নিষেধাজ্ঞা জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে পরিবেশ অধিদপ্তর চাইলে শিথিল করতে পারে। কিন্তু জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা কিন্তু আইনে বলে দেওয়া হয়নি। তো এই জাতীয় স্বার্থকে পুঁজি করে জলাধার ভরাট করা হতে পারে এবং তার ক্ষতি হতে পারে তার প্রমাণ আমরা দেখছি প্রতিনিয়ত।'
এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনের তথ্য উল্লেখ করে তিনি জানান, পরিবেশ ও নদী দূষণের বাংলাদেশ ৩ দশমিক ৪ শতাংশ জিডিপি হারাচ্ছে।
গোলাম সারওয়ার আরও বলেন, '(পরিবেশ ও দূষণ সংক্রান্ত) প্রতিটি আইনের মধ্যে সেভিং ক্লজ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ তারা (বিভিন্ন সরকারি সংস্থা) যদি সরল বিশ্বাসে কোনো কাজ করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নেওয়া যাবে না। এটা আইনেই বলে দেওয়া হয়েছে। তার মানে সরল বিশ্বাসে যদি কোনো প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়, আর তা যদি নদীকে দূষণ করে ফেলে, তাহলে আইনগতভাবে আমরা সেটা চ্যালেঞ্জ করতে পারছি না। তাতে আইনেই বাধা আছে।'
এ ছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও পরিবেশ আদালত আইনে কোথাও সরাসরি কোনো ব্যক্তি আদালতে মামলা করতে পারেন না মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'এ জন্য তাকে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে মামলা করতে হয়।'
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, 'সরকারের উচ্চ পর্যায়ে প্রশংসিত হওয়ার, উৎসাহিত হওয়ার মতো কোনো ব্যাপার আমি দেখেছি নদী নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে নেই। বরং উল্টোটা হয়েছে।'
তারা ভাষ্য, এত এত প্রভাবশালীরা নদী নখল করে আছে যে, তারা নদী রক্ষা কমিশনে কর্মরতদের শত্রু জ্ঞান করে।
তিনি বলেন, 'এ জন্য নদী রক্ষা কমিশনকে যদি আরও বেশি ক্ষমতায়ন করাও হয়, তারপরেও তারা পেরে উঠবে কিনা সন্দেহ।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, `পরিবেশ আইনে ২১ বছর আগে যে ফাঁকফোকর ছিল, তা এখনো আছে। জবাবদিহিতা ছাড়াই পরিবেশ অধিদপ্তরকে বিশাল ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। জনগণের মামলা করার সুযোগ কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তারপর থেকে আমরা বিশাল আইনি উন্নয়ন দেখেছি। নদী কমিশন গঠন করা হয়েছে। আদালত নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করেছেন।'
`বিষয়টা শুনতে ভালো লাগছে। কিন্তু প্রকৃত অবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি। আইন যত সূক্ষ্মই হোক না কেন, আইনের মূল ভিত্তি যদি ভঙ্গুর হয়, তাহলে আইন কাজে আসবে না', যোগ করেন তিনি।
আসিফ নজরুল আরও বলেন, 'তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দূষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কর্মকর্তাদের ওএসডি করতে দেখেছি আমরা। পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেন না।'
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান সাবের হোসেন চৌধুরী নদীর বর্তমান অবস্থার জন্য রাজনৈতিক বোঝাপড়ার অভাবকে দায়ী করে করে বলেন, 'এখানে ধারণাগত বিশাল ফাঁকফোকর রয়েছে। রাষ্ট্রীয় মৌলিক নীতির আলোকে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য সংবিধানের ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রণয়ন করা হয়েছে। সরকার যেসব আইন প্রণয়ন করবে, সেগুলো সেসব অনুচ্ছেদের আলোকে প্রণয়ন করতে হবে। আমরা তার কতটুকু করতে পেরেছি?'